আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিগত চারশ বছরে ঢাকার বন্যপ্রাণী ( ১৬০৮ – ২০০৮)

বিগত চার শতাব্দী ধরে ঢাকা নগরীর অধিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নানা ধরনের বুনো প্রাণীর অস্তিত্বের জড়িয়ে আছে ওতপ্রোত ভাবে, যার মাঝে কিছু প্রাণী মানববিশ্বে ভয়াবহ বিপদজনক বলেই পরিচিত। যদিও কয়েক শত বছরে ক্রমবর্ধমান শহর তাকে ঘিরে থাকা বুনোজগতের অস্তিত্বকে কোণঠাসা করে ফেলেছে ক্রমাগত। বুড়িগঙ্গার তীরে অল্প কয়েকজন মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে স্থাপিত ঢাকা নগরী সতের শতকেও বিশাল অরণ্যে পরিপূর্ণ ছিল, বিশেষ করে শহরের উত্তরপ্রান্তে।
শহরকেন্দ্রের উত্তর দিকে মিরপুর, কুর্মিটোলা, পল্টন এবং তেজগাঁও নামের চার দুর্ভেদ্য জঙ্গল ছিল। নদী তীরের দক্ষিণে ছিল কামরাঙ্গির চর নামের এক বিস্তৃত বাদাবন।

সেইখানের বাসিন্দারা বাঘ, অজগর সহ অন্যান্য প্রাণীপূর্ণ অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলেন। কালের স্রোতে কয়েকশ বছর পরেও স্থানগুলির নাম অবিকৃত ভাবে টিকে আছে কিন্তু সেগুলো আর মানুষের মনে ভয়াল প্রাণীময় ঘন জঙ্গলের আতঙ্ক ছড়ায় না।
আধুনিক ঢাকার একজন বাসিন্দা হিসেবে সেই বিগত সময়ের বুনো জীবনের গল্প হয়ত অতীতের বাসিন্দাদের চিন্তাধারার সাথে খাপ খায় না। তাই আমাদের গল্প বলা হয়েছে বর্তমান মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী ও মূল্যবোধ থেকে বেশ খানিকটা দূরে সরে যেয়ে। বর্তমানে একটি বুনোপ্রাণী টিকে থাকার অধিকার নিয়ে আমরা যেভাবে সরব তা সেই ধূসর অতীতে এমন ধারণাও নিঃসন্দেহে অবিশ্বাস্য ছিল।

ক্রমবর্ধমান শহরের অনেক অঞ্চলে মানুষ বন কেটে সাফ করে ফেলার সাথে সাথে অনেকেই জীবিকার জন্য বুনো প্রাণীর সাথে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে লিপ্ত ছিলেন। যে প্রাণীদের প্রায় পাশাপাশি থেকে তাদের জীবন অতিবাহিত হত আজ তাদের জাতেরা থাকে শহর থেকে বহু দূরের অভয়ারণ্যে। ঢাকার গত কয়েক শতকের যে জীবজগতের গল্প আমরা শোনাব তা আসলে কিছু ভয়ংকর , মানুষের জন্য বিরক্তি উদ্রেককারী প্রাণীর গল্প আর গুটিকয়েক ক্ষতিকারক জীবের, যা আজকের পৃথিবীর প্রকৃতি প্রেমিক এবং বুনো প্রাণীর প্রতি ভালবাসা লালনকারীদের জন্য অস্বস্তির কারণ হতেও পারে।
আমাদের বর্ণনায় সাধারণ ইংরেজি এবং বাংলা নাম ব্যবহার করা হয়েছে, যা এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষেও আছে।
স্তন্যপায়ী প্রাণী
---ভয়ংকর প্রাণী
---- বড় বেড়ালেরা
অবিশ্বাস্য শোনালেও সতের শতকেও ঢাকার আশেপাশের বনাঞ্চলে বেশ কিছু বাঘ এবং অসংখ্য চিতাবাঘ ছিল।

যদিও ঢাকার অধিকাংশ বাসিন্দারা বিশাল, রোমশ, ডোরাকাটা নিশাচর, আলসে, মুখচোরা প্রাণীটির দর্শনের চেয়ে রাতের আঁধারে ভেসে আসা বাঘের গর্জনের সাথেই বেশী পরিচিত ছিলেন। তার চেয়ে হালকা, সরু গড়নের ফোঁটা ফোঁটা দাগওয়ালা চিতাবাঘের সাথেই বরং মানুষের মোলাকাত বেশী হত যারা কিনা মাঝে মাঝেই দিনের বেলাতেই গৃহপালিত কুকুর, ছাগল ইত্যাদি শিকার করত। মানুষ সাধারণত বাঘ এবং চিতাবাঘের পার্থক্য করতে পারত না, তাই উভয়ের নামই ছিল বাঘ। বাঘের গল্প প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসত অব্যাহত ভাবে, ভূতের গল্পের মত তা মানুষের মনে রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে যেত।
প্রাচীন নগরীর সব বাসিন্দাই সেই দুই ধরনের গল্প জানতেন।

বনের বাঘের চেয়ে গল্পের বাঘই মানুষের মনে বেশী ভীতির উদ্রেক করত। তবে সব গল্পই পুরোপুরি আষাঢ়ে নয়। সেই সময়ে বাঘ কেবলমাত্র সুন্দরবনে আবদ্ধ ছিল না, সারা দেশেই ছড়িয়ে ছিল। মানুষ এবং বাঘের মুখোমুখি হওয়া খুব বিরল কিছু ছিল না। পুলিশের খাতা ঘেটে দেখা গেছে ১৮৩৭ সাল পর্যন্তও ঢাকায় প্রতি বছর কমপক্ষে এক জন মানুষ বাঘের হাতে নিহত হয়েছে।



