আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার লেখা একটি শিশুতোষ গল্প --দাদুর লাঠি যাদুর কাঠি

গ্রাম-প্রকৃতি-সবুজ-সারল্য যেখানে মিলেমিশে একাকার, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বার বার।

আমার লেখা একটি শিশুতোষ গল্প --দাদুর লাঠি যাদুর কাঠি

লালু দাদুর সাথে তার নাতীদের সখ্যতা দেখে সবাই মজা পায়। রুমকি, লিটু, দানিয়েল মূলত ওরাই লালু দাদুর নাতীগ্রুপ। আর ওরা তিনজন মনে করে লালু দাদু হচ্ছে ওদের খেলার সাথী। মিলেমিশে চার বন্ধুর একটি দল।

পড়াশুনা, খেলাধূলা, গল্প-আড্ডা সবকিছুতে চারজন একাত্মা। পড়াশুনার প্রসংগ যখন এসেই পড়ল তখন বলে রাখি যে, এদের মধ্যে স্কুলে যায় রুমকি আর লিটু। দানিয়েল এখনও স্কুলে যাবার বয়সে পা রাখেনি। আর লালু দাদু ! বয়স সত্তর তো হবেই। সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন না।

তাই লাঠি ভর করে হাঁটেন। তবে মনের দিক থেকে তিনি ওদের তিনজনের মতো শিশু। তাই সহজেই রুমকি. লিটু ও দানিয়েলের বন্ধু হয়ে উঠেছেন তিনি।


লালু দাদুর সাথে সময় কাটাতে ওরা তিনজন কিন্তু খুব মজা পায়। দাদু কত মজা করে সুন্দর সুন্দর গল্প বলেন ! ওরা হা করে শুনে সেসব গল্প।

তবে লালু দাদু যখন তার মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর গল্প বলেন তখন কেমন যেন আনমনা হয়ে যান। গল্প শেষ করে দাদু বলেন,
তোরা কিন্তু মনে রাখবি এটা কোন বানানো গল্প নয়, সত্য ঘটনা।
ওদের তিনজনের মধ্যে রুমকি সবচেয়ে বড়। বয়স সাত/আট বছর হবে। ওর ভিতর অজানাকে জানার দ্বারগুলো খুলতে শুরু করেছে।

তাই দাদুর কথার পিঠে সে সাথে সাথে প্রশ্ন করে,
তার মানে তুমি মুক্তিযুদ্ধ করেছ দাদু। তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধা।
হ্যাঁ রে দাদু। তুই ঠিকই বলেছিস।
সাথে সাথে রুমকি উঠে দাঁড়িয়ে দাদুকে একটা স্যালুট দেয়।

লালু দাদু অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন,
দাদুভাই, এটা তুই কোত্থেকে শিখলি ? কে শেখাল তোকে ?
রুমকি জবাব দেয়, আমার টিচার শিখিয়েছে। বলেছে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সব সময় সম্মান দেখাতে হয়। আর তাদেরকে সম্মান দেখানোর সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে এটি। এর মধ্য দিয়ে নাকি আমাদের দেশ ও পতাকাকেও সম্মান দেখানো হয়।

রুমকির কথায় লালু দাদুর চোখ দুটি আবেগে ঝাপসা হয়ে আসে।

তিনি ডান হাতের পিঠ দিয়ে চোখ দুটি মুছে ফিরে তাকান রুমকির দিকে। এবং সাথে সাথে আরও বেশী অবাক হয়ে যান। কারণ, ততক্ষণে লিটু এবং দানিয়েলও স্যালুট দেয়ার ভঙ্গিতে দাদুর দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। লালু দাদু আর নিজকে সামলাতে পারেন না। দু’হাত বাড়িয়ে ওদের তিনজনকে বুকের মধ্যে টেনে নেন।

তারপর চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেন ওদের ছোট্ট মুখগুলো। তার চোখের পানির ভেজা ষ্পর্শ এসে লাগে ওদের চোখে-মুখে।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে লালু দাদুর স্ত্রী নুরী দাদু এই দৃশ্য দেখছিলেন। লালু দাদু এতক্ষণ সেটা খেয়াল করেননি। তার আত্মমগ্নতা কাটে নুরী দাদুর কথা শুনে।

নুরী দাদু বলেন,
দেখলে তো নিজকে লুকিয়ে রাখতে পারলে না ? বেরিয়ে তোমাকে আসতেই হলো।
লালু দাদু তার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে একটুখানি মুচকি হাসেন। তার অশ্র“ভেজা মুখের এই একটুখানি হাসিতে যেন উড়ে যায় এতদিনের সমস্ত রুদ্ধ বাস্পতাপ। নুরী দাদু সেটা বুঝতে পারেন। এগিয়ে এসে লালু দাদুর মাথায় আলতো করে একটা হাত রেখে বলেন,
আজ আর না করোনা গো।

দেখাওনা তোমার লাঠির সেই যাদুটা। আমার মনে হয় আজই এটার উপযুক্ত সময়।
কিন্তু ------। আমি তো অনেকদিন ধরে ---------।
লালু দাদুকে কথা শেষ করতে দেননা নুরী দাদু।

