প শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
প্রশ্ন :
নিম্নের বিষয়গুলোর প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি : বিষয়টি তর্ক বরং ঝগড়ার রূপ নিয়েছে, যারা বলে মীলাদুন্নবী বিদআত এবং যারা বলে মীলাদুন্নবী বিদআত নয় উভয় পক্ষের মধ্যে। যারা বলে মীলাদুন্নবী বিদআত, তাদের দলিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে অথবা সাহাবাদের যুগে অথবা কোন একজন তাবেঈর যুগে এ মীলাদুন্নবী ছিল না। অপরপক্ষ এর প্রতিবাদ করে বলে : তোমাদের কে বলেছে, আমরা যা কিছু করব, তার অস্তিত্ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে অথবা সাহাবাদের যুগে অথবা তাবীঈদের যুগে থাকা চাই। উদাহরণত আমাদের যুগে হাদিস শাস্ত্রের দু’টি শাখা “রিজাল শাস্ত্র” ও “জারহু ও তাদিল শাস্ত্র” ইত্যাদি বিদ্যমান, এগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ছিল না, এ জন্য কেউ এর প্রতিবাদ করেনি। কারণ, নিষিদ্ধ হওয়ার মূল যুক্তি হচ্ছে নতুন আবিষ্কৃত বিদআত শরী‘আতের মূলনীতি বিরোধী হওয়া, কিন্তু মীলাদুন্নবী বা মীলাদ মাহফিল কোন মূলনীতি বিরোধী ? অধিকাংশ তর্ক এ নিয়েই সৃষ্টি হয়।
তারা আরও দলিল পেশ করে যে, ইবন কাসির -রাহিমাহুল্লাহ- মীলাদুন্নবী সমর্থন করেছেন। দলিলের ভিত্তিতে বিশুদ্ধ কোনটি ?
উত্তর : আল-হামদুলিল্লাহ
প্রথমত :
প্রথমত জানা প্রয়োজন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম তারিখ নির্দিষ্টভাবে নির্ণয় সম্ভব হয়নি, এ ব্যাপারে আলেমদের বিভিন্ন অভিমত রয়েছে। ইবন আব্দুল বারর মনে করেন, তিনি রবিউল আউয়াল মাসের দুই তারিখে জন্ম গ্রহণ করেছেন। ইবন হাজম প্রাধান্য দেন রবিউল আউয়াল মাসের আট তারিখ। কেউ বলেছেন রবিউল আউয়াল মাসের দশ তারিখ, যেমন আবু জাফর বাকের।
কেউ বলেছেন রবিউল আউয়াল মাসের বারো তারিখ, যেমন ইবন ইসহাক। কেউ বলেছেন, তিনি রমযান মাসে জন্ম গ্রহণ করেছেন, যেমন ইবন আব্দুল বারর জুবাইর ইবন বাক্কার থেকে বর্ণনা করেছেন। দেখুন : “আস-সিরাতুন নববিয়াহ” পৃষ্ঠা : (১৯৯-২০০)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের নির্দিষ্ট তারিখ সম্পর্কে আলেমদের এ মত বিরোধই প্রমাণ করে যে, এ উম্মতের শ্রেষ্ঠ জামাত ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অধিক মহব্বতকারী সাহাবায়ে কেরাম তার জন্মের নির্দিষ্ট তারিখ সম্পর্কে নিশ্চিত ও চূড়ান্ত ছিলেন না, এ দিনটি পালন করা তো পরের কথা। এ দিন উদযাপন ছাড়াই মুসলমানদের কয়েক শতাব্দী গত হয়েছে, অবশেষে ফাতেমি নামে একটি বদদ্বীন ফেরকা এ দিনটির প্রচলন ও সূচনা করে।
শায়খ আলী মাহফুজ -রাহিমাহুল্লাহ- বলেন :
“সর্বপ্রথম এ দিনটি উদযাপন করা হয় মিসরের কায়রোয় : ফাতেমি খলিফারা চতুর্থ শতাব্দীতে এর প্রচলন আরম্ভ করে।
