বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে নতুন ট্রানশিপমেন্ট সম্পর্ক তৈরি করতে যাচ্ছে ভারত। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে যোগাযোগ স্থাপন করতেই এ প্রকল্প হাতে নিয়েছে দেশটি। কালাদান নামক এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সেভেন সিস্টার্স হিসেবে পরিচিত সাত রাজ্যে বাংলাদেশ বাণিজ্য হারাবে। বাজার চলে যাবে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের কাছে। ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে এ ট্রানজিট প্রক্রিয়া নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের কাছে দীর্ঘ চিঠি লিখেছেন দিলি্লতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক এ করিম।
তোফায়েল আহমেদের ভারত সফরের পর গত ২৭ জানুয়ারি চিঠিটি লেখা হয়। এর একটি কপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীকেও দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে হাইকমিশনার ভারতের সঙ্গে ট্রানজিটসহ দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ইস্যু বাস্তবায়নে সরকারকে কার্যকর ও দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি এ লক্ষ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে আগামী এপ্রিলের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করারও পরামর্শ দিয়েছেন। তারিক এ করিম ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে সম্প্রতি এক বৈঠকের কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, সুজাতা সিং দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের সঙ্গে জড়িত ইস্যুগুলো বাস্তবায়নে তার দেশের সরকারকে তাগাদা দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
চিঠিতে যত বেশি সম্ভব সীমান্ত হাট স্থাপনের পরামর্শ দিয়ে হাইকমিশনার বলেছেন, এর ফলে চোরাচালানসহ অপরাধমূলক কাজ কমে আসবে। বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার অন্যতম কারণ হিসেবে চোরাচালানকে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, সীমান্তে বিএসএফ যেটি করছে সেটি তাদের ব্যাপার, আমরাও একই ধরনের আচরণ করলে তা শুধু দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাই বাড়াবে। চার পৃষ্ঠার এ চিঠিতে দুই দেশের বিভিন্ন এলসি স্টেশনের অবকাঠামো উন্নয়ন, নৌ প্রটোকলে নতুন পথ অন্তর্ভুক্তকরণ, ট্রানজিট অবকাঠামো উন্নয়নে সীমান্তে রেলপথ স্থাপনের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়াও বাজার সম্প্রসারণে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
কালাদান হাইওয়ে প্রজেক্ট : ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযোগ বাড়াতে ভারত ও মিয়ানমার কালাদান হাইওয়ে প্রজেক্ট বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাইকমিশনার তারিক এ করিম।
কালাদান প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পূর্বাঞ্চলীয় কলকাতা সমুদ্র বন্দরের সঙ্গে মিয়ানমারের সিত্তে বন্দরের সংযোগ তৈরি হবে। এর পর সিত্তে থেকে মিজোরাম পর্যন্ত নদী ও সড়কপথে যোগাযোগ সম্পর্ক গড়ে তোলা হবে। হাইকমিশনারের মতে এটি হলে ভারত-বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যে ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা চাচ্ছে, তার প্রয়োজনীয়তা ফুরোবে। তবে এর ফলে যেটি উদ্বেগের বিষয়, সেটি হচ্ছে সেভেন সিস্টার্সে বাজার হারাবে বাংলাদেশ। কেননা মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড ওই বাজার করায়ত্তে নিতে তোড়জোড় চালাচ্ছে।