দ্রুত বেড়ে ওঠা মানব বসতি যেন বাঘের ভয় মুক্ত থাকে সেই জন্য চেষ্টার অন্ত ছিল না, বাঘ শিকারের জন্য শিকারিদের মতা পুরস্কার দিয়ে আকৃষ্ট করা হত। একইসাথে বিক্রম দেখানোর, জনসেবা করার এবং ট্রফি সংগ্রহের সুযোগ হিসেবে গণ্য করা হত বাঘ শিকার। মুঘল আমলে বেতন দিয়ে শিকারি রাখা হত। ব্রিটিশ আমলে বাঘ শিকারের জন্য পুরস্কার ঘোষিত ছিল। মাত্র চারশ বছরে বাঘের সংখ্যা কেন এমন অবস্থায় আসল তা নিয়ে খুব বিস্ময় প্রকাশের কিছু নাই।

সরকারি হিসেব মতে দেখা গেছে ১৮০৪ সালে ২৭০টা বাঘের চামড়া শিকারিরা সরকারের কাছে দিয়ে পুরস্কার নিয়ে গিয়েছিল, অথচ মাত্র একশ বছর পরেই ১৯০৭- ১৯১০ পর্যন্ত মাত্র তেরটি বাঘের ছাল জমা পড়ে। সব বাঘ অবশ্য শহরের আশে পাশে শিকার হয়েছিল না নয় , বরং পুরস্কারের লোভে কিছু কিছু অনেক দূর থেকেও আনা হয়েছিল।
সতের – উনিশ শতক পর্যন্ত কেবলমাত্র বিষ মাখানো তীর দিয়েই স্থানীয় শিকারিরা যে সংখ্যক চতুর বেড়াল শিকার করতে সক্ষম হয়েছিল তা কেবলমাত্র বিস্ময়ের জোগান দেয়। যেহেতু সরকারি পুরস্কারের তালিকায় চিতাবাঘের নামও ছিল, শিকারিরা এক পর্যায়ে আবিস্কার করে যে বাঘ শিকারের চেয়ে চিতাবাঘ মারা অনেক সহজ। ফলে শিকার চলতে থাকে।

এমনকি ১৯১০ সালেও ২৬টি চিতাবাঘের ছাল জমা পড়েছিল পুরস্কারের জন্য। কালো মদ্দা চিতাবাঘের ( যা কিনা ব্ল্যাক পান্থার নামে পরিচিত, জিন ঘটিত কারণে মেলানিন যে চিতাবাঘ কিছুটা কালচে বা পুরোপুরি কালো হয়) চামড়ার একটা আলাদা খাতির ছিল, যদিও তার জন্য বিশেষ কোন অর্থ বরাদ্দ ছিল না। ১৯১৫ সালেও কামরাঙ্গির চরে একটি চিতাবাঘ মারা হয়েছিল বলে জানা যায়। রয়েল বেঙ্গল বাঘের চেয়ে ঢাকার চিতাবাঘেরা শিকারির থাবা এড়িয়ে কয়েক বছর বেশীই টিকে ছিল। মিরপুর এবং কুর্মিটোলার বনে গত শতকের প্রথম চতুর্থাংশ পর্যন্ত কয়েকটি চিতাবাঘ ছিল বলে জানা গেছে।

তবে পরবর্তীতে চিতাবাঘের পরিণতিতে তা কোনই ভূমিকা রাখতে পারে নি। যেখানে সুন্দরবনে অন্তত কয়েকশ বাঘ এখনো বর্তমান, সেখানে সারা দেশে চিতাবাঘের সংখ্যা শূন্যের কাছাকাছি। এর মূল কারণ হিসেবে বলা যায় বাঘ যেমন তাদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে সুন্দরবন পেয়েছে, চিতাবাঘ মানুষের জন্য অগম্য তেমন কোন জায়গা খুঁজে পায় নি ।
বেড়াল পরিবারের বাকি সদস্যগুলো ভীতিকর ছিল না কখনোই, বরং বলা চলে নিরব পর্যটক ছিল ঢাকার। যে চার ধরনের ক্ষুদে বেড়াল ঢাকার বন ও বাদাতে থাকত তারা হচ্ছে মেছো বিড়াল (Fishing Cat), চিতা বিড়াল(Leopard Cat),বনবিড়াল(Jungle Cat), সোনালি বিড়াল(Asian Golden Cat)।

ঢাকায় তাদের থাকার সপক্ষে প্রমাণ-উপাত্ত যথেষ্ট সন্দেহপূর্ণ, মানুষ তাদের যেহেতু প্রায়ই বাঘ বলে সম্বোধন করে ফলে আসল বাঘের সাথে গুলিয়ে যায়। বিশেষ করে একটু বড় আকৃতি মেছো বিড়ালকে ভুল কারণবশত মানুষ বাঘ বলেই মনে করে। আকারে ছোট হবার কারণে নিশাচর এই শিকারি প্রাণীগুলো শহরতলির আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জঙ্গল এবং জলাভূমিতে সহজেই টিকে থাকতে পারে।

বনবিড়াল(Jungle Cat)
বন্য শূকর
গত শতাব্দীর প্রথম দিকে বন্য শূকর ( গৃহপালিত শূকরের পূর্বপুরুষ) ছিল শহরের প্রান্তে যেতে নানা কারণে যেতে বাধ্য হওয়া মানুষদের কাছে এক বিভীষিকাময় নাম। পল্টন, কুর্মিটোলা এবং মিরপুরের জঙ্গলে ছিল তাদের অভয়ারণ্য।

তিরিশ থেকে চল্লিশটি বন্য শূকর দল বেঁধে বন-বাদা দাপরে ঘুরত আর রাতের বেলা খামার আর বাগানে হামলা করত। খঞ্জরের মত ধারালো দাঁতের অধিকারী একশ কিলোগ্রাম ওজনের পূর্ণ বয়স্ক মদ্দা শুয়োর ছিল এক দর্শনীয় জন্তু। যদিও মানুষ বা গৃহপালিত জানোয়ার বন্য শূকরের আক্রমণের লক্ষ্যবস্ত ছিল না , তারপরও কোণঠাসা হলে তারা আক্রমণ করে মানুষকে আহত করত। পুলিশের রেকর্ড ঘেটে দেখা গেছে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তও বন্য শূকরের আক্রমণে মানুষ মারা গেছে।

