আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জলাধার সংরক্ষণে বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন পর্যালোচনা



জলাধার সংরক্ষণে বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন পর্যালোচনা
এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম

বৃহৎ সুপেয় পানি আর নদী-নালার দেশ বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক জলাধার ছাড়াও, এ দেশের রয়েছে অসংখ্য কৃত্রিমভাবে তৈরি জলাধার যেমন পুকুর, দীঘি, খাল। পানি সংকট নিরসনে এ দেশে একসময় সৃষ্টি করা হয়েছে অসংখ্য কৃত্রিম জলাধার। কিন্তু দিনে দিনে দখল, দূষণ আর ভরাটের শিকার হয়েছে দেশের প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম জলাধারগুলো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলাধার দূষণ, দখল ও ভরাটের মাত্রা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।

সরকারী ও বেসরকারী উভয় ভাবেই দেশের জলাধারগুলো দখল, দূষণআর ভরাট হয়ে আসছে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অর্ন্তগত জলাধারগুলো রক্ষায় সুষ্পষ্ট আইন না থাকলেও, প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষায় আইন রয়েছে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, বিদ্যমান আইন প্রয়োগে দূর্বলতা, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও মনিটরিং-এর সীমাবদ্ধতা, অদূরদর্শীতার কারণে দেশের অনেক জলাধার ধ্বংস হয়ে গেছে।

আশার কথা হচ্ছে দেশের জলাধার রক্ষায় পরিবেশ সচেতন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অব্যাহত কার্যক্রমের প্রেক্ষিতে সরকার জলাধার রক্ষায় ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এ সকল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে আইন প্রণয়ন ও সংশোধন, প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ, আইন বাস্তবায়ন ও মনিটরিং প্রক্রিয়া জোরদারকরণ ইত্যাদি।

জলাধার রক্ষায় সর্বোচ্চ আদালতের কঠোর অবস্থানের প্রেক্ষিতে বিদ্যমান আইন বাস্তবায়ন কার্যক্রম বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সকল আইনের সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন দেশের জলাধারগুলো রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালণ করতে পারে।

পানি সাথে সম্পর্কিত অনেকগুলো আইন রয়েছে। সরকারের ৪০ টির বেশি সংস্থা এই আইন ও পানি ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত। জাতীয় পানি নীতি অনুসারে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় পানি সম্পদ পরিষদ।

পানি ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম তদারকি করার দায়িত্ব পরিষদের এবং পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা পরিষদের সচিবিক দায়িত্ব পালন করে থাকে। এ পর্যালোচনায় পানি উৎস সংরক্ষনের সাথে জড়িত নীতিসমূহ বিশেষভাবে আলোচনা করা হল।

পানি ও জলাধার সম্পর্কিত নীতিমালাসমূহ:
জাতীয় পানি নীতি (১৯৯৯), জাতীয় পরিবেশ নীতি (১৯৯২), জাতীয় মৎস নীতি (১৯৯৮), জাতীয় পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন নীতি (১৯৯৮), জাতীয় কৃষি নীতি (১৯৯৯), জাতীয় বনায়ন নীতি (১৯৯৪), জাতীয় শিল্প নীতি (২০১০), জাতীয় পাটনীতি ২০০২, জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালা, জাতীয় নৌ-নীতিমালা (২০০০), স্বাস্থ্যনীতি ২০১১, জাতীয় নারীনীতি ২০১১, জাতীয় ভূমি নীতি, বাংলাদেশে পানি ও স্যানিটেশনের জন্য জাতীয় হাইজিন প্রমোশন কৌশল ২০১১, National Water Management Plan, Coastal Zone Policy| ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

পানি ও জলাধার সম্পর্কিত আইনসমূহ:
বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩; জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩, ২০১৩; মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০; পানি সম্পদ পরিকল্পনা আইন ১৯৯২; বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন, ২০০০; গ্রাউন্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট অর্ডিন্যান্স ১৯৮৫; বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫; ; The Canal Act 1864; The Embankment and Drainage Act 1952; পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন ১৯৯৬; রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০; The Ports Act 1908; The Public Parks Act 1904; The Irrigation Act 1876; The Tanks Improvement Act 1939; The Cantonments Act 1924; The Territorial Waters and Maritime Zones Act 1974; স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন ২০০৯; স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯; স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ইত্যাদি।

