স্বাধীনতা, সে তো আমার প্রিয় মানুষের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কেনা
যদিও উত্তর কোরিয়ার নাম ‘গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কোরিয়া’ তথাপি উত্তর কোরিয়া আদৌ কোনো গণতান্ত্রিক রাস্ট্র নয়। সেখানে নেতৃত্ব বদল হয় কিম পরিবারের হাত ধরে ও দেশটি শাসন করে শুধুমাত্র ওয়ার্কাস পার্টি। দেশটির পার্লামেন্ট আছে। পার্লামেন্টের অধিবেশন বছরে মাত্র দুবার বসে এবং দুই অধিবেশনকালের স্থায়িত্বকাল মাত্র দশদিন। পার্লামেন্টের কাজ শুধু সুপ্রিম লিডার নির্বাচিত করা যিনি ন্যাশনাল ডিফেন্স কমিশনেরও চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম লিডারের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলির অনুমোদন ও নতুন বাজেট অনুমোদন করা-এছাড়া পার্লামেন্টের আর কোনো কাজ নেই।
পার্লামেন্ট গঠিত হয় পাঁচ বছরের জন্য ৬৮৭ জন সংসদ সদস্য দ্বারা । তবে উত্তর কোরিয়ায় যেহেতু শুধুমাত্র ওয়ার্কাস পার্টির শাসন বিদ্যমান সেহেতু সেখানে সংসদ নির্বাচনে শুধুমাত্র ওয়ার্কাস পার্টির নেতৃত্বে Democratic Front for the Reunification of the Fatherland থেকেই প্রার্থী হয় এবং প্রতি আসনে একজন করে প্রার্থী থাকে আর সংসদ নির্বাচনের সময় সারাদেশ থেকে প্রার্থীতা আহবান করা হয় । সকল প্রার্থীতা যাচাই বাছাই করে প্রতি আসনে মাত্র একজন করে প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেওয়া হয়। ভোটারকে অনেকটা হ্যাঁ অথবা না এর মত করে ভোট প্রদান করতে হয় যেহেতু প্রতি আসনে প্রার্থী একজন করে থাকে। যদি ভোটার প্রার্থীকে পছন্দ না করেণ তাহলে তিনি প্রাথীর ছবিতে ক্রস চিহ্ন দিয়ে প্রার্থীর প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করতে পারেণ।
অবশ্য এই কাজটা প্রকাশ্যেই করতে হবে-কারণ উত্তর কোরিয়ায় ভোট প্রদান কোনো গোপনীয় বিষয় নয়। এরকম অবস্থায় কারো বাবার সাধ্য নেই যে ক্ষমতাসীন ওয়ার্কাস পার্টির প্রার্থীকে ক্রস চিহ্ন দিয়ে অনাস্থা প্রকাশ করে এবং না ভোট প্রদান খুবই ঝুকিপূর্ণ কাজ ! উত্তর কোরিয়ার সর্বশেষ সংসদ নির্বাচন হয় গত ২০০৯ সালে। সরকারী ঘোষণা অনুসারে এই নির্বাচনে ৯৯.৯৮% ভোটার টার্নআউট হয়েছিল এবং প্রতি প্রার্থী ১০০% ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিল!
