আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সামিটের জালে ১০৫ একর জমি

সামিট গ্রুপের বেড়াজালে আটকা পড়েছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকার পাঁচ তারকা ও তিন তারকা হোটেলসহ শপিং কমপ্লেঙ্, গলফ কোর্স ও কান্ট্রি ক্লাব। নানা অজুহাতে ব্যবসায়িক এ প্রতিষ্ঠানটি আটকে রেখেছে সিভিল এভিয়েশনের ১০৫ একর জমি। অন্যদিকে ১৪ বছর ধরে সিভিল এভিয়েশনের ওই জমিতে অর্ধনির্মিত ভবন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে; যা বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে সব নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা অনিয়মের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে রেজিস্ট্রেশনকৃত কোম্পানি ইপকোকে লিজ দেওয়া হয় সিভিল এভিয়েশনের ১০৫ একর জমি।

এ জমি লিজের বিরুদ্ধে মহাজোট সরকারের বিমান মন্ত্রণালয় সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইপকো মহাজোট সরকারের প্রথম বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খানের ভাই আজিজ খানের সামিট গ্রুপের কাছে কোম্পানি ইপকোর সিংহভাগ মালিকানা বিক্রি করে দেয়। এর পর থেকেই লিজ বাতিলের বারবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আর কার্যকর হয় না। সূত্র জানায়, মহাজোট সরকার আমলের মাঝামাঝিতে কর্নেল (অব.) ফারুক খানকে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ায় তোলপাড় শুরু হয়। বিমানবন্দরের জমি রক্ষা হওয়া নিয়েই দেখা দেয় সংশয়।

মারাত্দক অনিয়মের মাধ্যমে বিমানবন্দরের মহামূল্যবান এ সম্পত্তির লিজ কেলেঙ্কারির সঙ্গে সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খানের পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপ জড়িয়ে পড়ায় রাষ্ট্রীয় এ সম্পত্তি উদ্ধার করা সম্ভব হবে কি না_ এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এভিয়েশন বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসংলগ্ন স্থানে এভাবে ১৪ বছর ধরে নির্মাণকাজ ফেলে রেখে তারা একদিকে পর্যটকদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন, অন্যদিকে সরকারকেও আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। এ জায়গাটির পুবে বিমানবন্দরের প্রবেশপথ, দক্ষিণে বিমানবন্দরের টার্মিনাল, কার পার্কিং ভবন, উত্তরে বড় সড়ক এবং পশ্চিমে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয় ও কার্গো ভিলেজ। এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে এভাবে বছরের পর বছর ফেলে রেখে প্রভাবশালী ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে জমি আত্দসাতের অভিযোগ উঠেছে। সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তারা বলছেন, সর্বশেষ সমঝোতা বৈঠক অনুযায়ী ১০৫ একর জমি সিভিল এভিয়েশন অথরিটিকে বুঝিয়ে দেওয়া, মামলা প্রত্যাহার ও ১৪ একর জমিতে পাঁচ তারকা হোটেলসহ শপিং কমপ্লেঙ্ নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেরও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

বরং এ ক্ষেত্রেও নতুন নতুন জটিলতা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকল্পের নির্মাণকাজ আরও দীর্ঘসূত্রতার বেড়াজালে আটকে ফেলা হচ্ছে। এসব কারণে অনেকের মনে সংশয়, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের অন্য কয়েকটি প্রকল্পের মতো এ কাজটিও চিরস্থায়ীভাবে ঝুলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

জানা যায়, ন্যাম সম্মেলন সামনে রেখে ১৯৯৯ সালে তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশপথের পুব ও পশ্চিম পাশে ১৪৪ দশমিক ৮০ একর (৪৩৪ বিঘা) জমির ওপর একটি পাঁচ তারা হোটেল, একটি তিন তারা হোটেল, একটি কান্ট্রি ক্লাব ও এশিয়ার সর্ববৃহৎ ১৮ হোলবিশিষ্ট গলফ মাঠ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে এ জমি জরুরি ভিত্তিতে হোটেল, কান্ট্রি ক্লাব ও গলফ কোর্স নির্মাণের জন্য লিজ নিয়ে কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়। তখন সাতটি দেশ দরপত্রে অংশ নিলেও সিঙ্গাপুরে নিবন্ধনকৃত বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন কোম্পানি ইপকো ইন্টারন্যাশনালকে কাজটি দেওয়া হয়।

ওই সময় মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ফ্রান্সের তিনটি কোম্পানি ৪০ বছরের জন্য লিজ নিয়ে সরকারকে প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন বিমানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠদের প্রতিষ্ঠান ইপকো ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ একটি অস্বচ্ছ ও অসম চুক্তি সম্পাদন করে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তৎকালীন প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা, সে জমি লিজ দিয়ে সরকার ৬০ বছরে পাবে মাত্র ১০৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। কোনো প্রকার জরিপ, সম্ভাব্যতা যাচাই বা সমীক্ষা না করে এবং সরকারি আইন, নিয়ম-কানুন ও বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে গোপনে কাজটি ইপকোকে প্রদানের সব ব্যবস্থাই চূড়ান্ত হয়। চুক্তির শর্তে বলা হয়, লিজ বাবদ বছরে ৩ লাখ ২৫ হাজার মার্কিন ডলার ভাড়া এবং মোট বিক্রির দেড় শতাংশ আয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে (বেবিচক) ৬০ বছরে সর্বমোট টাকার অঙ্কে ১০৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা পরিশোধ করবে।

