ঘটনা এক : ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ত নগরী। রাস্তার পাশে গাড়ি থেকে নেমে ভিড় ঠেলে বিপণিবিতানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এক ব্যক্তি। আর মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে তার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন অন্য এক যুবক। কয়েক সেকেন্ডেই তারা খুব কাছাকাছি। ফোনে কথা বলতে বলতেই যুবকটি ডান হাতে ধরা একটি চকচকে পিস্তল সামনের দিকে এগিয়ে ধরলেন।
গাড়ি থেকে নামা ব্যক্তিটির মাথা নিশানা করে গুলি ছুড়লেন। ছটফট করতে করতে কুঁজো হয়ে সড়কের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ব্যক্তিটি। রক্ত ঝরছে। আতঙ্ক। রাস্তায় লোকজনের ছোটাছুটি।
দোকানের ঝাঁপ পড়ছে। কিন্তু পিস্তল হাতে যুবকটি থামছেন না। এবার বাম হাত তার উপরে তোলা। টার্গেট বানানো রক্তাক্ত ব্যক্তির দিকে হান ডাতে গুলি চালিয়েই যাচ্ছেন। চারপাশ থেকে কয়েকটি মোটরসাইকেলে করে আরও বেশ কয়েকজন যুবক গুলি ছুড়তে ছুড়তে ছুটে এলো।
দৌড়ে একটিতে চেপে বসলেন পিস্তল হাতের যুবকটি। মুহূর্তেই তারা হাওয়া। ৯ সেকেন্ডেই সব শেষ। রাস্তায় পড়ে থাকে এক নিথর দেহ। ঘটনা দুই : অাঁকাবাঁকা পথ ধরে ছুটে চলছে প্রিজন ভ্যান।
পিছু নিয়েছে দুটি মাইক্রোবাস। হঠাৎ মাইক্রোবাস থেকে অনবরত গুলি ছোড়া হচ্ছে। সামনে থেকে এ সময় ছুটে আসছে একটি ট্রাক। ট্রাকটি প্রিজন ভ্যানের সামনে এসেই বাঁক নিল। থেমে গেল প্রিজন ভ্যান।
দুই মাইক্রোবাস থেকে এবার নেমে এলো অস্ত্র হাতে একদল মুখোশধারী। তাদের হাতের অস্ত্রগুলো তেতে উঠছে। কেউ বোমা ছুড়ল। ছিটকে রাস্তার ওপর পড়ল সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী। প্রিজন ভ্যানের চালক গাড়ি ফেলেই ভোঁ-দৌড়।
রক্তাক্ত তিন পুলিশ পড়ে রইল। প্রিজন ভ্যান থেকে দেশের দুর্ধর্ষ তিনি অপরাধীকে বের করে নিয়ে এলো মুখোশধারীরা। তাদের মাইক্রোতে তুলেই লাপাত্তা। মাত্র ৭ মিনিটেই মিশন শেষ। রাস্তায় পড়ে থাকে প্রিজন ভ্যান।
ধোঁয়া বেরোচ্ছে ভেতর থেকে। পাশেই পড়ে রইল তিন পুলিশের রক্তাক্ত দেহ। হলিউড, বলিউড বা ঢালিউডে নির্মিত অ্যাকশনধর্মী কোনো সিনেমার খণ্ডচিত্র এসব নয়। এ দুটি ঘটনা পুরোপুরি সত্য। ওপরে বর্ণিত প্রথম ঘটনাটি রাজধানীর গুলশানের।
গত বছর ২৯ জুলাই রাত ১টায় এভাবেই খুন করা হয় যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান ওরফে মিল্কিকে। পরের ঘটনাটি ঘটেছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকায়। গত রবিবার ফিল্মি কায়দায় ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তিন জঙ্গি নেতাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের স্টাইল ফিল্মকেও হার মানিয়েছে। ফিল্মি স্টাইলের এমন অপরাধই ঘটছে রাজধানীসহ সারা দেশে।
