মোহাম্মদ উদাসী বাউল, চিত্রশিল্পী মোহাম্মদ উদাসী বাউল । সবাই ডাকে বাউল বলে। গৃহবাসী বাউলরা কতটা ভবঘুরে হয় তা বাউল মোহাম্মদ জানে না, তবে সে নিজের মাঝে কোথায় যেন এক ধরনের বাউন্ডেলেপনা অনুভব করে। তার নাম বাউল বলে, নাকি অন্য কোন কারণে তাও সে বোঝে না। তবে সে তার নাম নিয়ে এক ধরনের গর্ব অনুভব করে।
কেউ যখন তার নাম শুনে থমকে ভ্রূ কুঁচকায় বা দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হতে চায় আসলেই তার নাম বাউল কি না ? তখন তার মনের গভীরে এক বিচিত্র ধরনের আনন্দানুভূতি হয়, আর বাবার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। বাবাইতো নামটা রেখেছেন।
বাউলের ছবি আঁকার হাতেখড়ি হয় প্রাইমারী পেরোবার আগেই, আর হাই স্কুল পেরোবার আগেই পোট্রেট আঁকাতে সে পটু হয়ে ওঠে । স্কুলের বন্ধুরা তাকে দিয়ে যে কত পোট্রেট আঁকিয়ে নিয়েছে সে হিসাব তার জানা নেই। তবে স্কুল জীবনে বাউল সব চেয়ে ভাল পোট্রেট করত স্যারদের।
তার অংক খাতার পাতায় পাতায় এক এক সারের এক এক ভঙ্গীতে পোট্রেট আঁকা থাকত। একদিন সব বন্ধুরা মিলে ঠিক করল, তার আঁকা স্যারদের পোট্রেট দিয়ে একটা প্রদর্শনী করবে। প্রদর্শনীর দর্শক হবে নিজেরাই। যেই ভাবা সেই কাজ, টিফিন পিরিয়ডে বাউলের খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ছিঁড়ে ক্লাস রূমের দেয়ালে টানানো হয়। ক্লাসের সবাই ঘুরে ঘুরে পোট্রেট দেখে আর পোট্রেটের নিচে নানা রকম মন্তব্য লেখে।
সে সব মন্তব্য নিয়ে সে কী হাসাহাসি। হাসতে হাসতে সেকেন্ড-বয় ফারুকতো বেঞ্চ নিয়ে উল্টে পড়ে, পড়ে তার হাসি আরো বেড়ে যায়, হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে আসে। সে খেয়াল করে না ততক্ষণে বাকি সবার হাসি খেমে গেছে। শুধু থামেই নি, ভয়ে কাঁপছে। সে চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে হেডস্যার ঘুরে ঘুরে পোট্রেটগুলো দেখছেন আর নিচের মন্তব্যগুলো পড়ছেন।
সাথে সাথে অন্যদের মত ফারুকের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। সবগুলো পোট্রেট দেখার পর হেডস্যার জিজ্ঞেস করেন, ‘কে একেঁছে ?’ কেউ কিছু বলে না। স্যার আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘কে একেছে ?’ এবার বাউল কাঁপা কাঁপ হাত তোলে। ‘ছবিগুলি খুলে দে,’ বলে হেডসার হাত পাতেন। বাউল একে একে সব ছবি খুলে হেডস্যারের হাতে দেয়।
হেডস্যার ছবিগুলো নিয়ে বলেন, ‘তোর ব্যাগ নে। ’ বাউল ব্যাগ নিয়ে ভীত পায়ে এসে হেডস্যারের সামনে দাঁড়ায়। এক হাতে ছবি ও অন্য হাতে বাউলকে ধরে,‘আয় আমার সাথে,’ বলে হেডস্যার বাউলকে টানতে টানতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যান। বেরিয়ে যাবার আগ মুহূর্তে বাউল সজল চোখে বন্ধুদের দিকে ফিরে তাকায়, ক্লাসের সবাই তখন ভয়ে কুঁকড়ে আছে, সম্ভবত আজই বাউলের শেষ দিন, টিসি দেয়ার আগে কী শাস্তি দেবে কে জানে ? জোড়া বেতের বাড়ি না নিলডাউন ?