তারা ছয়টি মীলাদ বা জন্ম উৎসব প্রবর্তন করে : মীলাদুন্নবী, মীলাদে আলী -রাদিআল্লাহু আনহু-, মীলাদে ফাতেমাতুজ জোহরা- রাদিআল্লাহু আনহা-, মীলাদে হাসান ও হুসাইন- রাদিআল্লাহু আনহুমা- এবং বর্তমান খলিফার মীলাদ। সেই থেকেই তাদের দেশে এ মীলাদগুলো (জন্মানুষ্ঠান) যথারীতি পালন করা হচ্ছিল। অবশেষে এক সময়কার সেনাবাহিনী প্রধান আফজাল এসব মীলাদ রহিত করে দেন। খলিফা আমের বিআহকামিল্লাহ নিজ শাসনকালে পুনরায় এসব মীলাদ চালু করেন, অথচ মানুষ এসব মীলাদ ভুলতে আরম্ভ করেছিল। সপ্তম শতাব্দীতে “ইরবিল” শহরে সর্বপ্রথম এ মীলাদ আরম্ভ করেন বাদশাহ আবু সাঈদ, সেই থেকে আজ পর্যন্ত চলে আসছে তা, বরং তাতে আরও বৃদ্ধি ও সংযোজন ঘটেছে।
তাদের রিপু ও প্রবৃত্তির চাহিদা মোতাবেক সব কিছু তারা এতে যোগ করেছে। তাদেরকে এর প্রত্যাদেশ করেছে মানব ও জিন শয়তানেরা”। “আল-ইবদা ফি মাদাররিল ইবতেদা” (পৃষ্ঠা নং: ২৫১)
দ্বিতীয়ত :
প্রশ্নে উল্লেখিত মীলাদুন্নবী উদযাপনকারীরা বলেছে : “তোমাদের কে বলেছে, আমরা যা কিছু করব, তার অস্তিত্ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে অথবা সাহাবাদের যুগে অথবা তাবেঈদের যুগে থাকা চাই”। এর থেকে প্রকাশ পায় যে, তারা বিদআতের অর্থ জানে না, যে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বহু হাদিসে সতর্ক করেছেন। প্রশ্নে তারা যে মূলনীতি উল্লেখ করেছে, সে মূলনীতি হচ্ছে ইবাদাতের ক্ষেত্রে, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা হয়।
অতএব এমন কোন ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যাবে না, যার বিধান বা অনুমোদন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে প্রদান করেননি। এ মূলনীতি বিদআত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিষেধাজ্ঞা থেকেই প্রমাণ হয়। বিদআতের সংজ্ঞাই হচ্ছে আল্লাহর অনুমোদন বিহীন ইবাদাত রচনা করা ও তার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করার চেষ্টা করা। এজন্যেই হুযাইফা রাদিআল্লাহু আনহু- বলেছেন : “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব ইবাদাতের মাধ্যমে ইবাদাত করেননি, তোমরাও তার মাধ্যমে ইবাদাত কর না”।
এ প্রসঙ্গে ইমাম মালেক -রাহিমাহুল্লাহ- বলেছেন :
“সে যুগে যা দ্বীন বা ধর্ম ছিল না, এ যুগেও তা দ্বীন বলে গণ্য হবে না”।
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে যা দ্বীন ছিল না, সে যুগে যার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদাত করা হয়নি, তার পরবর্তী যুগে তা দ্বীন ও ধর্মের অংশ হিসেবে গণ্য হবে না।
প্রশ্নকারীর উদাহরণ “জারহু ও তাদিল শাস্ত্র” এবং ইহা এক অনিন্দনীয় বিদআত :
মূলত যারা বিদআতকে দু’ভাগে ভাগ করে “বিদআতে হাসানা” ও “বিদআতে সায়্যেআহ” তারা এ অভিমত পেশ করেছে। তারা এর চেয়ে আগে বেড়ে শরী‘আতের বিধানের ন্যায় বিদআতকেও পাঁচভাগে ভাগ করেছে : (ওয়াজিব, ইস্তেহবাব, ইবাহাত, হারাম ও মাকরুহ)। এ ভাগ সর্বপ্রথম ইজ্জ ইবন আব্দুস সালাম উল্লেখ করেন, অতঃপর তার শিষ্য কুরাফি তার অনুরসণ করেন।
এ বণ্টনের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করায় শাতেবি -রাহিমাহুল্লাহ- কুরাফির প্রতিবাদ করে বলেন : “এ বণ্টন স্বরচিত, এর পক্ষে শরী‘আতের কোন দলিল নেই, বরং এ বণ্টন স্ব-যুক্তির বিচারেই বাতিল ও প্রত্যাখ্যাত।