এখানেই থামিয়ে দিয়ে বলেন,
আজ যদি তুমি না বলো তাহলে এদের প্রতি তোমার অবিচার করা হবে। আমার মনে হয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এতদিন ধরে তুমি যে বঞ্চনার শিকার হয়েছ তার অনেকটাই পুষিয়ে দিয়েছে আজ ওরা তিনজন। এরচেয়ে বেশী আর তুমি কিছু চেয়োনা গো। বরং এখন তোমার এদেরকে প্রতিদান দেবার পালা।
নুরী দাদুর কথায় লালু দাদু বলেন, তুমি ঠিকই বলেছ নুরী।


রুমকি, লিটু, দানিয়েল এতক্ষণ তাদের দুই দাদুর কথা অবাক হয়ে শুনছিল। এবার তিনজনই লালু দাদুকে ছেকে ধরে।
বলনা দাদু, বড় দাদু কি যাদু জানে ! আমরা দেখব।
নুরী দাদু বলেন, হ্যাঁ দেখবে। তোদের বড় দাদুকে বল।

এক্ষুণি দেখিয়ে দিবে।
এক্ষুণি ? তিনজন একযোগে প্রশ্ন করে।
নুরী দাদু বলেন, হ্যাঁ এক্ষুণি। তোরা একটু অপেক্ষা কর।
ততক্ষণে লালু দারু তার হাতে ধরা লাঠিটির উপরের বাঁকা মাথাটি একটু ঘুরান।

অমনি লাঠিটির নিচ দিকে একটি সরু মাথা বের হয়ে আসে। দাদু লাঠির মাথা আরও ঘুরিয়ে নিচের সরু অংশের সম্পূর্ণটা বের করে আনেন। ওরা তিনজন অবাক হয়ে সেই দৃশ্য দেখে। নুরী দাদু বলেন,
তোরা একটু সরে দাঁড়া। তোদের দাদু মাটিতে কি আঁকে দেখ।


তারপর চেয়ারটা এগিয়ে দেন লালু দাদুকে বসার জন্য। দাদু চেয়ারে আরামমতো বসে লাঠির সরু মাথা দিয়ে মাটির উপর একটানে এঁকে ফেলেন বাংলাদেশের একটি মানচিত্র। তারপর এর ভিতর এঁকে দেন বাংলাদেশের একটি জাতীয় পতাকা। রুমকি অবাক হয়ে দেখে তার বড় দাদুর আঁকা মানচিত্রটি হুবহু তার বইয়ে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্রের মতো। লালু দাদু ততক্ষণে লাঠিতে ভর করে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,
সবাই স্যালুট কর আমাদের জাতীয় পতাকাকে।


রুমকি, লিটু, দানিয়েল, ওদের দাদা-দাদু সবাই একসংগে স্যালুট করে বাংলাদেশের মানচিত্রকে। এরপর লালু দাদু আবার চেয়ারে বসে লাঠি দিয়ে দেখান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এই মানচিত্রের কোন কোন জায়গায় যুদ্ধ করেছেন। দাদু একটু থামতেই লিটু প্রশ্ন করে,
এমন করে মানচিত্র আঁকা তুমি শিখলে কি করে ?
সাথে সাথে রুমকি বলে,
হ্যাঁ দাদু। আমি জানি মানচিত্র আঁকা অনেক কঠিন কাজ। কিন্তু তুমি কত সহজে এঁকে ফেললে।

কি করে শিখলে দাদু বলনা ।
লালু দাদু বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদেরকে কত কিছু করতে হতো সে তোরা জানিস না। কোথায় অপারেশান চালাব, কিভাবে কোন পথে যাব ইত্যাদি পরিকল্পনা করার জন্য বাংলাদেশের মানচিত্রটা তখন খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সব সময় হাতের কাছে মানচিত্র পাওয়া যেতনা অথবা একটি মানচিত্র নিয়ে সবাইকে টানাটানি করতে হতো। আমি একাজটি করার জন্য কাঠি দিয়ে মাটি কিংবা বালির উপর বড় করে বাংলাদেশের মানচিত্র এঁকে নিতাম।

সেই থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেও একাজটি করতাম আমি।
এখন কেন করনা দাদু ?
আবার প্রশ্ন করে লিটু। দাদু বলেন,
এখন থেকে ঠি--ক করব। তোদের জন্য বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকব আমি।

কিন্তু খবরদার, কখনও যেন পা দিয়ে মাড়াসনে এই মানচিত্র।
না দাদুভাই, আমরা কখনও তা করবনা। বাংলাদেশের মানচিত্রের মতো তোমার যাদুর লাঠিও আজ থেকে আমাদের কাছে খুব প্রিয়।
কি বললি ? যাদুর লাঠি ?
আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করেন লালু দাদু। রুমকি, লিটু, দানিয়েল তিনজন সমস্বরে জবাব দেয়,
হ্যাঁ দাদু।

তোমার লাঠি যাদুর কাঠি। তারপর তিনজন একযোগে নাচতে নাচতে বলে,
দাদুর লাঠি যাদুর কাঠি। দাদুর লাঠি যাদুর কাঠি।
দাদা-দাদু দু’জনই বিস্ফারিত চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। তাদের দৃষ্টিতে ঝরে পড়ে একঝাঁক আনন্দরাশি।



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.