হেডস্যার বাউলকে টানতে টানতে নিজের রূমে এনে টেবিলের সামনে দাঁড় করান। বাউলের দু’গাল বেয়ে অশ্রূ গড়িয়ে পড়তে থাকে।
হেডস্যার ছবিগুলো সব টেবিলে রেখে জোড়া বেত হাতে নিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে বলেন,‘এবার আমার একটা ছবি আঁক,’ বাউল হাঁ হয়ে যায়। হেডস্যার টেবিলে জোড়া বেতের বাড়ি মেরে ধমকে ওঠেন,‘আঁক !’ বাউল ভয়ে চমকে উঠে ব্যাগ থেকে দ্রুত খাতা পেন্সিল বের করে চোখ মুছতে মুছতে কাঁপা কাঁপা হাতে হেডস্যারের একটা পোট্রেট আঁকে। আঁকা শেষে হেডস্যার পোট্রেটার দিকে ঝাড়া তিন মিনিট তাকিয়ে থাকেন, তারপর উঠে বাউলের সামনে এসে জোড়া বেত নাচিয়ে নাচিয়ে বলেন,‘জোড়া বেতের একশোটা বাড়ি খাবি না আমাকে সাক্ষী রেখে আজ দুইটা পণ করবি ?’ বাউল বিস্মিত চোখে থাকে। ‘পণ করবি, এ জীবনে আর কোন দিন কোন স্যারের ছবি আঁকবি না, আর দুই নম্বর পণটা হলো, এইচএসসি পাশ করে সোজা চারুকলাতে ভর্তি হবি। ’ বাউল কিছু না বুঝেই দ্রুত মাথা ঝাঁকায়, মাথা ঝাঁকায় জোড়া বেতের বাড়ি থেকে বাঁচার জন্য।
‘যা তোর অপরাধ মাফ। ’
না বুঝে হেডস্যারকে দেয়া পণ দু’টা বাউল রেখেছে, সে জীবনে আর কোন দিন তার কোন স্যারের পোট্রেট করে নি। আর এইচএসসি পাশ করে ঢাকা ইউনিভার্সিটির চারুকলায় ভর্তি হয়েছে। বাবা প্রথমে রাজি হয় নি, তাঁর ইচ্ছা ছিল বাউল ডাক্তার হবে। কিন্তু বাউল একদিন তার মার একটা পোট্রেট বাবার হাতে দিয়ে বলে,‘বাবা দেখতো মার মত হয়েছে কি না ? আমি এঁেকছি।
’
বাবা পেট্রেটটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাকে ডেকে বলেন,‘তোমার ছেলে শিল্পী হতে চায় কিন্তু দেখো ও আমার সাথে ডিপ্লোম্যাসি করে !’
‘কী ডিপ্লোম্যাসি করেছে ?’ মা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে জিজ্ঞেস করেন।
‘তোমার ছবি দেখিয়ে আর্ট কলেজে পড়ার অনুমতি চায় !’ বাবা ছবিটা মার হাতে দেন।
মা ছবিটার দিকে দম বন্ধ করে তাকিয়ে হেসে বলেন,‘ দিয়ে দাও। ’
‘হ্যাঁ, এ ছবি দেখার পর অনুমতি না দেয়াটা মনে হয় ভুলই হবে। ’ ব্যাস হয়ে গেলো বাউল চারুকলায় ভর্তি।
মার পোট্রেটটা বাউল ভালই এঁকেছিল কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি চোখের জলে ভেজা কাঁপা কাঁপা হাতের হেডস্যারের ওই পোট্রেটার মত সুন্দর পোট্রেট বাউল আজ পর্যন্ত আর আঁকতে পারে নি।
তিন বছর হয় বাউল চারুকলা থেকে পাশ করে বেরিয়েছে। পাশ করার পর সে দু'টো অ্যাড ফার্ম থেকে চাকরির প্রস্তাব পেয়েছিল কিন্তু করে নি। সে তার বিকেলগুলো কাউকে দিতে চায় না। সারারাত বা সারাদিন যেমন তেমন বিকেলের স্নিগ্ধতায় সে চার দেয়ালে বন্দি থাকতে রাজি না।
বিকেল হলো জীবন দেখার সময়। জীবন দেখার উপযুক্ত সময় দিনে দু’বার। এক, দিন শুরুর সময়, আরেক রাত শুরুর সময়। দিন শুরুর সময় প্রকৃতিতে বড্ড তাড়া থাকে, কোথায় যেন যেতে হবে ? কী যেন করতে হবে ? তাই বাউল দিন শুরুর জীবন দেখে না, দেখে রাত শুরুর জীবন। যে জীবন স্নিগ্ধ, ধীর আর উদাস।