বাঘের ভয়ে সাধারণত মানুষ বড় দল বেঁধে বনে প্রবেশ করত, কারণ ধারনা ছিল যে কয়েকজন একসাথে থাকলে বাঘ সাধারণত আক্রমণ করে না।

কিন্তু বুনো শূকরের মুখোমুখি এই সূত্র নিস্ফল ছিল। কোন কারণে বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছালে তারা যেখানে সেখানে আক্রমণ করত, তা সেখানে যত মানুষই থাক না কেন। যে কারণে বাঘের চেয়ে মানুষ বুন্য শূকরের ভয়েই বেশী আতঙ্কিত ছিল। যদিও বাঘের চেয়ে শূকর শিকার করা অপেক্ষাকৃত সহজই ছিল। অনেক জাতের মানুষ মাংসের জোগানের জন্যও শূকর শিকার করত।

আদিবাসি গোত্র, বিশেষ করে শহরের উত্তর প্রান্তের বনের নিকটে বসবাসরত, যাদের মগ বলে অভিহিত করা হত, তারা এই ব্যাপারে দক্ষ ছিল। যথেচ্ছ শিকারের ফলেই ঢাকার আশপাশ থেকে বন্য শূকরের বিলুপ্তি ঘটে গত শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশকেই।
বুনো মহিষ
সতের থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত বুনো মহিষ ছিল ঢাকার আরেক পরিচিত প্রাণী। তারা দল বেঁধে শহরের উত্তরের বাদাতে চরে বেড়াত। বেলাই বিল ( বর্তমানে গাজীপুরের পুবাইলে অবস্থিত) নামের বিস্তৃত বাদা এবং শ্রীপুরের অসংখ্য নাম না জানা জলা শহরের থেকে উত্তর এবং পূর্বদিকে নদীর ধারে রাজত্ব করে ছিল।

বাঘ এবং বন্য শূকরের মত মহিষ কোন সময়ই মানববসতির খুব কাছে আসত না বিধায় তা মানুষের জন্য আতঙ্কউদ্রেককারী ছিল না। যদিও বিশালদেহী প্রাণীগুলো দলবেঁধে চরে বেড়াত, এবং অনাহুত মানুষদের প্রতি যে খুব একটা সদয় ছিল এমন প্রমাণ মেলে না। ১৮৩০ সালেও বুনো মহিষের কবলে পড়ে মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। নৌকা করে নিয়মিত ঢাকায় যাতায়াত করা বণিকদের নিরাপত্তা মূলত নিহিত ছিল যাযাবর বুনো মহিষের দল কোথায় সেটা সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল থাকা এবং সেই এলাকাকে এড়িয়ে চলার মধ্যে।
ব্রিটিশ আমলে বুনো মহিষের পালের খবর রাখত মূলত দেশী-বিদেশী শিকারির দল।

বিশালদেহি, ধীরগামী, লুকাতে অক্ষম এই প্রাণীটিকে বন থেকে খেদিয়ে বাহির করার জন্য ব্যপক জনবলেরও প্রয়োজন ছিল না। শিকারের চেয়েও কঠিনতর অংশ ছিল এক টনের উপরে মাংস লোকালয় পর্যন্ত পরিবহন করা। তারপরও যেহেতু সকল ধর্ম ও জাতের মানুষ মহিষের মাংস খায়, তাই কষ্টটুকু সাফল্য হিসেবেই দেখা হত। মূলত শিকারের কারণেই স্বল্প সংখ্যক বুনো মহিষের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় বাদাবন থেকে, উনিশ শতকেই।
হাতি
বুনো হাতি ঢাকার মানুষদের কাছে যেমনই ভয়ংকর তেমনই সমীহের প্রাণী হিসেবে পরিচিত ছিল।

যদিও সতের শতকেও এশিয় হাতি ঢাকার প্রান্তসীমার কাছের বনের বিচরণ করত না, কিন্তু কাছেরই অপেক্ষাকৃত ঘন বন বিশেষ করে ভাওয়াল, কাপাসিয়া ও কাছিমপুরে তাদের দেখা মিলত। পোষা হাতি ভারী মাল টানার কাজে এবং সার্কাসে বিনোদনের জন্য ব্যবহার করা হত, ফলে নগরবাসীদের কাছে তা ছিল একটি পরিচিত উপকারী প্রাণীর প্রতীক। যদিও এর বিশাল শরীর ও চৌকস শুঁড় কোন সময়ই লোক মনে কৌতূহল ও ভীতি জাগাতে ব্যর্থ হয় নি। বুনো বা পোষা দুই ধরনের হাতির কাছেই মাহুত ছাড়া কেউ-ই ঘেঁষার সাহস দেখাত না।
ঢাকা থেকে ১০০-২০০ কিলোমিটার উত্তরের কিছু বনে, সিলেটে এবং চট্টগ্রামের পাহাড়ে উনিশ শতকের বেশ কিছু সংখ্যক হাতি ছিল।

সেই সমস্ত এলাকায় স্থানীয় একদল মানুষের কাছে ফাঁদ পেতে হাতি ধরা ছিল একটি লাভজনক ব্যবসা। যে ধরনের ফাঁদ পেতে বুনো হাতি ধরা হত তাঁর নাম ছিল খেঁদা। সাধারণত শীতকালেই খেঁদা পাতা হত, যখন বন কম আদ্র থাকায় সহজেই গভীরে যাওয়া সম্ভব হত। ঔপনিবেশিক আমলে সরকারি খরচে খেঁদা স্থাপন করা হত। এই সম্পূর্ণ দেশী উপায় প্রথমবারের মত বাংলায় ব্যবহার করা হয়েছিল ১৮৬৮ সালে এবং বনবিভাগ তাঁর ব্যবহার শুরু করে ১৯১৫-১৬ সালে।

