একজন নির্বোধের বয়ান দেড় যুগের কাছাকাছি বাংলা ছবি আগ্রহ নিয়ে দেখা হয় না। ‘চোরাবালি’ দেখার আগ্রহ সেই প্রথম থেকে ছিল। রেদওয়ান রনির কোনো নাটকই মিস হয়নি। আগ্রহ আরো বেড়ে গিয়েছিল ‘চোরাবালি’র ট্রেলার দেখার পরই। আয়োজন করে সিনেমাটি দেখতে চাইনি, সিনেমা হলে পুরো মনোযোগ দিয়ে ছবিটি দেখার জন্য।
শেষ পর্যন্ত ঘরের মানুষটির আবদারও ফেলতে পারলাম না। চোরাবালির পথে সঙ্গী করতে হলো তাকেও।
। ২।
২৫শে, ২০১২ ডিসেম্বর ছুটির দিনটিকে চোরাবালির জন্য বরাদ্দ রাখলাম।
দুপুরের আগেই অগ্রিম টিকিট কাটার জন্য বলাকার সামনে হাজির। কাউন্টার থেকে একবাক্যে না করে দিল, ‘অগ্রিম টিকি দেওয়া হয় না’। গো ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কাউন্টারের সামনে ঝামেলা না করার জন্য বলা হলো,‘যান তো ভাই, ঝামেলা কইরেন না। বিকালের শো-তে (সাড়ে ৩টার শো-তে) আসেন।
না হইলে এখন টিকিট কাইট্ট্যা দেখেন। কাউরেই অগ্রিম টিকিট দেই নাই, আপনেরে কেমনে দেই?’ উপান্তর না দেখে বলতে বাধ্য হলাম, ‘ভাই, আমি পত্রিকায় ‘চোরাবালি নিয়ে রিভিউ লিখবো’ কিন্তু সমস্যা হইল, আমার একজন সহকর্মী বিকাল ছাড়া আসতে পারবে না। ’ তবুও অনড় কাউন্টারের ভেতর থাকা লোকটি। মিনিট খানেক উভয় পক্ষ নিরবতা পালন করলাম। মুখ খুললেন লোকটি, ‘আপনি একটু পরে আসেন।
দেখি কি করা যায়!’ দূরে না সরে কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হলেন। লোকটি বলল, ‘দেন টাকা দেন। ’ ভাজ করা দুটি টিকিট নিয়ে বাসায় ফিরে আসার মুখে লোকটির দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি দিলাম।
।
৩।
বিকাল সাড়ে ৩টার শো-তে সঙ্গী নিয়ে ছবি শুরু মিনিট সাতেক আগে বলাকার সামনে উপস্থিত হলাম। সকালের তুলনায় অনেক ভীড়। ঠেলেঠুলে লাইনের সবশেষে দাঁড়িয়ে পরিচয় হলো সংবাদপত্রে চাকরী করা ব্যক্তির সাথে। তিনি তার পরিবার নিয়ে এসেছেন।
জানতে চাইলেন, ভাই বউ-বাচ্চা নিয়ে ছবি দেখা যাবে তো? একবাক্যে বলে দিলাম, ‘যাবে না কেন, অবশ্যই যাবে। চলেন দেখি আগে, আল্লাহ ভরসা। ’ নিচুস্বরে আবারো জানতে চাইলেন, ভাই, টিকিট কত নিছে?’ সঠিক দামের কথা বলতেই বললেন, ‘ব্ল্যাকে কিনছি দুইশো করে নিছে। ’
নির্ধারিত আসনে সঙ্গীকে নিয়ে বসলাম। উপর থেকে দ্বিতীয় সারি।
উপযুক্ত জায়গা বলেই মনে হলো-পরিবেশ শান্তই মনে হল। মিনিট দুই পরেই শুরু হলো পেছন থেকে উৎপাত, গাদা গাদা চিপসের প্যাকেটের কচকচ-মচমচ শব্দ। সেই সাথে দুই তরুণীর অনবরত বক বক। মাথার ভেতর কচমচ শব্দ আর বকরবকর ঘুরপাক খাচ্ছে।
আলো নিভে গিয়ে পর্দায় শুরু হলো নানান কিসিমের উপদেশ-সাবধান বাণী।
তারপর বিজ্ঞাপন শুরু হওযার সাথে সাথে সঙ্গী বলল, বাসায় টিভি দেখি না, বিজ্ঞাপনের ভয়ে। ছবি দেখতে এসেও যদি বিজ্ঞাপন দেখতে হয়! বলি, দুই-এক মিনিটের বিজ্ঞাপনের সহ্য করার মতো শক্তি নিশ্চয় আমরা হারিয়ে ফেলি নি!
