আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার প্রধান আয়মান আল-জাওয়াহিরির নামে এক অডিও বার্তায় বাংলাদেশে জিহাদের ডাক দেয়া হয়েছে। বার্তাটি গত শনিবার বিকালে দেশের ইলেকট্রনিক ও অনলাইন গণমাধ্যমে ব্রেকিং নিউজ, পরের দিন সকল দৈনিক পত্রিকায় র্শীষ সংবাদ হয় এবং তা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। বার্তাটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের বিচার, হেফাজতে ইসলামের ৫ মে মতিঝিল শাপলা চত্বরের সমাবেশ ইত্যাদি প্রসঙ্গ ইঙ্গিতে টেনে ক্ষমতাসীন সরকারকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘ইসলামবিরোধী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা মিডিয়ার কল্যাণে দেশবাসী অবগত। এটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগ ও আশঙ্কাজনক খবর।
তার চেয়ে বড় খবর, এটা জামায়াত-শিবিরে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ। যেমনভাবে চাঁদে সাঈদীকে দেখা যাওয়ার আজব-গুজব ছড়িয়ে জামাতে ইসলামী ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করেছিল। তবে, এ বার্তাটি হালকাভাবে দেখার কোনো কারণ নেই। জাওয়াহিরির বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল, হেফাজত ও জামাত আল কায়েদার ঘনিষ্ঠ ও সহযোগী সংগঠন। কাজেই এটা ঘৃণ্য এই অপশক্তির দেশকে আর একটি আফগানিস্তান বা পাকিস্তান বানানোর গভীর চক্রান্তের অংশবিশেষ হিসেবে জনগণের মাঝে প্রাথমিক প্রকাশ।
শুরুতেই চক্রান্তকারী গোষ্ঠীকে দেশ থেকে নির্মূল করা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রধান ও পবিত্র দায়িত্ব।
আল-জাওয়াহিরির নামে অডিও বার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে যে মন্তব্য করেছে তা খুবই হাস্যকর। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সেদিন আমার মতো হাজার হাজার তরুণ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিছুসংখ্যক দেশদ্রোহী দালাল ছাড়া সকল ধর্মবর্ণ সম্প্রদায়ের মানুষ এই স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে ছিল।
ব্যতিক্রম ছিল জামায়াতে ইসলামী দলটি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। আল-কায়েদা কিংবা অন্য কোনো দেশের সহযোগিতার মাধ্যমে নয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশকে যে সহযোগিতা করেছিল তা অতুলনীয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পিছনে ভারতের অবদান বাংলাদেশের মানুষ আজীবন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।
ভারত বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবে সেদিন পাশে ছিল, নতুবা এতো তাড়াতাড়ি দেশ স্বাধীন নাও হতে পারতো। এই ভারতই বাংলাদেশকে প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সৌদি আরব কিংবা যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৯৭৫ সালে। এটা বেশ স্পষ্ট, এতোদিন ধর্মের দোহাই দিয়ে পার পেলেও জনসচেতনতা বৃদ্ধির কারণে জামাত এখন বেকায়দায় পড়েছে। অন্য দিকে, তাদের উচ্চপর্যায়ের নেতারা মানবতাবিরোধী অপরাধে আদালত কর্তৃক অভিযুক্ত হওয়ায় তারা অস্তিত্ব সঙ্কটে রয়েছে।
আল-কায়েদার মতো জঙ্গি সংগঠনের সহযোগিতা তারা নিজেদের স্বার্থেই নেবেÑ এ ভাবনা অমূলক নয়। এছাড়া জঙ্গিবাদ সমর্থনকারীদের রাজনৈতিক কর্মকা- কতোটুকু জনকল্যাণমুখী তা দেশবাসীর অজানা নয়। ফলে রাষ্ট্রের কর্তব্য হওয়া দরকার এদের নির্মূলে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর পাকিস্তান কাদের মোল্লাকে নির্দোষ দাবি করে যে বিবৃতি দিয়েছিল তাতে আবারো প্রমাণিত হয়েছিল জামাত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত। এর আগে জামাত-হেফাজতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের জোগসাজশের অভিযোগ বিভিন্ন মহল থেকে উঠলেও জামাত-হেফাজতের তৎপরতার পক্ষ নিয়ে কোনো আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের বার্তা প্রচার এই প্রথম মনে হচ্ছে।
আল-জাওয়াহিরির বক্তব্যে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ভারতের ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র এবং শত শত আলেমের হত্যাকা- সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ জামাত-হেফাজতের বক্তব্য।
সমগ্র বিশ্বে ইসলামী আকিদার পুনর্জাগরণে ও বিশ্বব্যাপী ইসলামের শান্তি ও আদর্শের বার্তা প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে তাবলীগ-জামাত, যার প্রধান কেন্দ্র ভারতের দিল্লিতে। বিশ্ব ইজতেমা তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশ। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তস্নাত যুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে জামায়াতে ইসলামী দলটি রাজনীতি করার অধিকার হারায়।
শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। সংবিধানে স্থান পায় চার মূলনীতিÑ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। তখন ছিল না কোনো ধর্মীয় ভেদাভেদ। এখানে পৃথক ধর্ম পালনে কারো কোনো বাধা থাকার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, জামাত নামধারী এ সংগঠনটি ধর্মকে পুঁজি করেই রাজনীতি চালিয়ে আসছে।
