মাসের প্রথম সপ্তাহে এটি প্রতিদিনের চিত্র বলে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এই ভিড়ে যারা থাকছেন, তারা কেউ পরিবার সঞ্চয়পত্রের মাসিক মুনাফা তুলছেন, অন্যরা নতুন কেনা সঞ্চয়পত্রের টাকা জমা দিচ্ছেন।
জমা টাকা যে কোনো ব্যাংকে রাখার চেয়ে পরিবার সঞ্চয়পত্রে রাখলে বেশি সুদ পাওয়া যায় বলে অনেক নারীই ঝুঁকছেন এর দিকে।
এদেরই একজন মনোয়ারা ইশরাত, গৃহিনী; এসেছেন মিরপুর থেকে। স্বামীর জমানো টাকা দিয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি ৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন তিনি।
“সেটারই তিন মাসের মুনাফা একসঙ্গে তুলতে এসেছি। ২৪ হাজার টাকার মতো পেয়েছি,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন তিনি।
শুধু নারীদের জন্য এই পরিবার সঞ্চয়পত্র চালু হয় ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকার আমলে। এরপর বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার তা বন্ধ করে দিলেও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় চালু করা হয়।
বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হারই সবচেয়ে বেশি, প্রায় ১৩ শতাংশের মতো।
ফলে মনোয়ারার মতো অনেক নারীই সরকারের দেয়া এই বিশেষ সুবিধা নিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনছেন।
নির্দিষ্ট আয়ে সংসার চালানো মনোয়ারা বলেন, “স্বামীর চাকরির বেতন দিয়ে বাসা-ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ চালাই। সঞ্চয়পত্রের লাভ দিয়ে ছেলেমেয়ের পড়া-লেখার খরচ হয়ে যায়। মূল টাকা তো থেকেই গেল। ”
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রতি দিন চার-পাঁচশ’ নারী পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তুলে থাকেন।
এক-দেড়শ’র মতো নতুন সঞ্চয়পত্র কেনেন।
সঞ্চয়পত্রের দিকে মানুষ ঝুঁকে পড়ায় চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ গুণ বেড়েছে।
ঝুঁকিমুক্ত বলেই মানুষ এখন সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত।
ফরাসউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমিয়ে আনায় এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দা পরিস্থিতি থাকায় ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ হিসাবে পরিচিত সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেড়েছে। ”
একই কারণ দেখিয়ে জায়েদ বখতও বলেন, “মানুষ এখন একটু বেশি মুনাফার আশায় নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র কিনছে।
”
সঞ্চয় বিক্রি বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে
মনোয়ারা ইশরাতের মতো দেশের অনেক নারীই মহিলাই এখন আকর্ষণীয় মুনাফার কারণে পরিবার সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন। আর এ কারণেই এর বিক্রি বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ছিল ৫ হাজার কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ গুণ বেশি।
২০১২-১৩ অর্থবছরে পুরো সময়ে (১২ মাস) যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, এবার সাত মাসের অঙ্কই তার সাড়ে ছয় গুণ। এর আগে ২০১১-১২ অর্থবছরে ৪৭৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল।
নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মোট পরিমাণ থেকে আগের বিক্রিত সঞ্চয়পত্রের নগদায়নের পরিমাণ বাদ দেয়ার পর অবশিষ্টাংকে সঞ্চয়পত্রের প্রকৃত বিক্রি বলা হয়। নগদায়নের ক্ষেত্রে গ্রাহককে সুদসহ আসল পরিশোধ করা হয়।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে যেসব সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার ৮০ শতাংশই পরিবার সঞ্চয়পত্র। ১৫ শতাংশ পেনশনার সঞ্চয়পত্র এবং বাকি ৫ শতাংশ অন্যান্য সঞ্চয়পত্র।
পরিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ৬২৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, অগাস্টে ৬৯১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, সেপ্টেম্বরে ৭৮০ কোটি ৭০ লাখ টাকা, অক্টোবরে ৬০১ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৯০৯ কোটি ১৮ লাখ এবং ৯৫৭ কোটি টাকা।
জানুয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১২৬ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের জানুয়ারি মাসে বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৮৫ কোটি টাকা।
ফরাসউদ্দিন বলেন, “সাধারণত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে থাকে।
সে কারণেই এই সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বেশি হচ্ছে। ”
সরকারের ঋণের চাপ ‘কমাবে’
বিক্রি বাড়ায় চলতি অর্থবছরে (২০১৩-১৪) সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ‘ঋণ’ নেয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল, সাত মাসেই তার চেয়ে বেশি ঋণ নিতে পেরেছে।
আর এর ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাতে সরকারকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে তেমন ঋণ করতে হচ্ছে না বলে মনে করেন সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন।
চলতি বাজেটে ঘাটতি মেটাতে জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্পগুলো থেকে ৪ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা ধার নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল সরকার। সঞ্চয়পত্রের বিক্রি থেকে সাত মাসেই এসেছে ৫ হাজার কোটি টাকা।
জায়েদ বখত বলেন, “এটা একটা ভালো দিক। সরকার এই খাত থেকে ঋণ নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে। গত দুই-তিন বছরের মতো ব্যাংক ঋণের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করতে হবে না। ”
এই অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৫ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম সাড়ে সাত মাসে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৩ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা।
ফরাসউদ্দিন বলেন, “জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতি গত কিছুদিন কিছুটা ধীর ছিল। সে কারণে সরকারের খরচও কম ছিল।
“যে অর্থের প্রয়োজন ছিল, তার একটি বড় অংশ সঞ্চয়পত্র থেকে পাওয়ায় সরকারকে আর ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে খুব বেশি ঋণ নিতে হয়নি। ”
২০১২-১৩ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ২৩ হাজার কোটি টাকা ধার করবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল।
অর্থবছর শেষে তা সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ২৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছিল।
ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ নেয়া প্রভাব পড়ে বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। সেজন্য সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বছরজুড়েই উষ্মা প্রকাশ করে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।