অপরাধীরা এখন নানা কৌশলে অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে। খুনখারাবি থেকে শুরু করে ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণসহ নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে নিত্যনতুন স্টাইলে। অস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষের ওপর নানা অঙ্গভঙ্গিতে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। অস্ত্র হাতে ছুটে চলা অপরাধীদের দেখে বোঝার উপায় নেই এটি কোনো সিনেমার দৃশ্য নাকি বাস্তব। কোনো কোনো অ্যাকশন ফিল্মের অ্যাকশনকেও হার মানিয়েছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অপরাধের ধরন পাল্টে গেছে। শীর্ষ থেকে ছিঁচকে অপরাধীদের অপরাধে এখন যোগ হয়েছে ফিল্মি স্টাইল। খুন করতে গুলিবর্ষণ বা বোমা হামলা চালানোর কায়দাও এখন আর আগের মতো নেই। অ্যাকশনধর্মী সিনেমা ও বই পড়ে সেই অ্যাকশন তারা তাদের অপরাধে যুক্ত করছে। রাজধানীতে ছিনতাই থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের অপরাধেই নিত্যনতুন কৌশল লক্ষ্য করা গেছে; যা গত পাঁচ বছরেও দেখা যায়নি।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০০০ সালে রাজপথে তৎকালীন সরকারদলীয় এক এমপির নেতৃত্বের মিছিল থেকে আরেক মিছিলের ওপর গুলি চালানো হয়। অস্ত্রধারীরা নানা অঙ্গভঙ্গিতে এ সময় গুলি ছুড়তে থাকে। সিনেমায় যে অঙ্গভঙ্গিতে গুলি ছোড়ার দৃশ্য দেখা যায়, ওই মিছিলেও দেখা গেছে একই অঙ্গভঙ্গিতে গুলি ছোড়ার দৃশ্য। অপরাধীদের ফিল্মি স্টাইলে প্রকাশ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ওটাই প্রথম বলে জানান ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
ফিল্মি স্টাইল : সম্প্রতি রাজধানীতে সংঘটিত খুন, ডাকাতিসহ প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই ফিল্মি কায়দা লক্ষ্য করা গেছে।
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ফজলুল করিমকে রামপুরার বাসায় ঢুকে হত্যা করেছে অস্ত্রধারীরা। খুনিরা অস্ত্র হাতে দোতলায় উঠে ঢুকে পড়ে ড্রইংরুমে। সেখানেই পর পর কয়েক রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে আবারও অস্ত্র হাতে নেমে আসে। অস্ত্রধারীরা এ সময় প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। গত মাসে সুড়ঙ্গ কেটে কিশোরগঞ্জে সোনালী ব্যাংকের টাকা চুরির ঘটনাটি সিনেমাকেও হার মানিয়েছে।
পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, এমন পদ্ধতিতে ব্যাংক লুটের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। দিনের পর দিন মাটির সুড়ঙ্গ তৈরি করার পর টার্গেট মতে পেঁৗছানো শুধু সিনেমায়ই সম্ভব। অথচ বাস্তবেও এমন রূপ দিয়েছে অপরাধীরা। ছিনতাই, ডাকাতির ঘটনায়ও ফিল্মি স্টাইল যুক্ত হয়েছে। কয়েক দিন আগে পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর রূপসী জুয়েলার্সে দুর্বৃত্তরা ফিল্মি স্টাইলে ডাকাতি করেছে।
দিনদুপুরে তারা বোমা ফাটিয়ে প্রথমে পুরো এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে। এরপর বোমার ভয় দেখিয়ে দোকানের কর্মচারীদের জিম্মি করে ফেলে। এরপর তারা দোকানের স্বর্ণালঙ্কার লুট করে বোমা ফাটিয়ে পালিয়ে যায়। এ ছাড়া রাজধানীতে অধিকাংশ ঘটনাই প্রকাশ্যে শত শত মানুষের সামনে সংঘটিত হচ্ছে। আর প্রতিটি ঘটনাই ঘটছে ফিল্মি কায়দায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।