আমি এক কথার মানুষ। আমার এক মেয়ে। এক বউ। টাকা পয়সা থাকলে আরো কয়েকজন বউয়ে আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু উপায় নেই।
একটা বাচ্চা মানুষ করতে এই দেশে দুই লাখ ইউরু লাগে। জার্মানরা হিসাবে খুব পাকা। বেহিসেবী হতেও পারে না। বাচ্চাও হয় না। আমার হিসাবের ব্যপার নাই।
সমস্যা হল বাচ্চা গুলো লালন পালন নিয়ে। ছেলে হোক মেয়ে হোক, একটি সন্তানই যথেষ্ট। আমার এক কথা।
কিন্তু বউ কইল অন্য কথা। আমরা তো আর মেয়ের সমস্ত জীবন তার জন্য থাকতে পারব না।
কেন, পারব না কেন! বউ মুখ ভেংচি করে বলল; তুমি যদি চাও তোমার মৃত্যুর পরেও মেয়ে বেঁচে থাকুক। তখন তো ও একা হয়েই বেঁচে থাকবে, নাকী! কেন আমার মেয়ে একা থাকবে কেন! তার বন্ধু হবে, স্বামী সন্তান নিয়ে থাকবে। আমার সর্টকাট জবাব। তোমার আমার বাপ মা ভাই বোন আছে । তাদের সাথে আমরা ঝগড়া করি গলাগুলি করি।
সুখ-দুঃখের আনন্দ বেদনা ভাগ করি। যদি ধরে নেই আমাদের মেয়ে এই দেশেই থাকবে, তা হলে আমরা মারা গেলে সেই দুঃখ ভাগ করার তো তার কেউ থাকবে না।
কথা সত্য! এখন উপায়!
নিরুপায় যখন উপায়ের সন্ধান পেল; তখন বউ বলে; আমাকে দিয়ে তুমি অনেক কাজ করিয়েছ। এখন আমার শরীর ভারী। তোমার ধারি মেয়েটাকে নিয়ে আমি ঘর পরিস্কার, রান্না/বান্না করতে পারব না।
এ দেখি আরেক বিপদ। তারপর সে নিজেই উপায় বলে দিল; কয়েদিন দেশে থেকে আসি। মেয়েটা বাংলা শিখবে ভাল করে। আমি বললাম ব্যবস্থা মন্দ না। কিন্তু চারু তো দুনিয়াতে এসে সে সব বাংলা ভুলে যাবে।
চারুর কথা হচ্ছে না। আঁচলের কথা বলছি। ও, আচ্ছা। আঁচল তো বাংলা বলতেই পারে। ওর তো এখন জার্মান শেখা দরকার।
অনেকেই বলেছিল; আমি যেন আঁচলের সাথে জার্মান বলি। আমার জার্মান বাংলার চেয়ে ভাল না। গুরু বলে গেছেন “ যে নিজের মাতৃভাষা ভাল জানে না, তার পক্ষে ভাল করে একটি বিদেশী ভাষাও বলা সম্ভব না”। আমি জানি কথাটা কতো কঠিন সত্য। সে জন্যই মেয়ের জার্মান শেখার দায় দিয়েছি কিন্ডার গার্টেনকে।
তো এখন সে জার্মান তার বয়সী বাচ্চাদের মতই বলতে পারে। তার কী হবে!
আমি যুক্তি তর্কে বন্ধু-বান্ধবদের সাথেই পারি না! বউয়ের সাথে পারব! সে যখন যুক্তি দিল; তুমি বলেছ; “বাচ্চারা মায়ের পেটে থাকতেই শেখা শুরু করে”। তাহলে বিনে পয়সায় ভ্রমনের এবং শিক্ষার মতো একটা সুযোগ থেকে মেয়েকে বঞ্চিত করছ কেন?
ডাক্তার বলে দিল; সাত মাসের মাথায় দেশ থেকে চলে আসতে হবে। তার পরে আর প্লেনে উঠা যাবে না। সেই ভাবেই টিকেট কাটা হল।
আনার জন্য গেলাম আমি। ছুটি বেশী ছিল না। প্লেনে উঠার আগেই শুভর পেটের সব খাবার বের হয়ে গেল। আঁচল মশার কামড়ে কাহিল। হাতে পায়ে ফোড়ার মতো ফুলে আছে মশার কামড়।
আনিস ভাই বাড়ি পৌঁছে দিল। এখানে এসে চারুর জন্য ট্রলি কিনতে আমরা গেলাম একটা মার্কেটে। বমি করতে শুভ বের হল বাইরে। শীত প্রচণ্ড। হল সর্দি।
সে কী কাশি!