কতৃপক্ষ খেঁদার জন্য টেন্ডার আহবান করত এবং প্রতি হাতি ধরার জন্য মাঝে মাঝে ৭৫০ টাকার মত সন্মানী দিত। (১৯৬৭ সালের চট্টগ্রাম জেলা গ্যাজেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য )।
চট্টগ্রামের এমন একটি ফাঁদে ৮০টি হাতি ধরা পড়ার ঘটনাও জানা যায় যেখানে পুরো খেঁদাতে হয়ত আটকা ছিল ২০০ প্রাণী। দুঃখজনক ভাবে বাচ্চাসহ মা হাতি প্রায়ই ধরা পড়ত এমন ফাঁদে। গত দুইশ বছর নির্বিচারে হাতি ধরা এবং বন ধ্বংসের কারণে বুনো হাতির সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায়, আজ অল্প কিছু টিকে আছে কোনমতে।

মাঝে মাঝে স্মৃতিকাতর হাতির পাল ফিরে আসে তাদের চিরচেনা পথ ধরে প্রাচীন বনের পথে, যেখানে গজিয়ে ওঠা কৃষিক্ষেত এবং মানুষের আবাস তখন চাপা পড়ে হাতির পায়ের নিচে।
ঢাকাতে এখন হাতির নামে একটি প্রধান রাস্তা আছে যাকে আমরা এলিফেন্ট রোড নামে চিনি, যা দিয়ে আজিমপুরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত পিলখানার হাতিশালা থেকে হাতি নিয়ে আসা হত। পিলখানার মাহুতেরা যে এলাকায় থাকতেন তার নাম টিকে আছে মাহুতটুলী হিসেবেই। সারা দেশে ধৃত হাতিগুলো পিলখানায় এনে সেগুলোতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হত অস্ত্র পরিবহণসহ ইংরেজ সামরিক বাহিনীতে নানা কাজের ব্যবহারের জন্য। বেসামরিক কাজে হাতির মূল ব্যবহার ছিল গাছের গুড়ি টানা।

গত শতকের প্রথমে বাংলায় হাতির অস্তিত্ব প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসায় ইংরেজরা হাতি ধরার কার্যক্রম বাংলা থেকে মায়ানমারে স্থানান্তর করে।
বিরক্তিকর স্তন্যপায়ী প্রাণী
বানর
বানর হচ্ছে একমাত্র বৃহদাকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী যা গত চারশ বছর ধরে ঢাকায় যে শুধু বসবাস করছে তাই-ই না এমনকি আজকেও এই কংক্রিট অরণ্যে মানুষের গমগমে ভিড়ের মাঝেও তারা টিকে আছে। রেসাস বানর হচ্ছে একমাত্র বানর যারা পুরনো ঢাকার ছাদে এবং শহরের আরেক প্রান্তে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্টে এখনো টিকে আছে। বানর পরিবারের অন্য যে সদস্য গত শতকেও ঢাকায় বিচরণ করত তা হচ্ছে মুখপোড়া হনুমান, অবশ্য সমস্ত Langurকেই বাংলায় হনুমান বলা হয়ে থাকে। সংখ্যায় অনেক বেশি, স্বভাবে সাহসী এবং মন্দিরগুলোতে পালিত হবার কারণে বানররা মাঝে মাঝে অসতর্ক মানুষের হাত থেকে খাবার ছিনতাই ও চুরি করার দুঃসাহসও দেখায়।

শহরের ভিতরের ও আশেপাশের বাগান নষ্ট করার জন্যও তাদের দায়ী করা হয়। যদিও সেটা নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য শোনা যায় না, এবং ঢাকা শহরকে বানরমুক্ত করার প্রচেষ্টা কঠোর ভাবে কখনোই চালানো হয় নি।

বাগানে হামলার অভিযোগের শিকার বানরেরা এই মহীরুহশূন্য পরিবেশের মন্দিরের প্রাঙ্গণে অথবা সব্জিবাজারে টিকে থাকতে পারে, কিন্তু হনুমানদের জন্য বড় গাছ অত্যাবশ্যকীয়। প্রতিবারই ভূমিতে খাদ্য সংগ্রহের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ শেষেই তাদের গাছের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন। ক্রমবর্ধমান শহরের বন ছেঁটে একেবারে অদৃশ্য করে ফেলার মত্ততার পাল্লায় হনুমানেরাও চলে যায় ঢাকা ছেড়ে।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে হনুমানশূন্য ঢাকায় বানরদের একক করুণ রাজত্ব শুরু হয়।
বৃহত্তর সিলেটের মাধবপুর, চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে তাদের দর্শন মিলে। এছাড়া বাংলাদেশে এখনো দেখা যায় ধূসর হনুমান এবং চশমাপড়া হনুমানের। সারা দেশে হনুমানদের খুব ক্ষুদ্র এক দল আজও যশোর ও কুষ্টিয়ার কয়েকটি গ্রামে টিকে আছে।
শেয়াল, খেঁকশিয়াল
বিগত চার শতাব্দী ধরে ঢাকা মহানগরীতে এবং এর আশেপাশে Canidaeপরিবারের যে দুইটি প্রাণী দেখা যায় তারা হচ্ছে পাতিশিয়াল (Asiatic Jackal) ও খেঁকশিয়াল (Bengal Fox)।

পাতিশিয়াল মানুষের কাছের সবচেয়ে পরিচিত স্তন্যপায়ী শিকারি প্রাণী বলেই পরিচিত বহু বছর ধরে। যদিও মরাখেকো এবং পোষা মুরগী ও গবাদিপশুর ভক্ষক হিসেবে তার দুর্নামই সর্বজন বিদিত। একইসাথে অতি চতুর বলে পরিচিত হওয়ায় শিয়ালের ধূর্ততার নানা গল্প আমাদের লোকগাঁথা ও রূপকথায় মেলে। পাতিশিয়ালেরা নিশাচর এবং আঁধার ঘনিয়ে আসার পরেই বিচরণ শুরু করে, যদিও গোধূলি লগ্নের সাথে সাথেই বিকট চিৎকার এবং সারা রাতে কয়েকবার ডাক দিয়ে তার অস্তিত্বের জানান দেয়। যে কোন একটি শিয়াল ডাকার পরপরই দলের বাকিরা সেখানে পাল্লা দিয়ে যোগ দেয়, মনে হয় শুরুর সেই ডাকটি যেন ছিল কোন প্রলম্বিত দীর্ঘ সুর মূর্ছনার শুরুর আহবান মাত্র।

