আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: অটোগ্রাফ

আমার ভিতরে আমি স্বতন্ত্র জীবন যাপন করি।

নিজের বই হাতে নিয়ে বসে থাকার মধ্যে এক ধরণের মজা আছে। নিজের বই মানে ক্লাসের বই না, নিজের লেখা বই। রহমতুল্লাহ মুখ চোখ গম্ভীর করে গভীর মজা পাচ্ছেন। মুখ গম্ভীর করা বিষয়টা তিনি শিখেছেন পাশের স্টলের এক কবির কাছ থেকে।

ভদ্রলোকের নাম সীমান্ত উচ্ছ্বাস। তৃতীয় কাব্যগ্রন্হ বেরিয়েছে এবার বই মেলায়। চার দিনে সতের কপি সেল হয়েছে। ভদ্রলোক তার ক্রেতা আসলে মুখ গম্ভীর করে ফেলেন, যদিও তিনি প্রচন্ড হাসি খুশী মানুষ। রহমতুল্লাহর গম্ভীর ধ্যান ভাঙ্গলো সীমান্ত সাহেবের ডাকে “রহমত ভাই, সেল হইছে”?
-নারে ভাই, হয় নাই
-আল্লাহর রহমতে আজ আমার সেল ভালো, তিনটা
-মাশআল্লাহ, চলেন তাহলে চা খাওয়ান

রহমতুল্লাহর জীবন বেশী বড় না, বয়স তেত্রিশ।

জীবনের শখ আহ্লাদের ব্যাপারে তিনি মোটামুটি সচেতন। খুব শখ ছিল বই বের করার। প্রকাশকের হাত পা ধরার পাশাপাশি গুনেগুনে ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে নিজের একক কাব্যগ্রন্হ “হৃদয়ের ট্রামকার্ড” বের করেছেন। চার দিনে গতকাল প্রথম কপি কিনে নিলেন এক ভাগ্যবান। কেন কিনেছেন এ ব্যাপারে স্বয়ং রহমতুল্লাহও কনফিউজড।

রহমতুল্লাহর কাজ হল তার স্টলে দৈনিক কতজন মানুষ আসে তা মনে মনে হিসাব রাখা। সে ভদ্রলোক সাইত্রিশতম ছিলেন। কোন কারন ছাড়াই বইটা হাতে নিলেন, নেড়েচেড়ে দেখে টাকা দিয়ে চলে গেলেন। ব্যাপারটা সুখের হলেও রহমতুল্লাহ খুশী হতে পারলেন না। একটা অটোগ্রাফ নিয়ে যেতে পারত, বইতো কিনেছে, অটোগ্রাফতো একদম ফ্রি।

বই কিনলেই ফ্রি।

চায়ের বিল বিষয়ক ঝগড়ায় সীমান্ত সাহেবের জয় হয়। রহমতুল্লাহর হিংসা লাগে। লোকটা সবকিছুতেই কেন জানি জিতে যাচ্ছে। বই বিক্রির প্রতিযোগীতায় যদিও সে নাম লেখাচ্ছে না।

তবুও হিংসা করবার জন্য বোধহয় হিংসা করছে। সব বই বিক্রি হবার উদ্দেশ্যে প্রকাশ হয় না, কিছু বই অবিক্রিত থাকার জন্য প্রকাশিত হয়। এসব বইদের লেখকরা মূলত কবি প্রকৃতির হয়ে থাকেন। বই বিক্রি বিষয়ক কোন চিন্তা নেই, মেলায় মানুষ গুনতে গুনতে দিন কেটে যায়। রহমতুল্লাহ সে প্রকৃতির লোক হলেও একটা অটোগ্রাফ দেবার লোভ চেপে আছে।

ব্যাপারটা মেলায় আগত লেখকদের দেখে চেপেছে।

প্রেমিকা জেদ ধরেছে, প্রেমের কবিতার বই কিনে দিতে হবে। এ মহা ঝামেলা মেটাতে ভদ্রলোক দ্বারস্থ হলেন স্টলে। রহমতুল্লাহর কপাল ঘামছে, হাত বারবার বুক পকেটে রাখা কলমের কাছে চলে যাচ্ছে আপনা আপনি। লোকটার প্রেমিকা মহাসুন্দরী।

তাকে নিয়ে পুরো একটি কবিতার বই হতে পারে। কবিতার বই না, তাকে নিয়ে একটা রহস্যগল্প হতে পারে। বুক পকেটে নীল কালি, নীল কালিতে নিজের নাম খারাপ লাগবে না বোধহয়। মেয়েটির নাম ধরা যাক কমলি। কমলি ভালো থেকো প্রেমের কবিতা ডুব দিয়ে, সাঁতরে পার হয়ে যেও মুখবন্ধ থেকে ফ্ল্যাপ পর্যন্ত” রহমতুল্লাহ।


