আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।
গত ২ ফেব্রুয়ারি রোববারের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সারাদেশে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে। উদ্বিগ্নতার ভারে সবার মন ক্রুদ্ধ এবং শঙ্কিত। দেশের বৃহত্তম এই শিক্ষাঙ্গনটি অতীতের মতো আবারও রক্তাক্ত হয়েছে। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এর পরিবেশ।
বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা হয়েছে। প্রশ্ন, এর পশ্চাত্পদ কারণ কী? অতীতের অনেক ঘটনার মতো এ ঘটনাটির আঙ্গিক একরকম নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ষাট বছরেরও বেশি। অনেক আন্দোলন সংগ্রাম এখানে হয়েছে। বিশেষ করে প্রগতিশীল আন্দোলনের সূতিকাগার এই মনোরম ক্যাম্পাস।
গত জানুয়ারিতে কার্যত চলমান আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। নেতৃত্ব দেয় প্রগতিশীল ছাত্রজোট। তারা তাদের নিয়মে সন্ধ্যাকালীন কোর্স বাতিলের কথা সীমিত পরিসরে বলে আসছিল। ইতিপূর্বেও তেল-গ্যাস-বিদ্যুত্-বন্দর রক্ষা কিংবা ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসক্রিপশন বাতিল প্রভৃতি নিয়ে লিফলেট-ব্যানারভিত্তিক আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছিল। ঠিক এরকমই মুষ্টিমেয় 'বাণিজ্যিকীকরণ-বিরোধী' এ আন্দোলনটি শুরু করেছিল, সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে।
পরে ধীরে ধীরে প্রকাশ্য হয়ে পড়ে বিভিন্ন খাতে ফি বাড়ানোর প্রসঙ্গটি। যেটি গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে দেশব্যাপী হরতাল-অবরোধ চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত মাসিক সিন্ডিকেটে অনুমোদন করে। এ বর্ধিত ফি বেশ কিছু খাতে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়, যা একজন শিক্ষার্থীর ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সার্টিফিকেট উত্তোলন পর্যন্ত প্রদানযোগ্য করা হয়। অবশ্য গুজবও হয় কিছু ফি নিয়ে— যেমন হলের সিট রেন্ট বৃদ্ধি— যা আদৌ আরোপ হয়নি। যা হোক, এরূপ প্রক্রিয়ায় ফি-বৃদ্ধির ভেতর দিয়ে প্রগতিশীল জোটের সংবাদ সম্মেলন-পরবর্তী ছাত্রসমর্থন বৃদ্ধি পায়।
ইতিমধ্যে গত ২৩ তারিখ ভর্তি পরীক্ষাকে সামনে রেখে প্রশাসনকে সাতদিনের আলটিমেটাম দেয় ছাত্রজোট নেতৃত্ব। ভর্তি পরীক্ষার ভেতরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা বা পর্যালোচনার সুযোগ পায়নি কিংবা বিষয়টি তাদের কাছে তেমন গুরুত্ব পায়নি। গত ২৬ তারিখ ভর্তি পরীক্ষা শেষ হলে তা বিচিত্রমাত্রায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এর সঙ্গে নীতিগতভাবে বেশ কিছু শিক্ষক সংহতি জানালে তারুণ্যের আন্দোলনে বাড়তি অনুপ্রেরণা যুক্ত হয়। ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে তারা ধর্মঘটের ডাক দেয়।
এর মধ্যে প্রতিটি হলে বর্ধিত ফি-র প্রসঙ্গটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রবল সমর্থন অর্জন করে। বস্তুত এ সমর্থনের সঙ্গে ব্যক্তিগত, দলগত, সমষ্টিগত অনেক বিষয় যুক্ত হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। কর্মচাঞ্চল্যহীন রাজশাহী অঞ্চলের অধিকাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র, নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা গ্রাম-মফস্বল থেকে আসা। অর্থ-সংকুলানের প্রশ্নটি তাদের কাছে বড় প্রশ্ন। এছাড়া আদর্শগত প্রশ্নে তরুণ মনের দুটো দিক— এক. রক্ষণশীল ধর্মনির্ভর চেতনা, দুই. প্রগতিশীল তত্ত্বের সাম্যভিত্তিক চেতনা।