গেলাম হাসপাতালে। ডাক্তাররা বলল; থাকতে হবে। হবু মার কত রকমের অসুবিধা হতে পারে। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকবে শুভ। কী বিপদ।
আমার তো ছুটি নেই। আঁচল থাকবে কার কাছে, কোথায়। কিন্তু আঁচলের কোথাও যাওয়ার দরকার হল না। গাড়িতে বসেই কাশি। বাড়ি এসে শুরু করলাম বাপ-বেটী কাশির কোরাস।
হায়রে কাশি। হায়রে জ্বর। কে কাকে আশা দেবে! কে কাকে ভরসা দেবে। আনিস ভাই, ঊশী ভাবী শুভকে দেখতে গেল হাসপাতালে। বাসায় গিয়ে তাদেরও কাশি।
সপ্তাহ খানেক পরে অবস্থা একটু ভাল হল। কিন্তু আমার কাশি ভয়ঙ্কর। কাশতে কাশতে ফুসফুসের ধাকায় পাজরে ঘা।
আবার ওষুধ। এন্টিবায়োটিক মনে হয় আমরাই শেষ করে ফেলেছি।
বাসা ওষুধের দোকান। কার কখন কী ওষুধ খেতে হবে রীতিমতো লিখে রাখতে হয়। এর মধ্যে শুরু হল শুভর কান ব্যাথা। এমন ব্যাথা যে সে শিশুর মতো চীৎকার করে কাঁদে। আবার হাসপাতাল।
আবার থাকতে হবে। এদিকে আঁচলের দাত খেয়ে ফেলেছে পোকায়। শিশুদের দাঁতের চিকিৎসা করতে হয় অজ্ঞান করে অপারেশনের মতো। আগে থেকে এপোয়েন্টমেন্ট নিয়ে। শুভর কান ব্যাথা কমল।
সবাই মিলে আঁচলকে নিয়ে গেলাম দাঁতের হাসপাতালে। দাঁতে ক্ষয় অংশ কেটে একটা ধাতব পাত বসিয়ে কয়েক ঘন্টা পরে বাড়ি আসার অনুমতি পাব। অজ্ঞান করার টেবিলে বসে রইলাম আমি একা। আঁচল ঘুমিয়ে গেল। আমি বের হলাম।
শুভ উদ্ভিগ্ন। আঁচলের কুশল জেনে বাথরুমে গেল। ফিরে এসে বলল; আঁচলের আব্বু, প্রস্রাবের সাথে কেমন যেন আঠার মতো বের হচ্ছে।
আমি বুঝে গেছি; আঁচলের কুশল জানার জন্য চারুও আসতে চাইছে। সময় কতটুকু পাব কে জানে! কিন্তু আঁচলকে এখানে রেখে চারুকে প্রসব করার জন্য শুভকে হাসপাতালে নিয়ে যাই কী করে! যা করে মালিকেই করবে।
আঁচলকে নিয়েই যাব। চারু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আর বিলম্ব নেই, সে কথা শুভকে বললাম না। ঘন্টা খানেক পরে ডাক্তার ডাকল আমাকে। আঁচল ঘুমে, তার দাঁত দেখলাম চকচকে ধাতব।
আঁচল আড়মোড় দিয়ে জেগে উঠল।
গাড়ি ছাড়লাম হাসপাতালের দিকে। শুভ অবাক। কী হয়েছে আমার? কিছু না। কী হয়, না হয়, বলা তো যায় না। তাই হাসপাতালে তোমাকে একবার দেখিয়ে আনি।
আঁচল এই হাসপাতাল চিনে আমাদের ঘরের মতই। বাবার সাথে ঘুমানোর অভ্যাসও তার হয়ে গেছে। শুধু মাঝ রাতে উঠে জিজ্ঞেস করে; বাবা মা কোথায়? হাসপাতালে। আমার জবাব শুনতে শুনতে মা দোকানে কিছু কিনতে গেলেও আঁচল জিজ্ঞেস করে; বাবা, মা হাসপাতালে গেছে?
ডাক্তাররা বলল; তোমার মেয়ে আসছে তবে তাড়াহুড়ার কিছু নেই। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে; রাতের আগে সে আসবে না।
হায় হায়, আমি কোন মেয়ের কাছে থাকব! আঁচলকে একা বাসায় রেখে চারুর কাছে! আঁচলকে নিয়ে বাসায় থাকব; এই সময়ে শুভ আর চারুকে একা রেখে!
আনিস ভাই আর ঊশী ভাবী অভয় দিয়ে বলল; তাঁরা রাতে আমাদের বাসায় এসে থাকবে আঁচলের সাথে। অন্য এক জার্মান প্রতিবেশী আঁচলকে কিন্ডার গার্টেন থেকে বাসায় পৌঁছে দিত। তিনিও বললেন; আঁচলের সাথে থাকবেন। তিনি যেহেতু কাছেই থাকেন আবার সকালে আঁচলকে কিন্ডার গার্টেনে পৌঁছে দেবেন, তার কাছেই আঁচল থাকুক, সিধান্ত নিলাম।
গভীর রাতে সব যন্ত্রনা আনন্দে পূর্ণ করে দিল চারু।
কোন অভিযোগ, কোন কান্না-কাটি নেই তার। মা মেয়েকে ডাক্তারদের জিম্মায় রেখে এলাম বাসায়। দেখি ভদ্র মহিলা আঁচলকে রেডি করেছে কিন্ডার গার্টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আঁচলের চেহারা দেখে বোঝা যায় বেচারীর ভাল ঘুম হয়নি। জার্মান ভদ্র মহিলার নাম বালি।
তাকে বললাম; আঁচলকে আমিই পৌঁছে দেব। তিনি চলে গেলেন। নাস্তা কফি খেয়ে বাপে ঝিয়ে আরেক দফা ঘুম দিলাম।
দুপুর পার করে পরিকল্পনা মতো সব জিনিস নিয়ে বাপ বেটী হাজির হলাম হাসপাতালে। দেখ আঁচল তোমার জন্য এই বাবুটা এনেছে মা।
দেখ বাবা; সু নিদলিখ ( কী মিষ্টি)! আমার মিষ্টি মেয়েটা জন্মের আগে মায়ের যে অসুখ গুলো ছিল তার সব গুলো ভোগ করল! আরো কঠিন ভাবে। সব জ্বরাব্যধি যেন আমার মেয়েদের জন্য আজীবন অতীত হয়ে থাকে। আঁচলের পাঁচ হল পাঁচই জানুয়ারী। চারুর প্রথম বর্ষপূর্তি আজ, সাতই মার্চ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।