-ভাই আপনি এই বইয়ের লেখক?
যেন ধ্যান ভাঙলো “জ্বি জ্বি জ্বি”
-নিজে বানায়া বানায়া লেখছেন?
-হু
-ভালা লেখছেন, আমার বউ পছন্দ করছে।
ভদ্রলোক চলে গেলেন, বউ তার হাত ধরে নাচতে নাচতে সাথে থাকলো। ভ্যানিটি ব্যাগে ঢুকে গেলো কবিতার বই। এটা বিক্রি হওয়া তৃতীয় কপি। এর আগের কপি কার কাছে বিক্রি হয়েছে সে ব্যাপারে রহমতুল্লাহর কাছে কোন তথ্য নেই।



নিজেকে কুত্তার মত লাগছে রহমতুল্লাহর। কুত্তা না কুকুর এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কিছুক্ষন সময় লাগলো বটে। কবি হলেও কুকুরকে কুত্তা না বললে আসলে শান্তি নেই। এই যুক্তিতে নিজেকে কুত্তার মত লাগছে বলে সিদ্ধান্ত নিলো সে। একটি হাঁড়ের জন্য কুত্তা যেমন হাহাকার করে ঠিক তেমন হাহাকার একটি অটোগ্রাফের জন্য।

ঢাকা শহরে পরিচিত কেউ নেই বললেই চলে, নিতান্তই ঝোঁকের মাথায় নিজের শখ পূরণ করতে বরিশাল থেকে এই ঢাকা শহরে এসে অটোগ্রাফ দেবার স্বপ্ন নিতান্তই কল্পনা। তবুও মানুষ বেঁচে থাকে আশা আর কল্পনার কোন এক খুপরিতে। সীমান্ত সাহেবকে অটোগ্রাফ দেবার একটা ফন্দি এঁটেছিলো ঠিক তবে লোকটা ধূর্ত, বই কিনবেন বলে মনে হয় না। ইতোমধ্যে তার বই কিনে তাকে একটা সুযোগ দেয়া হয়েছে কিনবার। রহমতুল্লাহ ঠিক করেছে কিনলে কিনুক, না কিনলে মেলার শেষ দিন তাকে অটোগ্রাফসহ একটা বই উপহার দিবে।

আজ আরেক কপি বিক্রি হয়েছে, তবে আজও অটোগ্রাফের জন্য কলম চলেনি।

অটোগ্রাফ দিতে হয় পেচিয়ে পেচিয়ে। রহমতুল্লাহর হাতের লেখা সুন্দর। স্কুলে থাকতে কেবল হাতের লেখার জন্য কিছু মার্কস বেশী পেতেন। এরপরও পাশ ফেল নিয়ে দেখা যেতো প্রায়শ টানাটানি অবস্থা।

এক মহা সুন্দরী এই মুহুর্তে তার পাশে দাড়িয়ে আছে।
-এই যে শুনছেন, অন্য প্রকাশের স্টলটা কোন দিকে বলতে পারবেন?
-হ্যাঁ পারবো?
-কোন দিকে?
-ভুলে গেছি
-আপনি আমার সাথে মজা নিচ্ছেন? কী বলা যায় ভাবছে রহমতুল্লাহ। ভুল হয়ে গেছো, সুন্দরীদের রাগিয়ে দেয়া এক ধরণের অ্যাডভেঞ্চার অ্যাডভেঞ্চার খেলা। কিন্তু এখন খেলার সময় না। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে একটা সুন্দরীর সাথে বাক্য বিনিময় হচ্ছে অথচ স্টলে সাজিয়ে রাখা একটি কবিতার বই যে নিজের লেখা এটা জানানো যাচ্ছে না।

এ বিষয়টা একজন একদিনের লেখকেরও মেনে নেয়া কষ্টকর।
-না, আপনার সাথে আমি মজা নিবো কেন? আপনিইতো আমার সাথে মজা নিচ্ছেন। লুটেপুটে মজা নিচ্ছেন
-আপনার সাথে মজা নিবো কেন? হু আর ইউ?
- আমি আমি...তোতলাতে থাকে রহমতুল্লাহ। নিজের কবি পরিচয় দিতে তার অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। কিন্তু এমন সুন্দরী জানবেও না যে সে কবি।