কারণ বিদআতের সংজ্ঞা হচ্ছে, শরী‘আতের কোন দলিল যা প্রমাণ করে না তাই বিদআত, না সরাসরি কুরআন-না হাদিস, না তার থেকে নিঃসৃত কোন নীতি। যদি শরী‘আতের এমন দলিল থাকে, যার দ্বারা ওয়াজিব অথবা নুদুব অথবা ইবাহাত প্রমাণিত হয়, তাহলে এসব বিদআত থাকে না, বরং অন্যান্য আদিষ্ট আমলের অন্তর্ভুক্ত অথবা তার মধ্যে উত্তম আমল হিসেবে গণ্য হয়। অতএব এগুলোকে (ওয়াজিব, ইস্তেহবাব, ইবাহাত, হারাম ও মাকরুহ) বিদআত গণ্য করা এবং এগুলোর স্বপক্ষে ওয়াজিব অথবা নুদুব অথবা ইবাহাতের দলিল বিদ্যমান থাকার দাবি করা, মূলত দুই বিপরীত বস্তুকে একত্র করার শামিল।
হ্যাঁ, এ বণ্টনের অন্তর্ভুক্ত “মাকরুহ” ও “হারাম” বিদ‘আত হিসেবে সমর্থন যোগ্য অন্য বিবেচনায় নয়, অর্থাৎ বণ্টন হিসেবে বিদ‘আত বিবেচ্য নয়। কারণ নিষেধাজ্ঞার উপর অথবা মাকরুহ হওয়ার উপর যদি কোন দলিল থাকে, তখন সেটা বিদআত নয়, বরং তা পাপের অন্তর্ভুক্ত, যেমন হত্যা, চুরি, মদপান ইত্যাদি।
অতএব কোন বিদআতের ক্ষেত্রেই এ বণ্টন কল্পনা করা যায় না, শুধু মাকরুহ ও হারাম ব্যতীত, যেমন বিদআতের আলোচনায় বলা হয়।
কুরাফি বিদআত প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে সাথীদের যে ঐক্য বর্ণনা করেছেন তা ঠিক, কিন্তু তিনি যে বিদআতের শ্রেণী ভাগ বর্ণনা করেছেন, এর ফলে তার উপর ঐক্য দাবি করা ঠিক নয়। আশ্চর্যের বিষয় ! মত বিরোধ সত্ত্বে এবং ঐক্য ভঙ্গের কারণ জানা থাকার পরও তিনি কিভাবে ঐক্য দাবি করলেন! হয়তো, বরং নিশ্চিত এ ব্যাপারে তিনি তার উস্তাদের অনুসরণ করেছেন কোন ভাবনা ছাড়াই।
অতঃপর তিনি (শাতেবি রহ.) এ বণ্টনের ব্যাপারে ইজ্জ ইবন আব্দুস সালামের কারণ বর্ণনা করেন। তিনি মূলত “মাসালেহে মুরসালাহ”-কে বিদ‘আত নামকরণ করেছেন।
অতঃপর তিনি বলেন : কিন্তু কুরাফির তার শায়খের এ বণ্টন তার পছন্দের বিরুদ্ধে নকল করার কোন কারণ গ্রহণযোগ্য নয়, আর না অন্যের পছন্দ অনুযায়ী তা প্রকাশ করা। কারণ তিনি এ বণ্টনের মাধ্যমে ইজমা ও ঐক্যের খেলাফ করেছেন, তাই এ বণ্টন ইজমা ও উম্মতের ঐক্য মতের খেলাফ”। আল-ই‘তিসাম : (পৃষ্ঠা নং: ১৫২-১৫৩) পাঠকবর্গকে আমরা তার কিতাব দেখার অনুরোধ করছি, কারণ তিনি পরিপূর্ণ রূপে ও সুন্দরভাবে এর প্রতিবাদ করেছেন- রাহিমাহুল্লাহ-
ইজ্জ ইবন আব্দুস সালাম তার বিদআতের বণ্টন অনুসারে বলেন : ওয়াজিব বিদআতের অনেক উদাহরণ রয়েছে :
এক. আল্লাহর কালাম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস বুঝার জন্য ইলম নাহু বা আরবি ব্যাকরণ শাস্ত্র নিয়ে মশগুল হওয়া। শরী‘আত হিফাজত করার জন্য এ ইলম অর্জন করা ওয়াজিব। কারণ, এ ইলম ব্যতীত শরী‘আত হিফাজত করা সম্ভব নয়, আর যা ব্যতীত ওয়াজিব আদায় করা সম্ভব নয়, তা অর্জন করাও ওয়াজিব।
দুই. কুরআন ও হাদিসের শব্দ মুখস্থ করা।
তিন. উসূলে ফিকাহ আবিষ্কার করা।
চার. সহীহ ও দুর্বল হাদিস পার্থক্য করার জন্য “জরহু ও তাদিল শাস্ত্র” শিক্ষা করা। শরী‘আতের নীতিমালা দ্বারা প্রমাণিত যে, শরী‘আত সংরক্ষণ করা ফরয, যেহেতু এসব ইলম ব্যতীত শরী‘আত সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়, তাই এসব ইলম অর্জন করাও ফরয”। “কাওয়েদুল আহকাম ফি মাসালেহেল আনাম” : (২/১৭৩)
