আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুসাহিত্যিক হবার পূর্ব শর্ত



ছোট মুখে বড় কথা মানায় না। আমার মুখেও তেমনি দেশের একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের সমালোচনা করা মানায় না। তবু একজন পাঠক হিসেবে সেই লেখকের লেখা সম্পর্কে আমার খটকার কথা লিখছি। প্লিজ কেউ ভেবে বসবেন না আমি মাতবরি করার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছি।
জনাব সাহিত্যিক (নাম বলতে চাচ্ছি না) তাঁর ফেসবুক পেজে একুশের বইমেলা উপলক্ষ্যে তাঁর সদ্য প্রকাশিত একটি উপন্যাসের অংশবিশেষ তুলে দিয়েছেন।

সেখানে একটি গার্মেন্টস কর্মীর নিজের মাকে লেখা চিঠি প্রকাশ করেছেন। খুবই আবেগপূর্ণ সেই চিঠিতে একটি গার্মেন্টস কর্মীর সংগ্রামময় জীবন নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। চিঠিটি পড়লে সাধারণ পাঠকের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠতে বাধ্য। আরও খারাপ লাগে যখন জানা যায় চিঠিটি মেয়েটার মায়ের কাছে কখনও পৌছে না। কারণ চিঠিটি উদ্ধার করা হয় হাসপাতালে গার্মেন্টস কর্মীটির লাশের পাশ থেকে।


খটকার কারণ স্রেফ চিঠিটির ভাষা। একজন গার্মেন্টস কর্মী এত সুন্দর ভাষায় তাঁর মাকে চিঠি লিখতে পারবেন না। অসম্ভব একটি ব্যপার। চিঠির ভাষা পড়েই মনে হয় পত্র লেখকের লেখার হাত বেশ ভাল। ভাষার উপর তাঁর ভালই দখল আছে।

এবং মাঝে মাঝেই সুসাহিত্যিকের মতই উপমা টানার অভ্যাসও আছে। একজন গার্মেন্টস কর্মীর এইসব গুণ থাকা অবাস্তব ব্যপার। বস্তিতে থেকে, দিনে বারো চৌদ্দ ঘন্টা কাজ করে, জীবনের প্রবল স্রোতে কোনরকমে নাক ভাসিয়ে রাখায় সংগ্রামরতা একজন স্বল্পশিক্ষিতা নারীর পক্ষ্যে সাহিত্যচর্চা করা অকল্পনীয় বিষয়। তাই চিঠিটি পড়েই এর কৃত্রিমতা বুঝে ফেলা যায়। তখন আর চোখে পানি আসেনা।

আবেগটা নষ্ট হয়ে যায়।
একই লেখকের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা একটি বই পড়তে গিয়েও আমার খটকা লেগেছিল। সেখানে বর্ণনা করা হয়েছিল তরুণী মেয়েদের পাকিস্তানি মিলিটারী ধরে ধরে নিয়ে ছাদের সাথে উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখেছিল। মেয়েদের সাথে থাকা বই পত্র দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এরা সবাই স্কুল কলেজগামী ছাত্রী, স্কুলের পথ থেকে উঠিয়ে আনা হয়েছে।
একাত্তুরের মার্চ-এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে যা চলছিল, তাকে এককথায় প্রকাশ করতে গেলে বলতে হবে "কেয়ামত!" কেয়ামতের দিনে কোন বাঙ্গালী তরুণী মেয়ে বই খাতা পেনসিল নিয়ে স্কুলে পড়তে যাবে, এ কথা কী করে বিশ্বাস করি? আমি নিশ্চিত লেখক অন্য কোথাও পড়েছেন এ সম্পর্কে, পড়ে যাচাই না করেই নিজের বইয়ে তুলে দিয়েছেন।


পরে দেখি শুধু আমারই নয়, একই খটকা হুমায়ূন আহমেদেরও লেগেছিল। তিনি তাঁর জোছনা ও জননীর গল্প উপন্যাসের শুরুতে খুবই বিরক্তির সাথে এই খটকার কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, "জাতি হিসেবে আমরা অতিকথন পছন্দ করি!"
স্যারের সাথে আমার আরেকটা জায়গায়ও একইরকম খটকা লেগেছিল।
কিছু ডায়েরী ধরনের লেখা পড়ে মনে হয়েছে এই ডায়েরী একাত্তুরের সেই দিনেই লেখা হয়নি। নিশ্চই পরবর্তীতে তারিখ মিলিয়ে স্মৃতির উপর ভরসা করে লেখা হয়েছে। কারন লেখককে যেসব ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, স্টিলের নার্ভ থাকলেও সমসাময়িকভাবে এসব ঘটনার বর্ণনা দেয়া অসম্ভব একটি ব্যপার।

গজবের দিনে ডায়েরী লেখার কথা মাথায় থাকেনা। আর তাছাড়া ডায়েরী যতই এগুতে থাকে, বুঝা যায় সেই গল্পের নায়ক কে। ভবিষ্যতে কী ঘটতে চলেছে তা আগে থেকে না জানা থাকলে কী করে ডায়েরী লেখক বুঝে গেলেন 'অমুকই' হতে চলেছেন গল্পের নায়ক?
পাঠক হিসেবে লেখকদের একটা বিষয় সাজেস্ট করতে চাই। গল্প লেখার সময় শুধুই চরিত্রের উপর মনোযোগ দিন। যুক্তিহীন কিছু লেখার চেষ্টা করবেন না।

আবেগ আনতে চাইলে ভিন্নভাবেও আনা যায়। লেখা যতটা বাস্তবঘেষা হবে, পাঠকের মন তত বেশি ছুঁয়ে যাবে। শুদ্ধতম আবেগ এমনিতেই আকর্ষনীয়। এতে বাড়তি রং চড়ানোর কোন প্রয়োজন নেই। যেমনটা সুন্দর মুখশ্রীতে মেকাপ না দিলেও দেখতে সুন্দর লাগে।

মেকাপ বেশি হয়ে গেলেই বরং "প্লাস্টিক" বলে কৃত্রিম মনে হয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।