যদিও দীর্ঘ ও জোরালো ডাকের মোচ্ছব শেয়ালকে মানুষ সমাজে আদরণীয় করতে পারে নি কখনোই।

পাতিশিয়াল (Asiatic Jackal)
গত কয়েক শতকে ঢাকাতে পাতিশেয়ালের সংখ্যা নিঃশেষ হয়ে গেছে। মানুষ তাদের যতই চালাক বলে অভিহিত করুক, প্রায় কুকুরাকৃতির একটি মাংসাশী প্রাণীর পক্ষে এই বিটুমিন-কংক্রিটের নগরে টিকে থাকার মত খাদ্য সংস্থান করা অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। বরং শহরতলীর কোন প্রান্তরে ইতস্তত বিচ্ছিন্ন শেয়াল দেখলেই মানুষ উল্টো অবাক হয়ে চেয়ে থাকে এককালের বহুল পরিচিত জীবটির দিকে।
পাতি শিয়ালের তুলনায় খেঁকশিয়াল অনেক ছোট, আদরণীয়, নিরিবিলি, লাজুক এক প্রাণী।

বড় আকারের জাতভাইটির মতই সেও মানববসতির আশেপাশে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বাস করে, পচা-গলা মৃতদেহ খায়, সুযোগ পেলে মুরগী ধরে। যদিও এই কাজটি সে পাতিশেয়ালের তুলনাই খুব কমই করে থাকে। আসলে খেঁকশিয়ালের মূল খাদ্যতালিকায় আছে ছুঁচো, ইঁদুর, নেংটি ইঁদুর পোকামাকড়, ফলপাকুড়। উইয়ের ঢিবি থেকে শুরু করে তরমুজের ক্ষেত সবই খেঁকশিয়ালের প্রিয় খাবারের জায়গা। বাঙালি জীববিজ্ঞানীদের জন্য গর্বের বিষয় হচ্ছে এই প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নামকরণ করা হয়েছে বাংলার নামে, Vulpes bengalensis, যদিও তা প্রিয়দর্শন ক্ষুদে প্রাণীটি বুনো পরিবেশে টিকে থাকার জন্য বিশেষ কোন সহায়ক হয় নি।

ঢাকা নগরীর কোথাও খেঁকশিয়াল টিকে নেই এবং সারা দেশেই এর অবস্থা বিপন্ন।
গন্ধগোকুল ও বেজি
গত কয়েকশ বছরে ঢাকার বাসিন্দাদের মাঝে বেশ কয়েক ধরনের Viverridae গোত্রের প্রাণী ছিল ( ছোট আকৃতির মাংসাশী প্রাণী যাদের পা খাটো, শুন্ড লম্বা এবং লেজ রোমশ দীর্ঘাকৃতি)। বিশেষ করে গন্ধগোকুল,খাটাশ ও বেজি এই পরিবারের তিন সদস্য যারা ঢাকায় বসবাস করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। ডোরাকাটা শরীর ও রিংওয়ালা লেজের খাটাশকে বরাবরি শহরের অনিষ্টকারী এক প্রাণী হিসেবে ধরা হত যাকে রাতের আঁধারে না গোধূলিলগ্নে নিজ আশ্রয় ছেড়ে মানুষের পোষা প্রাণী বিশেষ করে মুরগী ও কবুতর ধরতে দেখা যেত। কিন্তু মানুষ জানত না যে খাটাশ আসলে অনিষ্টকারী প্রাণীদের জন্য এক দুর্দান্ত জল্লাদ, যে নানা ধরনের ইঁদুর, ছুঁচো ও পোকামাকড় খেয়ে এলাকা সাফ রাখে।

লাজুক, নিভৃতচারী, ক্ষুদে প্রাণীটি যে কোন ধ্বংসাবশেষ বা অব্যবহৃত অংশ পেলেই সেখানে আস্তানা গাড়ে এবং সেই আবাসন দুর্গ থেকেই সমস্ত আক্রমণ চালায়। যদিও সেই এলাকার মানুষ এর চলাচলের পথে মামুলি ফাঁসের ফাঁদ অথবা মুরগীর কুঠুরির সামনে বড় ইঁদুর মারার ফাঁদ দিয়ে সেই হামলার ইতি টানে।
ঢাকার আরেক ধরনের Civet ছিল গন্ধগোকুল, যার ইংরেজি নামের সাথে যতই তাল থাকুক সে খাটাশের মতই এক মাংসাশী প্রাণী। জাতভাইটির মত তারও মানুষের পোষা মুরগীর উপরে হামলা চালানো ইতিহাসের কারণে ক্ষতিকর, অনিষ্টকারী প্রাণীর তকমা জুটেছে। সাধারণত এরা তাল গাছ দিবাকালীন আশ্রয়স্থল এবং বাচ্চা বড় করার নার্সারি হিসেবে ব্যবহার করে।

অবস্থাদৃষ্টে কোন ধ্বংসাবশেষ বা পুরনো গাছের ফাঁপা গুড়ি পেলে তাতেও নিবাস গাড়তে দ্বিধা বোধ করে না। ঢাকার মানুষেরা অবশ্য খাটাশ ও গন্ধগোকুলের মাঝে তফাৎ করতে পারে না এদের প্রায় একই রকম আকৃতি, গড়ন ও স্বভাবের কারণে। যদিও চামড়া দেখেই তাদের পার্থক্য বোঝা সম্ভব, গন্ধগোকুলের রোমশ চামড়া গাঢ় ধূসর বর্ণের, মাঝে ফোঁটা ফোঁটা আর লেজে কোন রিং নাই। তবে সবচেয়ে বড় পার্থক্য এর বিশেষগ্রন্থি, শত্রুর উপর নিক্ষেপের জন্য দুর্গন্ধযুক্ত তরল থেকে সঞ্চিত থাকে। এই নাছোড়বান্দা প্রাণীগুলো কয়েকশ বছর বীরদর্পে বিচরণ করে বেড়ালেও আজ গুটিকয়েক হয়ত টিকে আছে গোপন কোন বাসযোগ্য স্থানে।