দেশে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির পাঁয়তারায় জামাত-শিবির ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, তাদের মন্দির ও প্রতিমা ভাংচুর করেছে। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের আগুন দিয়েছে, ৫মে হেফাজতে ইসলাম শত শত কোরআন পুড়েছে, নিরীহ মানুষদের পেট্রল বোমা মেরে মেয়েছে। এইসব কারণে আল-কায়েদা একবারও কোনো বিবৃতি দেয়নি। অথচ, জাওয়াহিরি তার বক্তব্যে বলেছেন, বাংলাদেশ আজ নাকি এক বিরাট কারাগারে পরিণত হয়েছে। যেখানে মুসলমানদের ধর্মপরায়ণতা, সম্মান, মর্যাদা ও পবিত্র স্থান অপবিত্র করা হচ্ছে।
আমাদের জীবন আজ নাকি বিপন্ন। আমি একজন মুসলিম, বর্তমানে আমি অনেক ভাল আছি। তবে, কিছুদিন আগে খুবই আতঙ্কে থাকতাম। কারণ, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামাত নেতা সাঈদীর ফাঁসির রায়ে পর জামাত-শিবির দেশে একের পর এক চোরাগোপ্তা হামলা করেছিল। আসলে এটা ধর্মীয় কোনো সংগঠন না, এটি সন্ত্রাসী রাজনৈতিক শক্তি।
এরা ধর্মকে ব্যবহার করে তাদের নষ্ট কর্মকা-ের বাস্তবায়ন করতে চায়। বাধা দিলেই হিংস্র হয়ে ওঠে। ইসলাম মানবিকতা ও সার্বজনীনতার ধর্ম। এ ধর্মেতো অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর অত্যাচারের স্থান নেই। ইসলামের পবিত্রতা ভূলুণ্ঠিত করে যারা ইসলামের নামে ব্যবসা করে তাদেরকে প্রতিহত করাই একজন ঈমানদারের নৈতিক দায়িত্ব।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন গত মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকার জঙ্গিবাদ দমনে কঠোর ছিল। আশা করি বর্তমান সরকার সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াই চালু রাখবে। তবে সরকারের একার পক্ষে জঙ্গিবাদ দমন কঠিন। এজন্য জঙ্গিবাদবিরোধী সব দল, গোষ্ঠী ও ব্যক্তিকে এক কাতারে শামিল করতে হবে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
এজন্য সমাজে ও মানুষের চিন্তায় অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা জরুরি। কারণ জঙ্গিবাদের শেকড় সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মান্ধতার মধ্যেই নিহিত। বিগত বিএনপি-জামাত জোট আমলে আল-কায়েদাসহ আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের অনুসারী ও মদপুষ্ট জেএমবি, হুজিসহ বেশকিছু জঙ্গি সংগঠনের সন্ত্রাসী তৎপরতা দেশে ব্যাপক মাত্রা পেয়েছিল। সেসময় আল-কায়েদার বর্তমান শীর্ষ নেতা জাওয়াহিরিও একাধিকবার এ দেশ ঘুরে গেছেন বলে জানা যাচ্ছে। জেএমবি, হুজিদের রাজনৈতিক শিকড় অনুসন্ধানে ও কর্মকা- বিশ্লেষণে এই অভিযোগ জোরালো হয়েছিল যে, এরা স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন জামাতেরই জঙ্গিডানা।
এরপর যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর আমরা দেখেছি জামাতকে মুখোশ ছেড়ে জঙ্গি রূপেই আবির্ভূত হতে। অনেকে বলেন, জামায়াত শিবিরেরর রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে, তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। হিজবুল মুজাহিদীন বা হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ করার পর পর কী হয়েছে? তারা কি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিল? হিযবুত তাহরীর চিরদিনের জন্য বাংলার মাটি থেকে নিঃশেষ হয়ে গেছে। বিগত নির্বাচনের সময় জামাত ইসলামের সমর্থন ছিল ৪ শতাংশ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হবার পর সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে এদের সমর্থন ২ শতাংশে নেমে এসেছে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো এরা ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে দেশজুড়ে যে অপকর্ম করছে এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েছে ও চালাচ্ছে তাতে তাদের এ দেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। এদের হিংস্ররূপ জনগণ দেখেছে।
বাংলাদেশকে নিয়ে আল কায়েদার মিথ্যাচার এবং মুক্তিযুদ্ধকে কটাক্ষ করার ধৃষ্টতা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এ হটকারী বক্তব্য প্রদানকে দেশে আল-কায়েদার কার্যক্রম শুরু করার ঘোষণা হিসেবেই বিবেকবান নাগরিক ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সুচিন্তিতভাবে ভাবতে হবে। জঙ্গিবাদের পুনরুত্থানরোধে এবং আল জাওয়াহিরির অডিওবার্তার প্রেক্ষাপটে সরকারকে দ্রুততার সঙ্গে নতুন করে ভেবে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।
একই সঙ্গে খতিয়ে দেখা জরুরি, দেশে-বিদেশে কারা বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে এবং এটা এই ষড়যন্ত্রেরই অংশ কি-না। জামাত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে কোনো কালক্ষেপণ কাম্য নয়। জামাত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি এখন সময়ের দাবি।
সুত্র
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।