এটা মেনে নেয়া কঠিন।
-আমি.. আমি.... কবি এই যে দেখছেন বই। এটা আমার নিজের লেখা, এখানে ষাটটা কবিতা আছে, এর মধ্যে তেতাল্লিশটা প্রেমের কবিতা!
“তো আমি কি করবো” বলে হনহন করে হেঁটে চলে গেলো সুন্দরী। খুব আফসোস লাগছে, প্রেম ভালোবাসা না, কেবল নিজের পরিচয় দেবার কারণে এভাবে অবহেলার শিকার হওয়া এক ধরনের অপমান। সুন্দরীরা পৃথিবীর বৈচিত্রময় কারণে ছেলেদের অপমান করে থাকে।

একবার এক সুন্দরী তার প্রেমিককে অপমান করেছিলো প্রেমিকের গালে ব্রণ উঠেছিলো বলে। তার দাবি ব্রণ উঠবে মেয়েদের, ছেলেদের ব্রণ ব্যাপারটাতে নাকি আহাম্মক আহাম্মক ব্যাপার আছে।

মেলার বাইশতম দিনে পঞ্চম কপি বিক্রি হয়েছে। এ নিয়ে সামান্যও হতাশা নেই তার। শুধু মাত্র একটি অটোগ্রাফ হলেই হবে, সুন্দর করে লেখা অটোগ্রাফ।

সবাই কত অটোগ্রাফ দেয়, অথচ সে কুকুরের মত মানুষের বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। দূরে আরেকজন সুন্দরী দাড়িয়ে আছে, রহমতুল্লাহর বুক পকেটের কলম লোভী লকলক করে উঠলো। ইচ্ছা করছে একটা বই নিয়ে তার হাতে ধরিয়ে দিতে “এই নিন ম্যাডাম, এইটা আমার বই, ভিতরে অটোগ্রাফ দিয়ে রাখলাম, এটা আমার তরফ থেকে আপনার জন্য উপহার”
-আপনি কে?
-আমাকে কেন বই দিচ্ছেন? বই এর ভিতরে মরিচের গুড়োটুড়ো নেই তো?
-ম্যাডাম এটা রেসিপির বই না, এটা কবিতার বই, হৃদয় থেকে নিয়ে আসা ষাটটি কবিতা
-আরে আমি ভাবছি মলম কোম্পানীর কথা।
-যাক বাবা বাঁচা গেলো, অটোগ্রাফ দিয়েছেন দেখছি, হাতের লেখা তো খুব একটা সুবিধার না। ডাক্তার নাকি আপনি?
-জ্বি ঠিকই ধরেছেন, এক প্রকার ডাক্তারই, হোমিওপ্যাথির একটা কোর্স করা আছে
-ডাক্তার হয়ে কবিতার বই বের করেছেন কেন? আপনার উচিত পেট ব্যাথায় করণীয় টাইপের বই লেখা।

তাহলে মানুষ উপকৃত হবে।
-আপনি হুমায়ূন আহমেদের বই খুব পড়েন তাই না?
-পড়বো না কেন? উনি আমার সবচে প্রিয়
-হুমায়ূন সাহেব বড় ক্ষতি করে দিয়ে গেছেন
-কি, কি করেছেন?
-উনি কিছু মেয়েকে অতি বেশী কথা বলার ট্রেনিং দিয়েছেন, এসব কথা বেশীর ভাগই উল্টা পাল্টা, কোন অর্থ নেই, তবে শুনতে ভালো লাগে।
সুন্দরী ঝগড়া শুরু করে দিলো। না ব্যাপারটা আর কল্পনা করতে পারছে না। সুন্দরী আগের জায়গায় নেই।

বই মেলার সুন্দরীরা এক স্টলে বেশীক্ষন থাকে না। তারা প্রজাপতির মত ঘুরে বেড়ায়। স্টলগুলো যেন এক একটা ফুল।

মেলার শেষ দিন। আজ দুপুর থেকে রহমতুল্লাহ বই মেলায়।

এতদিন থাকতে থাকতে মেলা প্রাঙ্গনটা নিজের ঘরের উঠোনের মত লাগছে। সুযোগ পেলে আজীবন থেকে যাওয়া যায়। মানুষ খুব কম, বই এর হুজুগ বেশীদিন থাকে না। গত শুক্রবারও কাতারে কাতারে মানুষ অকাতরে মেলায় প্রবেশ করেছে, তারা সবকিছুই করেছে, কেবল রহমতুল্লাহর অটোগ্রাফটা নেয়নি। তাই সকাল থেকে বাড়তি উত্তেজনা, আজ এসপার নয় ওসপার।