খাটাশ এবং গন্ধগোকুলেরা নিশিতে শিকার চালিয়ে যায় কিন্তু তাদের নিকটাত্মীয় বেজি একই কাজ করে দিনভর। তাদের মধ্যে আরেক উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হচ্ছে অন্যরা গাছে চড়তে পটু কিন্তু বেজি আক্রান্ত হলেও গাছ বাইতে পারে না। বহু শতাব্দী ধরে দিবাকালীন দুই পরিচিত শিকারি হচ্ছে নকুল বা ছোট বেজি (Small Indian Mongoose) এবং নেউল বা বড় বেজি (Common Mongoose) যদিও দুইটাকেই মানুষ বেজি বলেই ডাকে এবং তাদের পার্থক্য নিয়ে যে খুব ওয়াকিবহাল তাও নয়। বেজিরা তাদের ধারালো নখর দিয়ে তৈরি মাটির গর্তে বাস করে এবং যতদিন তাদের খাওয়ার মত সাপ, ইঁদুর, পোকা থাকে ততদিন মানববসতির খুব কাছাকাছি টিকে থাকতে পারে। পোষা হাঁসের বাচ্চা আর মুরগীর ছানাও তাদের ভোজ্য তালিকায় অংশ নেয় মাঝেসাঝে।

নকুল একটু ছোট আকৃতির হয়, দীর্ঘ দেহ, লেজের শেষ প্রান্ত রোম ছাড়া দেখে লাজুক প্রাণীটি চেনা যায়। কোন অজানা কারণে অন্য বেজিটির তুলনায় নকুল অনেক বেশি বিরল শহর এলাকায়। তবে শহরের ক্রমবর্ধমান খাদ্য সংকটের কারনেও হয়ত অপেক্ষাকৃত বিশালদেহী নেউলের কাছে তার পরাজয় মেনে স্থান ছেড়ে দিতে হচ্ছে।

নেউল বা বড় বেজি (Common Mongoose)
নেউল সাধারণত বেশ বড় আকারের হয়, সাহসী প্রাণীটির পেছনের পা লোমহীন, লেজের শেষাংশ সাদা লোমে আবৃত থাকে। এটি শহরের অনাকাঙ্ক্ষিত PEST বৃশ্চিক, ব্যাঙ, ছুঁচো, ইঁদুর, সাপ ইত্যাদি খেয়ে থাকে।

বলা হয়ে থাকে নেউল নানা বিষধর সাপ এমনকি গোখরাকেও লড়াইয়ে পরাস্ত করতে পারে, যা তাকে মানুষের কাছে কিছুটা হলেও পছন্দনীয় প্রাণীতে পরিণত করেছে। যদিও নেউলের খাদ্যতালিকায় আরও রয়েছে পোষা পাখি, হাঁসের বাচ্চা, অসতর্ক মুরগীর ছানা ইত্যাদি। বুনো খাদ্যের যোগান কমে গেলে নেউল মানুষের পালা প্রাণীর উপরেই বেশি নজর দেওয়া শুরু করে ফলে অবধারিত ভাবেই লড়ুয়ে কোবরা-শিকারি হিসেবে তার জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়ে। মানুষের পাতা ফাঁদ এবং জালের কারণে বেজির সংখ্যা হ্রাস পেলেও খাটাশ ও গন্ধগোকুলের মত ভয়াবহ হারে নয়। উদ্যমী প্রাণীটি শিকারে দারুন কুশলতার পরিচয় দিয়ে ঢাকার অনেক স্থানেই ভালভাবে টিকে আছে।


ইঁদুর
ঢাকা শহরে এখনও একটিও বাড়ি নেই যেখানে অন্তত এক প্রজাতির ইঁদুরও থাকে না, এবং গত চারশ বছরের ইতিহাসেও তাইই ছিল। যদিও চার শতাব্দীতে ঢাকার ভূদৃশ্যে বিপুল সব পরিবর্তন ঘটেছে এবং ইঁদুর বাদে প্রায় সব ধরনের বন্য প্রাণীই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যদিও গত কয়েকশ বছর ধরে, ঠিক বর্তমানের মতই তাদের বিনাশ করার নানা কৌশল কাজে লাগিয়েছে মানুষ, কারণ তারা ক্ষতিকর Paste। মনে হয় এই শহরে টিকে থাকার লড়াইয়ে তারাই সবচেয়ে নাছোড়বান্দা ও খাপ খাওয়ে নেয়াই পটু প্রাণী। ঢাকার বহুতল অট্টালিকা থেকে শুরু করে পূতিগন্ধময় বস্তি, সবখানেই কয়েক ধরনের ইঁদুরের বিস্তার।

স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাঝে ইঁদুর ( বিজ্ঞানীরা যাকে Muridae বলে থাকেন) এক বিরল পরিবার, যাদের ক্ষেত্রে সংখ্যা হ্রাস ঘটছে না।
দুই ধরনের ব্যান্ডিকুট ইঁদুর, মেঠো ইঁদুর (Little Indian Field Mouse), ইঁদুর (Soft-furred Rat) হচ্ছে বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে ঢাকার মাঠ, বাগান, পতিত জমি ও বাঁধের বাসিন্দা। ব্যান্ডিকুট ইঁদুরেরা গর্ত খোড়া সম্ভব এমন যে কোন জায়গা বিশেষ করে ধানক্ষেত, সব্জি বাগান, বাঁধে বাস করে। তারা ওস্তাদ সাঁতারু, ফলে গর্ত পানিতে ভিজলে বা ভরে গেলে সাধারণত কোন সমস্যা হয় না। একধরনের ব্যান্ডিকুট ইঁদুরের ( Lesser Bandicoot-Rat) বৈজ্ঞানিক নাম রাখা হয়েছে বাংলার নামে- Bandicota bengalensis।