পতাকা প্রদর্শন কালে সবাই দাঁড়িয়ে গেল। একমাত্র আমরা দু’জনই আগেভাগে বসে পড়লাম। সর্বনাশ আমরা তো খাঁটি দেশ প্রেমিকের মতো আচরণ করলাম না। রক্ষা পেলাম নিজ শরীরে নিত্য উপহারের বহুত বিক্রিত বাংলাদেশের পতাকা (টি-শাট) পরা ছিলাম বলে।
সেই সময় নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছি, বিশ্বাসের চেয়ে বড় হলো পতাকার প্রতি ভালোবাসাটা ভেতরে ধারণ করেছি বেশ পোক্ত ভাবে।
। ৪।
ছবি শুরু হলো। চিরায়ত ধারার বাইরে রেদওয়ান রনি’র ‘চোরাবালি’ সিনেমা শুরু হলো।
দর্শককে শুরু থেকে ছবি সিনেমার মধ্যে বেঁধে ফেলার কাজটি রনি ভালো ভালোই করতে পেরেছেন। ছবি দেখার পুরো সময়টা আমি সঙ্গীর কথা ভুলে ছিলাম।
সাংবাদিকরূপী জয়া আহসানের অপহরণের মধ্যে দিয়ে সিনেমা শুরু হয়। আজকের রিভিউতে ছবির কাহিনী বা ঘটনার বর্ণনায় যাবো না। সিনেমা হলে গিয়েই সবাই ছবিটি দেখুক।
এখানে শুধু ছবিটি দেখার সুখকথনই করতে চাই। আসল কথা আমি কোনো চিত্রসমালোচক নই।
ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চোরাবালির আবহসঙ্গীত (ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক) অসম্ভব মন মাতানো। বাংলাদেশের কোনো সিনেমায় আগে যা শুনিনি। চিত্রগ্রাহক খায়ের খন্দকার ভয়াবহ সুন্দর কাজ দেখিয়েছেন।
চোখের আরামের পাশাপাশি মন ভরে গেছে। পর্দা থেকে চোখ সরানোর কোনো সুযোগ ছিল না। ছবিতে আলোর ব্যবহারেও ছিল ব্যাপক মুন্সিয়ানার ছাপ। নিখুঁত সম্পাদনার কারণে ছবিটি কোথাও ঝুঁলে যায়নি। ছবিতে লম্বা কাহিনি না থাকলে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা বানাতে গেলে তিল পরিমান ঝুলে যাওয়ার সম্ভাবনা কোনো ছবিতে থাকলেও চোরাবালিরও ক্ষেত্রে যা হয়নি।
পরিচালককে ১০০ মার্ক দেওয়াই যায়।
যখন কোনো সিনেমায় গান দেখানো শুরু হয়, তখনই অধিকাংশ দর্শক আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দেখেই আমরা অভ্যস্ত, কিন্তু চোরাবালির ক্ষেত্রে সে দৃশ্য আমাদের দেখতে হয়নি। যখন যেখানে প্রয়োজন হয়েছে সেখানে একেকটা গানের প্রথম দুই লাইনের মতো বাজানো হয়েছে। বিষয়টি বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য নতুন না হলেও, এই প্রথমবারের মতো কোনো দর্শককে দেখলাম না বিরক্ত হয়েছে গান না দেখানো জন্য। নায়ক-নায়িকার অযথা নাচানাচি নেই।
আইটেম গানটি না থাকলে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো? আমার মনে হয়, গানটিই ছবিতে জোর করে আরোপ করা হয়েছে। আইটেম গার্লকে চোখে ভালো লাগেনি। নাচানাচি পর্যন্ত সই। মডেল পিয়া মডেল হিসেবে যথেষ্ট ভালো করেছেন বলে মনে হলো। দেখতে-শুনতেও তো খারাপ না।
এতোদিন তো আমরা হাতিমার্কা নায়িকাই দেখতাম ছবিতে। সেক্ষেত্রে পিয়ার আগমন যথেষ্ট শুভ উদ্যেগ বলা যায়। পিয়া অভিনয় মোটামুটির মানের করেছেন। যেটাকে ভালোই বলতে হবে। এছাড়া যারা ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তারা সবাই ভালো করেছেন।
বিশেষ করে এটিএম শামসুজ্জামান অল্প সময়ের জন্য পর্দায় উপস্থিত থাকলেও তিনি আবারো প্রমাণ করে ছেড়েছেন, কেন তিনি এখনো অভিনয় করে যাচ্ছেন! দর্শক কেন আজও তার অভিনয় দেখার জন্য মুখিয়ে থাকে!