কিম ইল সাং ক্ষমতা সংহত করতে যুক্তরাস্ট্রের বিরুদ্ধে দৃড় অবস্থান গ্রহন করেছিলেন। তিনি অভিযোগ করেছিলেন যুক্তরাস্ট্র উত্তর কোরিয়ার জনগণের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে দিচ্ছে ও সেই রোগ নির্মূল করতে তিনি হাজার হাজার লোককে কারাগারে নিক্ষেপ করে বিচার ছাড়াই রাতারাতি তাদের অদৃশ্য করে দিতেন। শাসনযন্ত্রের কারো কোনো ত্রুটি ধরা পড়লে তিনি দ্রুত তাকে সামরিক আইনে বিচার করে ফায়ারিং স্কয়াডে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতেন।
তবে কিম জং ইলের সময় এই প্রক্রিয়ায় একটু ঢিলেমি দেওয়া হলেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের কারা অন্তরীণ করা বন্ধ থাকেনি, কিন্তু কিম জং উনের শাসনকালে তা আবার নতুন করে শুরু হয়েছে।
বাবা কিম ইল সাংয়ের মত কিম জং ইল ২০১১ সালে হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান । হাজার হাজার লোকের অশ্রুসিক্ত নয়নে তাদের দুজনের শেষ কৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল। উত্তর কোরিয়ার রাস্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমে তখন বলা হয়েছিল তাদের সুপ্রিম লিডারের মৃত্যুতে শুধু জনগণ নয় দেশের পশু পাখিও ক্রন্দন করতেছিল ! .
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দমন শুরু হয় উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল সাংয়ের আমল থেকেই । সেই ১৯৫০ এর দশকে কি ইল সাং নিজের ক্ষমতা সুসংহত, চিরস্থায়ী ও কমিউনিস্ট শাসন ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে দেশটিকে বিশুদ্ধকরণের ঘোষণা দেন।
তিনি বলেছিলেন যুক্তরাস্ট্র উত্তর কোরিয়ার জনগণের মধ্যে ভিন্নমতাবলম্বী রোগ ছড়িয়ে দিচ্ছে ও সেই রোগ নির্মূল করতে তিনি হাজার হাজার লোককে কারাগারে নিক্ষেপ করে বিচার ছাড়াই রাতারাতি তাদের অদৃশ্য করে দিতেন। শাসনযন্ত্রের কারো কোনো ত্রুটি ধরা পড়লে তিনি দ্রুত তাকে সামরিক আইনে বিচার করে ফায়ারিং স্কয়াডে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতেন। ঐতিহাসিক এন্ড্রেই ল্যানকভ এই ঘটনাকে কোরিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন ও বৃহৎ রাজনৈতিক বিচার বলে অ্যাখ্যায়িত করেণ। তিনি অনেক তরুণ ও সম্ভবনাময় নেতাকেও হত্যা করেণ আর অবশিষ্ট রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্বাসনে যেতে বাধ্য করেণ। ১৯৫৩ সালেই তিনি তার ১০ জন রাজনৈতিক সহচররের মৃত্যুদন্ড দেন, এর দুই বছর পর অন্যতম কমিউনিস্ট নেতা পাক হং ইয়ংকে আত্মসাৎ করা টাকায় বিলাসবহুল জীবন যাপন ও আমেরিকার পা চাটা কুকুর অ্যাখ্যায়িত করে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।
১৯৫৬ সালে ওয়ার্কাস পার্টির কেন্দ্রয়ি কমিটির সভায় দুটি গ্রুপের নেতারা পার্টির নীতির সমালোচনা করায় তাদের কাউকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় ও অন্যদের নির্বাসনে পাঠানো হয়। এই প্রক্রিয়া কিম ইল সাং ১৯৬০ এর দশক পর্যন্ত চালিয়ে যান নিজের ক্ষমতা সুসংহত ও নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত। যদিও উত্তর কোরিয়ায় এই প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত চলমান আছে তারপরেও কিম ইল জাং এই ক্ষেত্রে তার পূর্বসুরি বাবাকে ঠিকমত অনুসরণ না করলেও তিনিও কম ছিলেন না। পাক নাম কি ছিলেন উত্তর কোরিয়ার একজন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ । তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার, কিন্তু দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার অভিযোগে তাকে তার দপ্তর থেকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যেয়ে দ্রুত ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
২০০৭ সালে উত্তর কোরিয়ার এক কারখানার মালিক ও তার ছয় সহযোগীকে জনসমক্ষে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল একটি স্টেডিয়ামে এই অভিযোগে যে তিনি দেশের আইন ভঙ্গ করেছিলেন। ২০১০ এর আর একটি ঘটনা হলো এরকম- উত্তর কোরিয়ার এক তরুণ তার দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থানরত ভিন্ন মতাবলম্বী ( Dissident) এক বন্ধুকে নিজ দেশের দুর্দশার কাহিনী মোবাইল ফোনে বর্ণনা করে ও এরপর আইন শৃঙ্খলার বাহিনী তার বাসা রেইড করে তাকে তুলে নিয়ে যেয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে। এভাবে তিনি অনেককে হত্যা ও গুমও করেছেন তিনি কিন্তু কিম ইল জাংয়ের মৃত্যুর পর তারা পুত্র কি জং উন এক্ষেত্রে শুধু বাবা নয় তার পিতামহকেও ছাড়িয়ে গেছেন!