তাদের মতই মেঠো ইঁদুরও মাঠ ও বাগানের গর্তের বাসিন্দা। কিন্তু ইঁদুর (Soft-furred Rat) মাঠে বাস করলেও যে কোন ভগ্নস্তূপেও থাকতে পারে। ইঁদুর পরিবারের এই সদস্যরা ঢাকায় অবস্থানের সোনালি দিনগুলো ফেলে এসে তার প্রান্তসীমায় বসবাসরত।

( Lesser Bandicoot-Rat)
নেংটি ইঁদুর ( House Mouse), গেছো ইঁদুর (Common House Rat) অতীতের মতই আজও সদর্পে বিচরণ করে ঢাকাতে। Muridae পরিবারের এই দুই সদস্য আমাদের একান্ত আপনজনের মতই বাসগৃহে থাকে।

তারা আমাদের খাদ্য, বস্ত্র, আসবাবপত্র ব্যবহার করে, যত্রতত্র বংশবৃদ্ধি করে, ছাদ, প্রাচীর, তাকে ঘুমায়। শত বছরে জীবনযাত্রা ও স্থাপত্যকলার ব্যপক পরিবর্তন শর্তেও ইঁদুর-মানুষের সম্পর্কের এমন কোন পরিবর্তন ঘটে নি। সেই মোঘল আমল, ইংরেজ আমল, পাকিস্তানি আমল অতিবাহিত করেও ইঁদুরেরা মানুষের আশেপাশেই বহাল তবিয়তে আছে, আমাদের পূর্বপুরুষদের বিরক্তি ও ঘৃণা তাদের হঠাতে পারেনি ঢাকা থেকে।

(Brown Rat)
সজারু ও খরগোশ
গত কয়েকশ বছর ধরে যে দুই তৃণভোজী প্রাণী রাতের ঢাকার বাগান আর শহরতলীর মাঠে অনাহুত ভাবে যথেচ্ছ ঘুরে বেড়াত তারা হচ্ছে সজারু এবং খরগোশ। দুই দলই খাবারের সন্ধানে খুঁজে ফিরত রসালো পাতা, মূল, ডাঁটা, ফুল, ফল, বীজ।

মানুষের বাগান তাদের কাছে উৎকৃষ্ট ভোজসভার স্থান, সজারুদের নিয়মিত রাতকালীন আক্রমণের বিরুদ্ধে ফসলের ক্ষেত আর সাজানো বাগানে কোন প্রতিরোধ ছিল না বললেই চলে। এই নিশাচরেরা যে কোন বেড়া ভেদ করে যেতে পারত, আর কোন বেড়া অভেদ্য হিসেবে দেখা দিলে স্রেফ সুড়ঙ্গ খুঁড়েই অনুপ্রবেশ করত। ফাঁদে খুজে পেতে এবং এড়িয়ে যেতেও তারা যথেষ্টই পটু ছিল। পাহারারত কুকুরেরা এই অনাকাঙ্খিত লুটেরাদের ধরার চেয়ে মালিকদের জাগিয়ে রাখতেই বেশী ব্যস্ত ছিল। সজারু অসম্ভব দ্রুততার সাথে পিছন ফিরে তার বিষাক্ত কাঁটা উচিয়ে আক্রমণরত কুকুরকে মারাত্মক রূপে আহত করতে পারে, তাই অভিজ্ঞ কুকুর মাত্রেই সজারুর কাঁটার ঝমঝম শব্দ পাওয়া মাত্রই স্থাণু হয়ে তাদের এড়িয়ে যেত।

বিষাক্ত কাঁটার ফলে অন্যান্য শিকারি প্রাণীর কবল থেকেও তারা নিরাপদ ছিল, কিন্তু মানুষের চাহিদার কারণে বাগান উধাও হয়ে ভবন উঠতে থাকলে মূলত খাদ্যাভাবেই সজারুরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই ইট-পীচের রাজত্ব বিস্তারের কারণে ঢাকা সজারুশূন্য হয়।
নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য খরগোশদের বিষাক্ত কাঁটা বা কোন ধারালো অঙ্গই ছিল না। বরং টিকে থাকার লড়াইয়ে তার সম্পদ ছিল সতর্কতা, শারীরিক জোর ও উচ্চমাত্রার প্রজনন ক্ষমতা। ঘাস ও অন্যান্য ছোট উদ্ভিদখেকো প্রাণীগুলো ঘাসেরই গর্তে বাস করত।

অসংখ্য বাচ্চা লালনের জন্য সেগুলো চমৎকার জায়গা ! খরগোশের প্রজনন হত সারা বছরই, যদিও ঘাস বেড়ে ওঠার সময়ে বাচ্চার সংখ্যা বেড়ে যেত, সেই সাথে বাচ্চাদের যত্নের পরিমাণও। মানুষ ছাড়াও এই নিরীহ তৃণভোজীদের অনেক শত্রু ছিল। উম্মুক্ত ঘাস প্রান্তর এমন অসহায় প্রাণীর জন্য এক ঝুঁকিপূর্ণ স্থান, যেখান দিনে চক্কর দিতে বেজি আর ঈগল এবং রাতে প্যাঁচা এবং শেয়াল। যদিও সবচেয়ে ক্ষতিকর বিষয়টি ছিল ঘেসো জমিও উধাও হয়ে যাওয়া। এই নগরে আজ এমন কোন ময়দান নেই যেখানে ঘাস বুনো ভাবে বাড়তে পারে এবং খরগোশেরা সেখানে বাড়ী বানায়।