ওসপার কি এই মুহুর্তে এখনও ঠিক করা হয়নি।
-এই বইটার দাম কতো?
নিজের ষ্টলে এমন দাম জিজ্ঞেস করাতে রীতিমত আঁতকে উঠলেন। এই বুঝি হয়ে গেলো। কিন্তু লোকটা একটা রহস্য গল্পের বই বগলদাবা করে চলে গেলেন। রহমতুল্লাহ তীব্র হতাশ, এ যুগের মানুষ কবিতার চেয়ে রহস্য গল্পে রহস্য বেশী খুঁজে।

অথচ সকল রহস্য আছে কবিতায়। এক একটা লাইন এক একটা রহস্য, কবিতা আসলে স্ত্রীলিঙ্গ!
-এই যে নেন, আপনার বই এ একটা অটোগ্রাফ দিন!


সন্ধ্যে সাতটায় এমন কথা শুনে পুরো স্বর্গ পাবার মত ঘটনা। সব মিলিয়ে সময় হাতে আর দু ঘন্টা। নিজেকে পৃথিবীর সবচে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। কিন্তু বুক পকেটে থেকে কলম হাওয়া।

অটোগ্রাফ শিকারী সেদিনকার সে হুমায়ূন বালিকা। সীমান্ত সাহেব কিছুক্ষন আগে কলমটা চেয়ে নিয়েছেন। সীমান্ত সাহেব এখন কোথায়? চারপাশে চোখ বুলিয়ে তাকে পাওয়া গেল না, বই মেলায় প্রচন্ড ধুলাবালি। রহমতুল্লাহর চোখে ধুলো পড়ার মত অবস্থা। সামনে সুন্দরী, বুক পকেটে কলম নেই।

একটি অটোগ্রাফের দীর্ঘশ্বাস! দৌঁড় দিয়ে স্টলে গেলেন। স্টলের লোকজন রহমতুল্লাহে খুব একটা পছন্দ করে না। তারা তার বই উপরে সাজিয়ে রাখতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বহু আগে। কিন্তু নিতান্তই বাধ্য হয়ে রাখতে হয়েছে। এখন কলম চাইতেই গড়িমসি করে পাঁচ মিনিট শেষ, কলম নিয়েই রহমতুল্লাহ দেখেন হুমায়ূন বালিকা হাওয়া! অটোগ্রাফ দেবার শেষ সুযোগও হারালেন।

মেলা শেষ, পরিবেশ অনেকটা কনের বাড়ী থেকে কনের বিদায়ের পর থমথমে অবস্থার মত। রহমতুল্লাহর যেন সে কনের প্রেমিকের পুরো এক মাস চেষ্টা করেও একটা অটোগ্রাফ দেয়া হল না। প্রকাশকের সাথে সকল আলোচনা শেষ রাস্তায় বেরিয়ে এলো সে। সীমান্ত সাহেবের উপর রেগে তাকে অটোগ্রাফ দেবার শেষ সুযোগটাও বাতিল করলো নিজেই।

চুরমার হয়ে যাচ্ছে সান্ধ্যকালীন বইমেলা
হস্তান্তর অযোগ্য হয়নি কোন অটোগ্রাফ
বুক পকেটে নীল কালমের ডাক
অব্যবহৃত রয়ে গেলে হৃদয়ের ট্রামকার্ড।


চৌচির ধুলোবালি মেখে এক জানালা চোখ যেন,
বিষণ্নতার কথা বলছে সোডিয়াম লাইট
বাসে চড়ে চলে যায় ক্রেতা বিক্রেতার হাঁট
ট্রানজিটে আঁটকে পড়ে একটি অটোগ্রাফ।

ফ্ল্যাপে লেখা আমি কে? কেন আমি একা!
মুখবন্ধে মুখ বন্ধ করে হেঁকেছি সখা
রাতের মুখে ছুড়ে দেয়া ঘুমের অভিশাপ
মুখ খুলে বলেনি মনের কথা, চুপচাপ
জন্ম নেয়নি অবাধ্য একরোখা অটোগ্রাফ!

প্রচ্ছদে ঘুমিয়ে আছে তাসের ঘর
শিরোনামের পথ ধরে শব্দজট
কবিরা সব বনে গেছে বিরহের ঈশ্বর
মনে মনে কথা বলছে অনুভূতি আলাপ
অবিক্রিত থেকে গেছে একটি অটোগ্রাফ!


এ কবিতাটি ছিলো সে সন্ধ্যার কবিতা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.