কিম জং উনের সাথে তার নিজ ফুপা জ্যাং সং থায়েক । ( ডানে উন ও বামে জ্যাং সং থায়েক)
কিম জং ইল গত ২০১১ সালে মারা যান তখন কি জং উনের বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। সম্ভবত বাবা কিম জং ইল তার তিন ছেলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছেলে কিম জং উনের মুখেই তার বাবা কিম ইল সাংয়ের বৈশিষ্ট্য দেখতে পেয়েছিলেন বলেই উনকেই তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করেণ।
অনেকেই ভেবেছিলেন উনের শাসনামলে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে সম্পর্ক হয়তো স্বাভাবিক হবে ও দুই কোরিয়ার একত্রিতকরণ ত্বরান্বিত হতে পারে, কিন্তু রাজনীতিতে আনকোড়া উন তার পিতামহকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। রাজনীতিতে আনকোড়া উনকে ক্ষমতা সুসংসহত করতে পুরোপুরি সহায়তা করেণ তার ফুপা( Uncle) ও তার রাজনৈতিক গুরু জ্যাং সং থায়েক। এই জ্যাং সং থায়েক ছিলেন তার বাবা কিম জং ইলেরও দক্ষিণ হস্ত। উনের শাসনামলে জ্যাং সং থায়েককে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা বলে মনে করা হত। অবশ্য রাস্ট্রীয় টেলিভিশন, প্রচারযন্ত্র, বিভিন্ন সভা সমিতিতে সুপ্রিম লিডার কিম জং উনের ডান পাশে সবসময় জ্যাং সং থায়েককে দেখা যেত।
এজন্য জ্যাং সং থায়েককে উনের অভিভাবকও মনে করা হত অনেকটা মোঘল বাদশাহ আকবরের বৈরাম খানের মত, কিন্তু বৈরাম খানের চেয়েও কঠিন ও লোমহর্ষক ভাগ্য অপেক্ষা করছিল উনের ফুপা জ্যাং সং থায়েকের। উত্তর কোরিয়ার সরকারে ও রাজনীতিতে দিন দিন প্রভাবশালী হয়ে ওঠা তার জন্য হয়েছিল কাল। হয়তো উন নিজের ক্ষমতা সুসংহত ও পাকাপোক্ত করার নিমিত্তেই তার আপন ফুপাকে ওয়ার্কাস পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পলিটিক্যাল ব্যুরোর মিটিং থেকে প্রকাশ্যেই গ্রেফতার করে সামরিক আইনে দ্রুত বিচার করে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় গত ১২ ডিসেম্বরে। উত্তর কোরিয়ায় এই প্রথম রাস্ট্রীয়ভাবে কোনো মুত্যুদন্ডের সংবাদ প্রচার করা হয়েছে।
ওয়ার্কাস পার্টির পলিট ব্যুরোর কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং থেকে জ্যাং সং থায়েক গ্রেফতার করার দৃশ্য !