খরগোশ বর্তমানে বাংলাদেশের এক বিপন্ন প্রাণী।
বাদুড়
বিগত শতাব্দীগুলোতে গোধূলি লগ্নের ঢাকার আকাশ থাকত উড়ন্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের রাজত্ব। আঁধার নেমে আসলেই তাদের দেখা যেত ফলের বাগানগুলোতে, বা মানুষের আবাস গৃহে ঢুকে দিব্যি উড়ে বেড়াতে, কোথাও একটিবারও ধাক্কা না খেয়েই! তারা হচ্ছে সেই অদ্ভুত দর্শন প্রাণী যাদের হাতের জায়গায় আছে হাড়, পেশী ও চামড়ার সমন্বয়ে গঠিত ছাতার মত অঙ্গ যা তাদের বাতাসে উড়ে বেড়াতে সাহায্য করে, বিজ্ঞানীদের তাদেরকে Chiroptera বলে অভিহিত করলেও আমরা তাদের বাদুড় ও চামচিকা বলেই জানি। অতীতে ঢাকায় বেশ কয়েক ধরনের এই উড়ুক্কু জীবেরা থাকত যারা তিমির ভেদ করে ওড়ার ব্যাপারে যথেষ্ট পারদর্শী ছিল। যদিও এখানে আমরা চার ধরনের উড়ন্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীর কথাই বলব-
অতীত–বর্তমান দুই কালেই ঢাকার সবচেয়ে বেশী দৃশ্যমান বাদুড় ছিল বড় বাদুড় বা চম্পা বাদুড় ( Indian Flying Fox )।

একমাত্র এই প্রজাতির বাদুড়ই লোকালয়ের মাঝে উম্মুক্ত গাছের ডালে দিনের বেলা আশ্রয় নেয়। বিশাল দল বেঁধে এরা উল্টো হয়ে সারাদিন ঝুলতে থাকে, দূর থেকে মনে হয় লণ্ড্রী থেকে কাপড় রোদে শুকানো হচ্ছে। বিশাল এক জোড়া চোখ দিয়ে এরা নিচের মানুষদের দিকেও নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকে মাঝে মাঝে। নির্ভীক স্বভাব ও বিশালাকৃতির কারণেই এরা মনুষ্যসমাজে সবচেয়ে বেশী পরিচিত বাদুড়। সাঁঝবেলা এরা আশ্রয় ছেড়ে খাদ্যের সন্ধানে ফল গাছের দিকে যাত্রা শুরু করে।

বাদুড় ফলপাকুড় খুবই পছন্দ করে, কাজেই শহরের ফলবাগানগুলোর বেশ ক্ষতিসাধন হয় তাদের দ্বারা। বিশেষ করে ভরা মৌসুমের ফলন্ত গাছগুলো। এই কারণেই শহরের সবচেয়ে ঘৃণ্য বাদুড় হিসেবেই তারা সুপরিচিত ছিল। বাগানের তদারককারীরা অনেক সময়ই লাঠি, জাল, বল্লম নিয়ে সারা রাত টহল দিতে বাদুড়ের ফলার রুখতে। তবে বিগত শতাব্দীর মধ্য ভাগ থেকেই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার আবাসন সৃষ্টির জন্য ব্যপক পরিমাণে গাছ উজাড় করে বাসগৃহ নির্মাণ শুরু হলে বাদুড় –মানুষের সেই নৈশযুদ্ধের কথা ইতিহাসের অংশে পরিণত হয়।

আজ ঢাকাতে খুব অল্প সংখ্যায় এই বিশালদেহী ফলখেকো বাদুড়েরা টিকে আছে।

(Indian Flying Fox)
Indian Flying Fox-এর চেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির অন্যান্য উড়ুক্কু নিশাচরদের ভরে রাখত ঢাকার আকাশ, বিশেষ করে ডাইনি বাদুড় ( Greater False Vampire ), ক্ষুদে চামচিকা (Coromandel Pipistrtelle), বামণ চামচিকা (Least Pipistrtelle)। তারা সাধারণত পরিত্যক্ত ভবনের নানা আঁধার কোণায় লুকিয়ে থাকত, রাতে মূলত পোকা ভক্ষণ করতেই বাহির হত এবং মানুবরাজ্যের জন্য খুব কম সমস্যারই তৈরি করত। এদের মধ্যে ডাইনি বাদুড় ছিল সর্ববৃহদাকৃতির, যাদের খাদ্যতালিকায় ছিল ঝিঁঝিঁ পোকা, ব্যাঙ, মাছ, গিরগিটি, পাখি ইত্যাদি।

ডাইনি বাদুড় ( Greater False Vampire )
চামচিকা (Pipistrtelle)রা মূলত ক্ষুদে পোকা যেমন গুবরে পোকা, মথ, মশা ইত্যাদি খেয়েই জীবনধারন করত।

চামচিকা শব্দটি অবশ্য খুব চিকন লোককে অভিহিত করার সময়ও ব্যবহার করা হয়। পোকামাকড়ের আধিক্যের জন্য চামচিকারা মানুষের আবাস বিশেষ করে আলোজ্বলা রুমেও প্রবেশ করে খাদ্যর অন্বেষণে। অতিমাত্রায় রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে যেহেতু পোকারাই উজাড় হয়ে গেছে প্রকৃতি থেকে, তাই পতঙ্গভূক চামচিকারাও নেই হয়ে গেছে আমাদের পরিবেশ থেকে।
আদরণীয় স্তন্যপায়ী প্রাণী

হরিণ
গত শতাব্দীগুলোতে ঢাকার সমস্ত বুনো প্রাণীই যে এর নাগরিকদের কাছে ভয়ংকর ক্ষতিকর ছিল তা নয়, বেশ কিছু জন্তু তাদের প্রিয়দের তালিকায়ও ছিল, বিশেষ করে হরিণ ছিল সেই প্রিয় জন্তুদের তালিকার শীর্ষে। ঢাকার ছড়ানো বন, বাদা, ঘাসের প্রান্তরে ছিল চিত্রল হরিণ, মায়া হরিণ, বারশিঙ্গা ও সাম্বার হরিণের বিশাল পাল।

মায়া হরিণ হচ্ছে সবচেয়ে দৃঢ় ও ক্ষুদ্রাকৃতির হরিণ, মানুষ তাঁকে খুব একটা প্রিয়দর্শন মনে করত না এবং জাঁকালো শিঙের অভাবের কারণে শিকারীরাও মায়া হরিণ শিকারের ব্যাপারে বেশী উৎসাহী ছিল না।

(মায়া হরিণ)
চিত্রল হরিণ ছিল আরেকটু বড় আকৃতির, বর্ণীল, রাজকীয় দর্শন হরিণ, যাদের আছে গাছের ডালের মত ছড়ানো শিং। দলবদ্ধ ভাবে এরা চলাচল ।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।