আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নজরুলসংগীত ও শাস্ত্রীয় সংগীতের খ্যাতিমান শিল্পী সোহরাব হোসেন আর নেই ।। রেজা ঘটক

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা... নজরুলসংগীত ও শাস্ত্রীয় সংগীতের খ্যাতিমান শিল্পী সোহরাব হোসেন আর নেই । । রেজা ঘটক .................................................................................... নজরুলসংগীত ও শাস্ত্রীয় সংগীতের খ্যাতিমান শিল্পী সোহরাব হোসেন আর নেই। আজ সকাল ৬টার দিকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।

তিনি ডায়াবেটিকস, হৃদরোগ, ফুসফুস, কানের প্রদাহ এবং বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছিলেন। তাঁর মেয়ে নজরুলগীতি শিল্পী রাহাত আরা গীতি বলেন, ২৯ নভেম্বর বৃকে ব্যথা অনুভব করার পর বাবাকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রফেসর ডা. জাহাঙ্গীর আলমের তত্ত্বাবধানে ডা. জামিল বাবার চিকিৎসা করছিলেন। আজ সকাল ৬টার দিকে তিনি মারা যান। সোহরাব হোসেনর মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার আব্দুল হামিদ খান, ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।

এছাড়া সঙ্গীত শিল্পী সুধীন দাশ বলেছেন, সোহরাব হোসেনকে হারিয়ে আমার শিল্পী-জীবনের শেষ বন্ধুকে হারালাম। ১৯৪৮ সালে রেডিওতে গান করা থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্ত আমাদের এ বন্ধুত্ব অমলিন ছিল। আমরা দু'জন অনেক সুখ-দুঃখের সঙ্গী ছিলাম। সোহরাব হোসেনের মতো এত প্রাণবন্ত ও প্রাণোচ্ছল মানুষ আমার জীবনে দেখিনি।

তাঁর মৃত্যুতে একটা যুগের অবসান হলো। নজরুল সংগীতে এমন সুরেলা কণ্ঠ আর আসবে কিনা আমার সন্দেহ রয়েছে। ১৯২২ সালের ৯ এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার রানাঘাটের আয়েসতলা গ্রামে সোহরাব হোসেনের জন্ম। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে নানা তমিজউদ্দিন মিয়ার কণ্ঠে- ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গানটি শুনেই সঙ্গীতের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। রানাঘাটের সংগীত শিক্ষক জয়নুল আবেদীনের কাছে মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি গান শিখতে শুরু করেন।

গান শিখতে শিখতেই এক সময় তিনি জমিদার ক্ষীরোদ পাল চৌধুরীর নজরে পড়েন। পরে ক্ষীরোদ পাল তাঁর দায়িত্ব নিয়ে কিরণ দে চৌধুরীর কাছে গান শেখার ব্যবস্থা করে দেন। এরপর শিক্ষক কিরণ দে চৌধুরীর সহায়তায় কলকাতায় গিয়ে শ্রীরঙ্গম থিয়েটারে মাসে ১২ আনা বেতনে গান গাওয়ার কাজ শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের সঙ্গে পরিচয় হয় সোহরাব হোসেনের। তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বলে সরকারের প্রচার বিভাগে সোহরাব হোসেনকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেন আব্বাসউদ্দীন।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে আব্বাসউদ্দীনের কাছে সংগীত এবং ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুর কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিতে থাকেন সোহরাব হোসেন। ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা, কমলা ঝরিয়ার মতো ভারতের অনেক গুণী শিল্পীর কণ্ঠে খুব কাছ থেকে নজরুল সংগীত শোনার সুযোগ পেয়েছেন সোহরাব হোসেন। পরে তিনি প্রখ্যাত শিল্পী গিরীণ চক্রবর্তী ও সুধীর লাল চক্রবর্তীর কাছেও নজরুলগীতি ও আধুনিক গানের তালিম নেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতা বেতারে প্রথম গান করার সুযোগ পান সোহরাব হোসেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরের বছর ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকায় স্থায়ীভাবে চলে আসেন।

ঢাকার ৪১ জিন্দাবাহার লেনের একটি বাড়িতে বাসা ভাড়া নেন। আর চাকরি নেন তথ্য অধিদপ্তরে। পাশাপাশি শুরু বরেন রেডিওতে অনুষ্ঠান এবং ছাত্র পড়ানোর কাজ। আব্বাউদ্দীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে গান করেছেন সোহরাব হোসেন। নজরুলের অনেক গান তাঁর কণ্ঠে পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা।

এছাড়া তিনি সঙ্গীত জীবনে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ, শচীন দেব বর্মন, অঞ্জলি মুখোপাধ্যায়ের মতো গুনি শিল্পীদের সাহচার্য লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে সোহরাব হোসেনের গানের প্রথম অ্যালবাম বের হয়। এছাড়া তিনি অসংখ্য চলচ্চিত্রে প্লে ব্যাক করেছেন। মাটির পাহাড়, শীত বিকেল, এ দেশ তোমার আমার, গোধূলির প্রেম, যে নদী মরুপথেসহ অসংখ্য চলচ্চিত্রে তাঁর গানগুলো আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। বাংলাদেশে নজরুল সংগীত চর্চার বিকাশেও তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

তাঁর কাছে সঙ্গীতে তালিম নিয়ে বাংলাদেশে অনেক গুনি শিল্পী সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর সরাসরি সঙ্গীতছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন আতিকুল ইসলাম, সানজীদা খাতুন, ইসমত আরা, রওশন আরা মাসুদ, রওশন আরা মোস্তাফিজ, জেবুন নেছা জামাল, আবিদা সুলতানা, রেবেকা সুলতানা, শবনম মুস্তারী, পারভীন মুস্তারী, সাবিয়া মাহবুব, সাদিয়া মল্লিক, শাহিন সামাদ, কমল রডরিকস, রফিকুল ইসলাম, আবদুল লতিফ, এম এ মান্নান, খায়রুল আনাম শাকিল প্রমুখ। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে সুরের মুর্ছনা ছড়িয়েছেন সোহরাব হোসেন। এছাড়া তিনি সংগীতে অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদক ও নজরুল একাডেমী পদকসহ বহু সম্মাননা পেয়েছেন। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি এ দুটো মাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।

এছাড়া তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, ছায়ানট, শিল্পকলা একাডেমী ও নজরুল একাডেমীতে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নজরুল ইনস্টিটিউটে তিনি শিক্ষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। এছাড়া তিনি নজরুল-সংগীত প্রামাণীকরণ পরিষদ ও নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডে সদস্য এবং ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। সোহরাব হোসেনের দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে রওশন আরা সোমা ও রাহাত আরা গীতি বাবার মতোই নজরুলসঙ্গীত শিল্পী। পারিবারিকভাবে জানানো হয়েছে, এক ছেলে বিদেশে থাকেন, তিনি ফেরার পরেই দাফনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।