কলকাতার ইন্দনীল ও বাংলাদেশের জয়া আহসানকে পর্দায় দেখতে ভালো লাগলেও তাদের অভিনয়ের সুযোগ কমই ছিল বলা চলে। ইন্দনীলের জোরালো অভিনয়ের সুযোগ ছিল না। বরং সুমনরূপী ইন্দনীলের ছেলেবেলাটা ছিল আর্কষনীয় ও স্বতন্ত্র। কিন্তু বড়বেলার সুমন শুধুমাত্র গডফাদার ওসমানের অনুগত কিলার। ছোট সুমনের বেড়ে ওঠার সাথে যুবক সুমনের (ইন্দনীল) বর্তমান চলাফেরা দেখে মনে হয়েছে, সুমন একজন আধুনিক শিক্ষিত কিলার।
যেখানে দর্শককে তিল পরিমাণ হোঁচট খেতে হয়েছে বলে মনে হলো।
নায়িকা জয়ার (নবনী) সাংবাদিক চরিত্রে যথেষ্ট ভালো অভিনয় করেছেন বলে মনে হয় না। জয়াকে দেখে মনে হয়েছে, শেখানো অভিনয় করছেন মেপে মেপে। ইন্দনীলের (সুমন) সামনে ইংরেজিতে সংলাপ বলাটাও বেমানান ঠেকেছে। ছবির শেষের দিকে নায়ক-নায়িকার প্রেমের রসায়ন পরিচালকের আরোপিত এবং দর্শক মনোরঞ্জন ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রেমের আবহ তৈরি না করলেও দর্শক মুগ্ধ হয়ে সিনেমা দেখত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচলিত বাংলা সিনেমার সব ধারা ভেঙ্গে চোরাবালি এগিয়ে গেছে মন্ত্রমুগ্ধ দর্শক নিয়ে। ছবিটির এখানেই মুল সার্থকতা। তবে এখানেও কথা থেকে যায়, রুট লেভেল কি ছবিটি এখনো দেখেছে? দেখলে তাদের মন্তব্য কি?
ছবির প্রাণ ও মূল নায়ক শহিদুজ্জামান সেলিমকে মনে হয়েছে আমার কাছে। ছবি শুরু থেকে দর্শক ধরে রাখার কাজটি অভিনেতা সেলিমই করেছেন।
পুরো ছবি জুড়ে গডফাদার ওসমানরূপী শহিদুজ্জামান সেলিমের হাস্যরস মাখানো সংলাপ-হাসি-শারীরিক চলাফেরা দর্শককে ছবি থেকে বের হতে দেয়নি। সেলিমকে সত্যিকারের ভিলেন মনে হয়েছে।
ছবির শেষটায় পিনপতন নিরবতা নেমে এসেছে দর্শকের মাঝে। কি হয় কি হয় অবস্থা! শেষ দৃশ্য না দেখা পর্যন্ত দর্শকের সিট ছেড়ে ওঠার কোনো সুযোগ নেই।
।
৫।
চোরাবালির মাধ্যমে বাংলা ছবি নতুন যুগে প্রবেশ করবে বলে বিশ্বাস করি। রেদওয়ান রনি আগামী অবশ্যই সিনেমা বানাবেন। সেই ছবিতে নিজেকে তো বটেই চোরাবালিকেও ছাড়িয়ে যাবেন। দর্শক আবারো হলে গিয়ে দেখতে পারবে ‘হাউজফুল’ লেখাটি ঝুঁলছে।
চোরাবালি হোক বাংলা চলচ্চিত্রকে নতুন করে তুলে আনার প্রথম সিঁড়ি। দর্শকের উদ্দেশে বলি, হলে গিয়ে চোরাবালি দেখুন। অবশ্যই চোরাবালি আপনাকে ডোবাবে না। তৃপ্তির আনন্দে ভাসাবে। যেমন করে ভাসাতে চেয়েছে একজন অপরাধীকে অন্ধকার/ চোরাবালি থেকে তুলে আনার ক্ষেত্রে।
পুনশ্চ : চোরাবালি ছবিটি দেখে আমার যা মনে হয়েছে তা খোলাখুলি ভাবেই বলেছি। এখানে কোনো কিছু বানিয়ে বানিয়ে বলা হয়নি। সেকারণে মতামতের দায় শুধুই লেখকের। আবার এই লেখা নিয়েও কোনো বিরূপ কোনো আলোচনার জন্ম হোক, তাও কাম্য নয়। লেখাটি বড় হয়ে গেল, প্রচলিত ‘স্যরি’ বলা ছাড়া অন্য উপায় জানা নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।