চীনের একটি পত্রিকা প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে জ্যাং সং থায়েককে বিবস্ত্র করে ১৫০ টি ক্ষুধার্ত কুকুরের সামনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল এবং জ্যাং এর দেহ ক্ষুধার্ত কুকরের দাঁতে ছিন্ন ভিন্ন না হওয়া পর্যন্ত সরকারী কর্মকর্তাগণ নাকি দাড়িয়ে দাড়িয়ে তা উপভোগ করেছিল ! স্পষ্ট বার্তা গেল শাসকের পক্ষ থেকে, উত্তর কোরিয়ায় শাসক পরিবারের বিষদৃষ্টিতে পড়ার অর্থ নিছক মৃত্যু নয়, যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু!! অবশ্য উত্তর কোরিয়ার রাস্ট্রীয় টেলিভিশন ও সংসবাদপত্র জ্যাংকে কুকরের চেয়ে অধম বলে উল্লেখ করেছিল।
কীটাণুকীট’ ও ‘কুকুরের চেয়ে অধম’ বলে উল্লেখ করেছিলেন উন নিজেই৷ জ্যাং এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল ’অ-কমিউনিস্ট সুলভ’ বিলাসবহুল জীবন যাপনের, তিনি দেশকে অস্থিতিশীল ও ক্ষমতা দখল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। চীনের ঐ পত্রিকার রিপোর্টটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে উত্তর কোরিয়া রাস্ট্রীয়ভাবে ঐ সংবাদের কোনো প্রতিবাদ করেনি যদিও উত্তর কোরিয়ার এক রাস্ট্রদুত ক্ষুধার্ত কুকুরের সামনে জ্যাং থায়েককে ছেড়ে দেওয়া খবর নাকচ করেছেন। চীন হলো উত্তর কোরিয়ার একমাত্র বন্ধুপ্রতিম রাস্ট্র। জ্যাং সং থায়েক উত্তর কোরিয়াকে চীনের আদলেই গড়তে চেয়েছিলেন ও উত্তর কোরিয়ার প্রশাসনের মধ্যে চীনের সাথেই জ্যাং এর ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। চীন অবশ্য জ্যাং এর মৃত্যুদন্ডে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল ও ধারণা করা হচ্ছে জ্যাংয়ের মৃত্যুদন্ডে উত্তর কোরিয়ার উপর চীন ক্ষুব্ধ হয়েছে।
তারপরেও উত্তর কোরিয়া চীনের যতই অবাধ্য হোকনা কেন উত্তর কোরিয়ায় যে বিপুল পরিমাণ লোহা, ম্যাগনেসাইট, তামা ও অন্যান্য খনিজ সম্পদের মজুত রয়েছে, সেসবের প্রতি চীনের প্রবল আগ্রহ আছে। এছাড়াও উত্তর কোরিয়ার অবাধ্য অচরণ চীনকে আরো নানা কারণে হজম করতে হয়। এর মধ্যে আর একটি কারণ চীনও যদি যুক্তরাস্ট্রের মত উত্তর কোরিয়ার প্রতি বৈরি হয় তাহলে উত্তর কোরিয়া তার প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে একিভুত হয়ে যেতে পারে যা চীনের জন্য সত্যিই উদ্বেগজনক। জ্যাং সং থায়েককে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার কারণ যাই থাক, সরকারের দ্বিতীয় প্রধান ক্ষমতাবানকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে নি:সন্দেহে কিম জং উন তার ক্ষমতাকে সুসংসত করেছেন। শুধু জ্যাং সং থায়েক নয়, এই জ্যাং সং থায়েকের মৃত্যুদন্ড দেওয়ার আগে শাসকের প্রতিহিংসার বলি হয়েছেন তার ঘনিষ্ঠ আরও আট জন৷ বিমানঘাতী কামানের গুলিতে ঝাঁঝরা করা হয়েছিল আট সঙ্গীর দেহ !!!