এমন দুটো চেতনাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রত্যয় ঘোষণা করে, চলমান আন্দোলনের প্রতি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনে এ আন্দোলনের এমন ব্যাপকতার কারণ বর্ধিত ফি হলেও অঞ্চলভিত্তিক বাস্তবতায় এর অভ্যন্তরীণ কারণগুলো বাতিল করে দেয়া যায় না। বিশেষ করে, মৌলবাদী সংগঠনের অনুগত ব্যক্তি ও সমর্থকরা যখন নানা কৌশলে শিক্ষাঙ্গনে বিচরণ করছে, পাঠ গ্রহণ বা পরীক্ষায় অংশগ্রহণের নাম ভাঙ্গিয়ে। তাঁরা একটি বিরাট সুযোগ এ আন্দোলনের ভেতরে পর্যাপ্তরূপে পেতে সক্ষম হয়। ফলে গত বৃহস্পতিবার থেকে আন্দোলনটি সর্বাত্মক অবরুদ্ধতায় সর্বোচ্চ মাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়।
প্রসঙ্গত, সরকারি ছাত্র-সংগঠনের নেতৃবৃন্দও এ আন্দেলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে ওইদিনই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বর্ধিত ফি স্থগিত করে সকল শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যেতে পরামর্শ দেয়। কিন্তু ত্বরিত স্পর্ধায় সবকিছু অগ্রাহ্য করে আন্দোলনকারীরা শনিবারও একই রূপে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। প্রতিটি হলে অনানুষ্ঠানিক সভা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বর্ধিত ফি স্থগিতের বিষয়টি প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি বলে আখ্যায়িত করে। আন্দোলন তখন একই বেগে ধাবিত হয়।
এখন প্রশ্ন, শিক্ষার্থীদের অর্থ সংকুলানের প্রশ্নে প্রশাসন কর্তৃক বর্ধিত ফি স্থগিত করা হলেও ব্যাপক বিক্ষোভ কেন চলমান থাকলো? প্রগতিশীল জোটের সন্ধ্যাকালীন কোর্স বাতিলের বিষয়টিতে তবে কী সকলের সমর্থন ছিল? সন্ধ্যাকালীন কোর্সের বিষয়টি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তথা দেশে উচ্চশিক্ষালয়ে নতুন নয়। সম্প্রতি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে প্রথম ব্যাচে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। কলা অনুষদেও তা চালু করতে যাচ্ছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল জোটের তাত্ত্বিক যুক্তি বা নীতিভিত্তিক সমর্থনের বাইরে এইসব অনুষদের শিক্ষার্থীদের ভেতরে শিক্ষাবঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কাটি কাজ করেছিল। বেশি বেতনে একই ছাদের নিচে একই শিক্ষক কর্তৃক যারা পাঠগ্রহণ করবে তাতে সর্বদিক থেকে তারা বঞ্চিত হবে, এই ছিল তাদের হতাশার জায়গা।
তাতে শিক্ষকদের স্বেচ্ছাচারিতার মাত্রা আরও বাড়বে— এরূপ ধারণা। কিন্তু ধারণাপ্রসূত যতোই হোক আগেই বলেছি, এই মোটিভেশন পশ্চাত্পদ রাজশাহীর বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত। তাহলে প্রশ্ন- এটি আগে হলো না কেন? আগেও হতে পারতো, কিন্তু রাজনীতির সুযোগ ও সময় এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গত পাঁচ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক সমীকরণটি কী দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুষ্পার্শ্বে কাদের আধিপত্য।
ব্যাপক মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল এ আন্দোলনে। এরা কতোটুকু অধিকার সচেতন, কতোটুকু উদ্দেশ্যপ্রবণ আজ্ঞাবহ— সেটি বিশ্বাস করার জন্য তেমন বুদ্ধি খরচের প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে মৌলবাদী সংগঠনটি পূর্ণমাত্রায় সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে, তাতে সন্দেহ কী! অতি সন্তর্পণে এর হোমওয়ার্ক হয়েছে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবগুলো হলে, দীর্ঘ সময়ে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হাতে এ হোমওয়ার্কেও খবর ছিল না। তা ধরাও পড়েনি, তাই যা উদ্যোগী হলে গোড়াতেই বিনাশ হতো, সময় পেরিয়ে যাওয়ায় প্রচুর কাঠখড় পুড়িয়েও তার সমাধান হয়নি।