ডেট লাইন ৩০ এপ্রিল : ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে বাণিজ্য বাড়াতে ট্রানজিটসহ বিভিন্ন ইস্যু বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের তাগাদা দিয়েছেন হাইকমিশনার। তিনি বলেছেন, আলোচ্য সময়ের মধ্যে বাণিজ্য, নৌপরিবহন, যোগাযোগ, রেলপথ, গণপূর্ত, স্বরাষ্ট্র (ইমিগ্রেশন ও বিজিবিসহ) ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ এনবিআর, সড়ক ও জনপথ অধিদফতরকে নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করতে হবে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টাও থাকবেন। উচ্চপর্যায়ের এ বৈঠকে ইস্যুভিত্তিক আলোচনা করে যেসব সিদ্ধান্ত আসবে, একটি সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ওই সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করার নির্দেশ দিতে হবে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের। দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্ট ইস্যু বাস্তবায়নে দুই দেশের সচিব পর্যায়ের যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি যত দ্রুত সম্ভব বৈঠক করবে এবং তৃতীয়ত, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন দূতাবাস বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে।
সেভেন সিস্টার্স সংযোগ : সেভেন সিস্টার্সে যোগাযোগ বাড়াতে দুই দেশের মধ্যে যে নৌপ্রটোকল রয়েছে, তাতে ব্রহ্মপুত্র নদকে অন্তর্ভুক্তের পরামর্শ দিয়ে হাইকমিশনার উল্লেখ করেন, এর ফলে আসাম ও মেঘালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ হবে। ঢাকা থেকে আসামের রাজধানী গৌহাটি পর্যন্ত সরাসরি বিমান চলাচল চুক্তির বিষয়েও পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া ফুলবাড়ী-বাংলাবান্ধা এলসি স্টেশন, চেংড়াবান্ধা-বুড়িমারি স্থলবন্দর, ডালু-নাকুগাঁও স্থলবন্দর এবং ডাউকি-তামাবিল স্থলবন্দরের সুবিধা বাড়ানোসহ সংশ্লিষ্ট বন্দরের সঙ্গে রেলপথ সংযোগ গড়ে তোলা প্রয়োজন। হাইকমিশনার বলেন, আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ খুব শীঘ্রই শেষ হবে। আগরতলা-রামগড় সংযোগ নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।
ভারত খুশির সঙ্গে ফেনী ব্রিজ এবং অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থায়নে সম্মত আছে। এ প্রসঙ্গে তিনি ২০১০ সালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী যে যৌথ ইশতেহার দিয়েছিলেন সেটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে উল্লেখ করেন, রোহানপুর-সিঙ্গাবাদ, রাধিকাপুর-বিরল রেল সংযোগ স্থাপনের বিষয়টি অগ্রাধিকারভিত্তিতে নিশ্চিত করতে হবে।
প্রসঙ্গত, বিগত মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নে ভারত সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ওই সফরে দুই প্রধানমন্ত্রী একটি যৌথ ইশতেহার ঘোষণা করেন। সে অনুযায়ী ট্রানজিট, বিদ্যুৎ আমদানি, বাংলাদেশ থেকে ভারতের আমদানি উৎসাহিত করা, শুল্ক ও অশুল্ক বাধা কাটাতে বন্দর প্রতিবন্ধকতা দূর, রেল ও নৌপথে কনটেইনারে পণ্য পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি, ভারতের নেতিবাচক পণ্যের তালিকা ছোট করা, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটকে (বিএসটিআই) মানোত্তীর্ণ করার ব্যাপারে ভারতের সহায়তা, যৌথ বিনিয়োগ ও যৌথ উদ্যোগ উৎসাহিত করা, সাব্রুম-রামগড় ও ডেমাগিরি-থেগামুখ কাস্টম পয়েন্ট কার্যকর করা, অবকাঠামো উন্নয়ন, পাইলট ভিত্তিতে নির্বাচিত এলাকায় আরও সীমান্ত হাট স্থাপন এবং ভুটান-নেপাল থেকে পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাবন্ধ-ফুলবাড়ী স্থল শুল্ক বন্দরের জিরো পয়েন্টের ২০০ মিটার অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুই দেশ যৌথভাবে কাজ করার অঙ্গীকার করে।
এর মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে সমাধান হলেও ভারত, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট সম্পর্ক তৈরি, তিস্তা-সীমান্ত চুক্তিসহ বেশকিছু বড় সমস্যা রয়েই গেছে। গবেষকরা বলছেন, এসব সমস্যা সমাধানে দুই দেশের সরকার আন্তরিক হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এগোচ্ছে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।