সামরিক আদালতে জ্যাং সং থায়েককে বিচারের জন্য উপস্থিত করানো হয়েছে।
উন তার বাবার বিশ্বস্ত নেতা ও কর্মচারীদের অনেকেকেই নিমূল করেছেন ও কাউকে গুম করেছেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রি ইয়ং হো, কিম ইয়ং চুন, ইউ টং চুক, কিম জং গ্যাক। এরা সকলেই ছিলেন প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বাবার আমলের বিশ্বস্ত সঙ্গী, কিন্তু এদের মধ্যে কাউকে মৃত্যুদন্ড যেমন দেওয়া হয়েছে তেমনি কেউ নিখোজ অবস্থায় আছেন। উনের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ আছে তার সাবেক এক গার্লফ্রেন্ডকে ও তঁর কয়েকজন সঙ্গীকে মেশিন গান দ্বারা হত্যার। আর উত্তর কোরিয়ায় রাজনৈতিক হত্যা, গুম, খুন তো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যপার।
তবে দেশটিতে খুব গোপনীয়তা ও কঠোরতা অবলম্বন করা হয়। উত্তর কোরিয়ার ভিতরের নিউজ বাইরের বিশ্বে খুব কম পাওয়া যায়। এমনকি উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতারাও তেমন বিদেশ সফর করেণ না । যেমন কিম জং ইল তার দীর্ঘ ১৮ বছরের শাসনামলে একবার করেই মাত্র তিনটি দেশ সফর করেছিলেন। আর উন ২০১১ তে ক্ষমতাসীন হলেও ২০১২ তে চীন সফরে গিয়েছিলেন এবং উন সেসময় অভিযোগ করেছিলেন যুক্তরাস্ট্র তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু যুক্তরাস্ট্র সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
তবে দেশটির স্বনির্ভরতার নীতি, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতার জন্য নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবিদার যা পুর্বেই আলোচনা করছি। অবশ্য উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে নেতিবাচক বেশিরভাগ রিপোর্ট আসে প্রতিবেশী দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদ মাধ্যম থেকে। তাই অনেক সময় ঘটনাগুলি কি পরিমান নেতিবাচক তার সত্যতা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। আর মার্কিন যুক্তরাস্ট্র যে রাস্ট্রটির শাসন ব্যবস্থা উৎখাত নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখে সেই রাস্ট্রটির কোনো ঘটনাকে মার্কিন সংবাদ মাধ্যম তিলকে তো তাল করবেই । তবে উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা ও একদলীয়, পারিবারিক শাসন ব্যবস্থার কারণে উত্তর কোরিয়ার মানবাধিকার রিপোর্ট সন্তোষজনক নয়।
জাতিসংঘের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উত্তর কোরিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘণকারী রাস্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার নেতাদেরকে বিচারের কাটগোড়ায় দাড় করাতে আহবান জানিয়েছে অবশ্য চীন এক্ষেত্রে অগ্রিম হুমকি দিয়ে রেখেছে যে উত্তর কোরিয়ার নেতাদের বিচারের কোনো প্রস্তাব জাতিসংঘে উত্থাপন হলে চীন তাতে ভেটো দেব।
রাস্ট্রীয় টেলিভিশনে জ্যাং সং থায়েকেরে বিচারের দৃশ্য প্রচার করা হচ্ছে।