এবারে আসি রোববারের ঘটনায়। বর্ধিত ফি স্থগিতের পরও আন্দোলনের বেগ একই গতিতে অব্যাহত থাকলে ওইদিন বেলা এগারোটার দিকে ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়। যথারীতি ক্ষমতার দম্ভে অস্ত্রের প্রদর্শন ও পুলিশী তত্পরতা প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে প্রাণভয়ে দিগিবদিক জ্ঞানশূন্য ছোটাছুটির একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে আশ্রয় নেয়। এক্ষেত্রে প্রক্টোরিয়াল বডির ভূমিকা ছিল নাজুক ও দায়িত্বহীন।
হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থী যখন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে আটকে আছে, তখন বাইরে পুলিশ ও সশস্ত্র ছাত্রলীগের আতঙ্ক ভেতরের সকলকে যেমন অসহায়ত্বের মধ্যে ফেলে দেয় তেমনি বাঁচার আকুতি করে তারা মোবাইল ফোনে হলের ও অন্যসব ছাত্রদের সংঘবদ্ধ সহায়তা কামনা করে। গুজব আর আতঙ্কের ভেতরে সবগুলো হল থেকে শিক্ষার্থীরা একযোগে বেরিয়ে এলে পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। সেই সুযোগে গোটা ক্যাম্পাসজুড়ে পরিচয়হীন ছাত্রনামধারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ভাঙচুর করে এবং সর্বপ্রকার শিক্ষকদের বেপরোয়াভাবে লাঞ্ছিত করায় লিপ্ত হয়। বিস্ময়করভাবে, তারা শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় অতিথিভবন জুবেরীতে হামলা করে। সেখানে গাড়ি ভাংচুর, আবাসিক স্থানে হামলা ও ক্লাবের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে।
যেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। কয়েক ঘন্টাব্যাপী এ তাণ্ডব চলতে থাকে। এসব ঘটনার সময় পুলিশের ভূমিকা ছিল কর্তৃত্বহীন দর্শকমাত্র।
রোববারের ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে একদিকে যেমন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছে অন্যদিকে তেমনি চরম অদক্ষতায় ক্ষমতাসীনরা সে সুযোগটুকু তৈরি করে দিয়েছে।
এক্ষেত্রে অস্ত্র প্রদর্শকদের ভূমিকা অতীতের মতোই দায়িত্বহীন এবং ন্যক্কারজনক। ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে। কিন্তু এটিই তো শেষ কথা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির নিমিত্ত ফি-বৃদ্ধি কিংবা সন্ধ্যাকালীন কোর্স চালু বিষয়ে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন মত অবশ্যই আছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে তা আলোচনা হতে পারে বা সমঝোতার ভিত্তিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যেও আসা সম্ভব।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের বিনষ্টি— শিক্ষার পরিবেশই শুধু নয়, গবেষণা ও জ্ঞানচর্চার স্থাপনাকেও দুর্বল করে তোলে— যা কোনোমতেই দেশ বা জাতির জন্য মঙ্গলকর কিছু বয়ে আনে না। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি বাস্তবানুগ হওয়া চাই, । বিশেষ করে সন্ধ্যা কোর্স চালুর পক্ষে-বিপক্ষে বিচিত্র অভিজ্ঞতায় গত দু'দিন ধরে গণমাধ্যমে আমরা অনেক বিশিষ্টজনের মন্তব্য শুনছি, কিন্তু বামপন্থা বা অতি-তাত্ত্বিকদের সর্বদা এন্টি-রাষ্ট্র, এন্টি-সরকার আর নৈরাজ্যতত্ত্ব কখনোই রাষ্ট্রের ডিজিটাল উন্নতি ঠেকায় না, ঠেকায়ওনি কোনোকালে। এর অর্থ এই নয় যে, তাঁদের তত্ত্ব-মতকে অস্বীকার করছি। বাস্তব বা কাণ্ডজ্ঞানের অভিপ্রায়ে সভ্যতার সম্মুখ অগ্রযাত্রার পরিচর্যাটুকু করাই ভালো, তাতে নিশ্চয়ই সকলের মুক্তি।
সুত্র
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।