ইমাম শাতেবি এরও প্রতিবাদ করেছেন, তিনি বলেন : “আর ইজ্জুদ্দিনের কথা : ‘যা ব্যতীত ওয়াজিব আদায় হয় না, তা অর্জন করাও ওয়াজিব’।
এসব ব্যাপারে পূর্বসূরিদের আমল থাকা জরুরী নয়, আর না নির্দিষ্টভাবে শরী‘আতের কোন দলিল এর পক্ষে থাকা জরুরী, কারণ এগুলো “মাসালেহে মুরসালাহ” এর অন্তর্ভুক্ত, বিদ‘আতের নয়। ” আল-ইতিসাম : (পৃষ্ঠা নং: ১৫৭-১৫৮)
এ প্রতিবাদের সারসংক্ষেপ : এসব ইলমকে শরী‘আতের নিন্দনীয় বিদআত হিসেবে গণ্য করা ঠিক নয়, কারণ শরী‘আতের সাধারণ বিধান ও তার সাধারণ নীতি এসব ইলমের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে এবং এর গুরুত্বের সাক্ষী দেয়। অর্থাৎ শরী‘আতের যেসব দলিল দ্বীন ও সুন্নত হিফাজত করার নির্দেশ দেয় এবং শরী‘আতের জ্ঞান ও কুরআন-হাদিস যথাযথ মানুষের নিকট পৌঁছানোর তাগিদ প্রদান করে, তা এ জাতীয় ইলম অর্জনের প্রতিও উদ্বুদ্ধ করে।
আবার এও বলা যায় : এসব ইলম আভিধানিক অর্থে বিদআত, শরয়ী বিদআত নয়, শরয়ী সকল বিদআতই নিন্দনীয়। আর আভিধানিক বিদআতের কতক ভাল আর কতক মন্দ।
ইবন হাজার আসকালানি -রাহিমাহুল্লাহ- বলেছেন : শরী‘আতের দৃষ্টিতে সকল বিদআত নিন্দনীয়, কিন্তু আভিধানিক অর্থে নিন্দনীয় নয়, কারণ আভিধানিক অর্থে পূর্বের নমুনা ব্যতীত যে কোন আবিষ্কারই বিদআত, কি ভাল কি মন্দ। ফাতহুল বারি : (১৩/২৫৩)
তিনি আরও বলেন : “"البِدَع" শব্দ بدعة এর বহুবচন, পূর্বের নমুনাহীন প্রত্যেক আবিষ্কারই বিদআত, আভিধানিক অর্থে ভাল-মন্দ সব আবিষ্কার এর অন্তর্ভুক্ত, তবে শরয়ী পরিভাষায় শুধু মন্দকেই বিদআত বলা হয়, যদি শরী‘আত অনুমোদিত কোন বিষয়ে কখনো বিদআত ব্যবহার হয়, তাহলে সেটা তার আভিধানিক অর্থে”। ফাতহুল বারি : (১৩/৩৪০)
ফাতহুল বারির (৭২৭৭) নং হাদিসের টিকায় রয়েছে, শায়খ আব্দুর রহমান আল-বারাক -হাফিজাহুল্লাহ- বলেছেন : “এ বণ্টন হচ্ছে আভিধানিক অর্থে, কিন্তু শরয়ী অর্থে সকল বিদআত গোমরাহী, যেরূপ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
"وشر الأمور محدثاتها ، وكل بدعة ضلالة". صحيح مسلم : (1441)
“আর সবচেয়ে খারাপ বস্তু হচ্ছে বিদআত, আর প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী”। [সহীহ মুসলিম: ১৪৪১]
বিদআত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এমন সাধারণ মন্তব্য থাকা সত্ত্বেও বিদআতকে ভাগ করে, ওয়াজিব অথবা মুস্তাহাব অথবা মুবাহ বলা দুরস্ত নয়, বরং শরী‘আতের মধ্যে প্রত্যেক বিদ‘আতই হারাম অথবা মাকরুহ। এ মাকরুহ বিদআতের উদাহরণ যেমন ফজর ও আসরের সময়ে নির্দিষ্টভাবে মুসাফাহ করা, অনেকে বলে এটা মুবাহ তথা বৈধ বিদআত।
আরও একটি বিষয় বিবেচনা যোগ্য : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে কোন বাঁধা না থাকা এবং সকল আয়োজন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মীলাদুন্নবী উদযাপন না করা। মীলাদুন্নবী ও নবীর মহব্বত উভয় সাহাবাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল, যার ভিত্তিতে তারা ইচ্ছা করলে মীলাদুন্নবী উদযাপন করতে পারতেন, এতে কোন বাঁধাও ছিল না, এ সত্ত্বেও যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবায়ে কেরাম মীলাদুন্নবী উদযাপন করেননি, তাই এটা অবৈধ, যদি বৈধ হতো তাহলে তারা সকলের আগেই এ অনুষ্ঠান পালন করতেন।
শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ -রাহিমাহুল্লাহ- বলেছেন : “অনুরূপ কতক লোকের (মীলাদুন্নবী) আবিষ্কার, তারা হয়তো নাসারাদের অনুকরণে, যেমন তারা ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মানুষ্ঠান পালন করে, অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত ও সম্মানের খাতিরে, আল্লাহ তাদের এ মহব্বত ও সম্মানের প্রতি সাওয়াব দিতেও পারেন, তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিনকে ঈদ হিসেবে পালন করার জন্য নয়, অধিকন্তু তার জন্মের নির্দিষ্ট তারিখ সম্পর্কে দ্বিমত তো রয়েছেই। কারণ আমাদের পূর্বসূরি ও আদর্শ মনীষী কেউ এটা পালন করেননি, অথচ তখনো এর দাবি বিদ্যমান ছিল, কোন বাঁধা ছিল না, যদি এটা কল্যাণকর হতো অথবা ভাল হতো, তাহলে আমাদের পূর্বসূরিগণই এর বেশী হকদার ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত আমাদের চেয়ে তাদের মধ্যে বেশী ছিল।
তারা তাকে আমাদের চেয়ে অধিক সম্মান করতেন। আমাদের চেয়ে তারা কল্যাণের ব্যাপারে অগ্রগামী ছিলেন। বস্তুত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিপূর্ণ মহব্বত ও সম্মানের পরিচয় হচ্ছে, তার আনুগত্য ও অনুসরণ করা, তার নির্দেশ পালন করা এবং প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে তার সুন্নত জীবিত করা, তার আনিত দ্বীন প্রচার করা এবং এ জন্য অন্তর-হাত ও মুখ দ্বারা জিহাদ করা, কারণ এটাই আমাদের পূর্বসূরি মুহাজির, আনসার ও তাদের যথাযথ অনুসারীদের নীতি ও আদর্শ ছিল”। ইকতেদাউস সিরাত : (পৃষ্ঠা: ২৯৪-২৯৫)
এটা সরল ও সাধারণ কথা : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত অনুসরণের মধ্যেই তার প্রতি মহব্বত প্রকাশ পায়। আরও প্রকাশ পায় তার সুন্নতের শিক্ষা বিস্তার ও প্রসার করা এবং তার সুন্নতের উপর থেকে যে কোন হামলা প্রতিরোধ করা ইত্যাদিতে।
মূলত এটাই ছিল সাহাবাদের পদ্ধতি।
কিন্তু পরবর্তী যুগের লোকেরা নিজেদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে এবং এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শয়তানও তাদের ধোঁকা দিচ্ছে। তাদের ধারণা এসবের মাধ্যমে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত প্রকাশ করছে, কিন্তু তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত জীবিত করা, তার অনুসরণ করা, তার দিকে দাওয়াত দেয়া ও মানুষকে তা শিক্ষা দেয়া এবং তার উপর থেকে হামলা প্রতিহত করা থেকে অনেক দূরে।
তৃতীয়ত : এ ব্যক্তি যে বলেছে ইবন কাসির -রাহিমাহুল্লাহ- মীলাদুন্নবী বৈধ বলেছেন, আমাদের সামনে সে এর দলিল পেশ করুক, কারণ আমরা তার এ ধরণের বক্তব্য সম্পর্কে জানি না, আমরা মনে করি তিনি এ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আল্লাহ ভাল জানেন।
সমাপ্ত ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।