সবার এটা মনে রাখা উচিৎ যে রাস্ট্রযন্ত্র ( Regime) ও রাস্ট্র ( State) দুটোই আলাদা প্রতিষ্ঠান । রাস্ট্রের সমালোচনা করা অবশ্যই দেশদ্রোহীতা ( Sedition) কিন্তু রাস্ট্রযন্ত্রের আলোচনা ও সমালোচনা করা প্রত্যোকটি নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার,কিন্তু কমিউনিজম, থিওক্রাসি, রাজতন্ত্রে রাস্ট্র ও শাসনযন্ত্রকে এক করে দেখা হয়-ভিন্নমতকে সেখানে কোনোক্রমেই সহ্য করা হয় না। মধ্যযুগে তো থিওক্রাসি ও রাজতন্ত্রের ছিল জয়জয়কার ! ইসলামিক খেলাফত শাসন ব্যবস্থা, চার্চ কর্তৃক শাসন, বর্তমানে ভ্যাটিক্যান সিটির শাসন ব্যবস্থা, আফগানিস্থানের তালেবান শাসনকাল ইত্যাদি থিওক্রাসি নির্ভর শাসন ব্যবস্থা।
থিওক্রাসির শাসন ব্যবস্থা হলো ঈশ্বর কর্তৃক শাসন। সেখানে শাসনকর্তার নির্দেশ অমান্য করা মানে ঈশ্বরের নির্দেশ অমান্য করা আর ঈশ্বরের নির্দেশ অমান্য করার শাস্তি মৃত্যুদন্ড ছাড়া আর কি হতে পারে ? ইসরায়েল রাস্ট্রটির ভিত্তিই হলো থিওক্রাসি যদিও ইসরায়েলে সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান, কিন্তু শাসন ব্যবস্থা প্রণীত হয়েছে একটি নির্দিষ্ট আদর্শকে সামনে রেখে তা হলো বৃহত্তর ইসরায়েলে প্রতিষ্ঠা। কারণ ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তোরাহ ও বাইবেলের ভবিষ্যৎ বানীকে ভিত্তি করেই। সেখানে ইসরায়েলকে ঈশ্বরের রাজ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতিনিয়ত ভূমি দখল, বসতি স্থাপন, ফিলিস্তিনিদের হত্যা, গুমসহ সারা বিশ্বের ইহুদিদেরকে ইসরায়েলের নাগিরিকত্ব প্রদান এই শাসন ব্যবস্থার অর্ন্তভুক্ত।
এই নিয়ে বিস্তারিতভাবে অন্য নোটে দীর্ঘ আলোচনা করেছি। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক রাস্ট্রব্যবস্থাও অনেকটা থিওক্রাসির মত। সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে ঈশ্বর কর্তৃক শাসন না বলা হলেও সমাজতান্ত্রিক রাস্ট্রে শাসনযন্ত্রের সমালোচনা করা বিশ্বাসঘাতকতা ও মৃত্যুদন্ড সমতুল্য অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। । এমনকি প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদেরও ফাঁসি কাষ্ঠে ঝোলানো হয় সামান্য মতভেদের কারণে।
যে কোনো কম্যুনিস্ট ও থিওক্রাসিভুক্ত রাস্ট্রের ইতিহাস পড়তে গেলেই এর ভুরি ভুরি উদাহরণ পাবেন- যুক্তি এই যে একজন বলে বিশ্বাস ঘাতকের কোনো স্থান নেই আর অপর দল বলে ঈশ্বরকে অস্বীকারীর কোনো স্থান নেই ।
যাইহোক, এভাবে গত ৬০ বছর ধরে চলছে উত্তর কোরিয়ার শাসনযন্ত্র। এককথায়, বদলায়নি কিছুই৷ একই পরিবারের হাতে বছরের পর বছর থেকে গিয়েছে উত্তর কোরিয়ার শাসনের ভার৷ গোটা দেশে তৈরি করা হয়েছে অজস্র ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’৷ প্রশাসনের সামান্যতম সন্দেহেই সাধারণ মানুষকে নির্বাসন দেওয়া হয় এমনই কোনও ক্যাম্পে৷ একা নয়, অভিযুক্তকে বংশ পরম্পরায় এমন নির্বাসন দেওয়া হয়৷ প্রশাসনের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারেন বলে কোনো ব্যক্তিকে সন্দেহ করা হলেই অদ্ভুত ভাবে কেউই আর তার কোনো খোঁজ পায় না৷ গোপন পুলিশের সবুজ সঙ্কেত না মিললে রাজধানীতে থাকার অনুমতিও দেয়া হয় না বাসিন্দাদের৷ কাজেই এমন জায়গায় ক্ষমতা ধরে রাখতে শাসক যে কোনো পদক্ষেপ নিতেই দ্বিধা করেন না৷
( ........স....মা.....প্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।