আর বিকেলের এই জীবন দেখতে পারবে না বলেই বাউল কোন চাকরিতে যোগ দেয় নি। স্বাধীন ভাবে কাজ করে। আর এই কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে মেতে থাকে চাঁদেরকণা সৃষ্টিতে।
চাঁদেরকণা তার সৃষ্ট এক নারীচরিত্র, এ চরিত্রটি কখনো জিন্স পরা কোন ধনীর দুলালী, কখনো গ্রামের চঞ্চল কিশোরী, কখনো বা গার্মেন্টেসের কোন সেলাইদিদিমনি। সে যখন চারুকলার প্রথম বর্ষের ছাত্র তখন চাঁদেরকণার প্রথম ছবিটা আঁকে, তারপর একে একে যে কত চাঁদেরকণা সে সৃষ্টি করেছে, তা সে নিজেই জানে না।
পাশ করার পর সেই সব থেকে বেছে বেছে কতগুলো ছবি নিয়ে একটা প্রদর্শনীও করেছিল।
প্রদর্শনীতে দেখতে আসা নানা জনে নানা কথা বলে, দু’একজন চাঁদেরকণার ইতিহাস জানতে চায়। বাউল হেসে ইতিহাস জানায়,‘আমি তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র, আমার মামার এক ব্যবসায়ী বন্ধু তাঁর কলেজে পড়ুয়া মেয়ের ছবি এঁেক দিতে বলেন। আমি খুশী মনে রাজি হই কিন্তু ছবি আঁকার সময় আমার যে কি হয় আমি বুঝতে পারি নি, কারণ ছবিটা আঁকা শেষে দেখা যায় ছবিটা ব্যবসায়ী কন্যার মত হয় নি, হয়েছে সম্পূর্ণ অন্য কারো মত। ছবিটা দেখে অবাক হয়ে যাই, বুঝতে পারি না আমি এ কার মুখ আঁকলাম ! এ মুখ আমি কোথায় দেখেছি ? চারুকলায় ? কারো বাসায় ? রাস্তায় ? না কি কোন বন্ধুর বোন ? অনেক ভেবেছি, নাহ ! এ মুখ আমি কোথাও দেখি নি।
এটা আজও আমার কাছে রহস্য, কেন এ ছবিটা আমি আঁকলাম ? যাই হোক, মামার পরিচিত সেই ব্যবসায়ী তাঁর মেয়ের আরেকটা ছবি এঁকে দিতে বলেন, আমি আর রাজি হই নি। নাম না জানা, অদেখা, অচেনা সেই মুখটি আমার ভাল লেগে যায়, আর সেই অচেনা অদেখা নারী চরিত্রটিই আমার চাঁদেরকণা। তারপর থেকে আমি মডেল বিহীন মেয়ের ছবি আঁকলে চাঁদেরকণাকেই আঁকি। ’
‘আপনি নাকি বিশ্বাস করেন, আপনার সাথে চাঁদেরকণার দেখা হবে ?’ পাশ থেকে একজন জানতে চায়।
বাউল হাসে,‘বিশ্বাস করার অর্থে বিশ্বাস করি না, করতে ভাল লাগে তাই করি।
আর যদি কখনো সত্যি সত্যি দেখা পেয়ে যাই, তাহলেতো....,’ বাউল কথা অসমাপ্ত রেখে একটা দুষ্ট হাসি দেয়। তার হাসি দেখে সবাই হাসে। হাসির মাঝেই একজন বলে,‘ছবির সাথেতো কোনটারই দাম লেখা নেই, ছবি বিক্রি হবে না ?’
‘না,’ বাউল হাসে,‘স্রষ্টা কখনো তার সৃষ্টিকে বিকায় না, যে বিকায় সে স্রষ্টা না কর্মকার। চাঁদেরকণা আমার কর্ম না, আমার সৃষ্টি। ’
ভিড়ের মাঝ থেকে অল্প বয়সী একজন টিপ্পনী কাটে,‘না বিক্রি করলে খাবেন কী ?’
বাউল আবার হাসে,‘যেটা কর্ম সেটা বিক্রি করব।
একজন শিল্পীর শিল্পকর্মের কিছু থাকে সৃষ্টি, বাকিগুলো কর্ম। দ্যা ভিঞ্চির “লাস্ট সাপার” ছিল তাঁর কর্ম আর “মোনালিসা” ছিল তার সৃষ্টি। আবারও বলছি চাঁদেরকণা আমার কর্ম না আমার সৃষ্টি। ’।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।