কিন্তু তখন এসব প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। ২০০০ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন ও বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ আইনি মতামতের জন্য ফাইলটি অ্যাটর্নি জেনারেলের দফতরে পাঠান। তখন সিদ্ধান্ত হয়, এ অসম চুক্তিটি বাতিল করতে হবে।

বিএনপির আমল : বিএনপি জোট ২০০১ সালের শেষ দিকে ক্ষমতায় বসেই সরকারের প্রভাবশালীরা লিজগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান ইপকো ইন্টারন্যাশনালের লোকজনের দ্বারা 'ম্যানেজড' হয়ে যান। ইপকো এ-দেশীয় কয়েকজন ব্যবসায়ীর গড়া কোম্পানি, যা শুধু সিঙ্গাপুরে রেজিস্ট্রেশনকৃত।

এ কোম্পানির সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপ সামিটের কর্ণধার সরাসরি জড়িত এবং তিনিই বিএনপি সরকারকে ম্যানেজ করেন বলে জানা যায়। ফলে অদৃশ্য হাতের ছোঁয়ায় তড়িঘড়ি করে বাতিল মতামতের ফাইলটি রাতারাতি ইপকোর পক্ষে চলে যায় এবং চুক্তি অনুযায়ী ইপকোকে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়।

কার্যাদেশ পেয়েই ইপকো বিমানবন্দরের প্রবেশপথের পশ্চিম দিকে বনজ ও ফলদ গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ এলাকাটি টিন দিয়ে ঘিরে ফেলে। বিমানবন্দরে প্রবেশমুখের পশ্চিম পাশে বিশাল সাইনবোর্ড টানিয়ে লেখা হয়_ ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট, হলিডে ইন হোটেল অ্যান্ড শপিং অর্কিং ইত্যাদি। ২০০১ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে সব নির্মাণকাজ শেষ করার কথা থাকলেও তারা দু-তিনটি ভবনের দু-তিন তলা পর্যন্ত স্ট্রাকচার নির্মাণ করেই কাজ বন্ধ করে দেয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার : ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রায় দেড় বছর এ-সংক্রান্ত ফাইলটি গোপন রাখা হয়েছিল। পরে ফাইলটি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হলেও মন্ত্রণালয়, বেবিচক ও ইপকোর লোকজন পরস্পর যোগসাজশে নানা মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে। তখন বলা হয়, 'এটি একটি অস্বচ্ছ ও অসম চুক্তি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ সম্পাদন না করার জন্য ইপকোর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা যেতে পারে। '

মহাজোট সরকার : আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান জাতীয় পার্টির জি এম কাদের।

মন্ত্রী পুরো বিষয়টি তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য যুগ্ম-সচিব ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন। ওই তদন্ত কমিটিও দুই দফায় সময় বৃদ্ধি করে মূল চুক্তির খুঁটিনাটি, চুক্তির শর্ত, সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন, ইপকো কর্তৃপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ ও সব কিছু বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়_ এ চুক্তি অসঙ্গতিপূর্ণ, অস্বচ্ছ, অনিয়মে পরিপূর্ণ ও প্রতারণামূলক। অবিলম্বে এ চুক্তি বাতিল করার জন্য কমিটি সুপারিশ করে। তবে আনুষ্ঠানিক রিপোর্ট জমা দেওয়ার আগে ইপকো হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে। হাইকোর্ট এর আলোকে রুলনিশি জারি করেন।

রুলে ইপকোকে না শুনে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয় সিভিল এভিয়েশনকে। সূত্র জানায়, ২০১২ সালের আগস্টে সংসদীয় কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইপকোর সঙ্গে চুক্তিপত্র বাতিলের ঘোষণা দেয় বিমান মন্ত্রণালয়। তবে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ইপকোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে সমঝোতা বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বিমানমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির সভাপতির বিশেষ আগ্রহের কারণেই ইপকোর সঙ্গে সমঝোতা বৈঠকে বসে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে। ওই বৈঠকে নতুন করে নির্মাণকাজের একাংশ আবারও ইপকোর অনুকূলে প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কথিত সমঝোতা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ইপকো ১৯৯৯ সালে লিজ নেওয়া জমি থেকে ১০৫ একর সিভিল এভিয়েশনকে ফেরত দেবে এবং আদালতে করা মামলাও প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু সেই জমি ফেরত পায়নি সিভিল এভিয়েশন। হয়রি কোনো পাঁচ তারকা হোটেলও। অন্যদিকে, সিভিল এভিয়েশন ১৪ একর জায়গার ওপর ইপকো কর্তৃক শুধু একটি পাঁচ তারকা হোটেলসহ শপিং কমপ্লেঙ্ নির্মাণের ব্যাপারে নতুনভাবে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কথা। কিন্তু সমঝোতা বৈঠকটিতে উভয় পক্ষের বিশদ আলোচনা সত্ত্বেও বহুমূল্যবান ২৮ একর জমির বিষয়টি অমীমাংসিত অবস্থায় ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

বিমানবন্দরের প্রবেশদ্বারসংলগ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ওই জমি ইপকো ব্যবহার করবে, নাকি সিভিল এভিয়েশনের অনুকূলে থাকবে_ এ নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন জটিলতা।

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।