পানি সংক্রান্ত অনেক আইন রয়েছে এবং বিভিন্ন সংস্থা এ আইনগুলোর সাথে সম্পৃক্ত।

পানি সংক্রান্ত আইনগুলোকে প্রধানত তিনভাবে ভাগ করা যায়। 1) সংরক্ষণের জন্য আইন, ২) অধিকার সংক্রান্ত এবং ৩) অপরগুলো পানি সম্পদ ব্যবহার সংক্রান্ত আইন। আজকের আলোচনায় পানি সম্পদ বা জলাধার সংরক্ষণের সাথে সম্পর্কিত আইনগুলো বিশ্লেষণ করা হলো।

বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩

পানি সম্পদের সমন্বিত উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা, আহরণ, বিতরণ, ব্যবহার, সুরক্ষা ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে পানি আইন প্রণয়ন করে। এ আইনে গুরুত্বপুর্ণ দিকসমূহ:

১. পানি আইনে খাল, জলাধার, জলাভূমি, বাঁওড়, বাঁধ, বিল, হাওর ইত্যাদিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

জলাধার-এর সংজ্ঞায় নদ-নদী, খাল, বিল, হাওর, বাওর, দীর্ঘি, পুকুর, হ্রদ, ঝর্ণা বা অন্য কোন ধারককে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

২. ভূ-উপরিস্থ, ভূগর্ভস্থ, সামুদ্রিক, বৃষ্টির পানি, বায়ুমন্ডলের পানির উপর অধিকার জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের উপর অর্পণ করা হয়েছে।

৩. সুপেয় পানি এবং পরিচ্ছন্নতা ও পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য ব্যবহার্য পানির অধিকার সর্বাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে।

৪. নীতি নির্ধারক ও দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সভাপতি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী/ সচিব এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় পানি পরিষদ নামে একটি উপদেষ্টামূলক পরিষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

৫. জাতীয় পানি পরিষদের কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একটি নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়েছে।

নির্বাহী কমিটির কার্যক্রমে সহযোগিতা করার জন্য পানি পরিকল্পনা সংস্থার মহাপরিচালকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।

৬ এ আইনে যে সকল ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে তা হলো, অপসারণ আদেশ ইস্যু করার ক্ষমতা, জাতীয় পানি সম্পদ পরিকল্পনা অনুমোদন, পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের ছাড়পত্র ইস্যুকরণ, পানি সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা ও উহার ব্যবস্থাপনা, পানি সংকটাপন্ন এলাকায় পানি সম্পদের অগ্রাধিকারভিত্তিক ব্যবহার ও অব্যাহতি, ভূগর্ভস্থ পানিধারক স্তরের সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ ও ভূগর্ভস্থ পানি আহরণে বিধি-নিষেধ, জলস্রোতের স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিতকরণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের সুরক্ষা, জলাধার সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, পানি অঞ্চলে বিভক্তিকরণ ও উহার ব্যবস্থাপনা, পানি মজুদকরণে বিধি-নিষেধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ অঞ্চল ঘোষণা ও উহার ব্যবস্থাপনা, জলাধারের সমগ্র পানি আহরণে বিধি-নিষেধ, সুরক্ষা আদেশ ইস্যু ও উহার দ্ধারা বিধি-নিষেধ বা শর্তারোপের ক্ষমতা, পানির দূষণ নিয়ন্ত্রণ, ইত্যাদি।

৭. এ আইন অনুসারে নির্বাহী কমিটি আইনের অধীনে আদেশ প্রদানসহ অর্থদন্ড আরোপ করতে পারবে। এ আইনভঙ্গের ক্ষেত্রে জেল ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

পানি আইন, ২০১৩-এর ইতিবাচক দিক

১. পানি আইনে বাংলাদেশের ভুখন্ডের পানি সম্পদকে একক কর্তৃত্বের অধীনে আনা হয়েছে।


২. পানিকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে।
৩. পানি পরিষদ ও নির্বাহী কমিটিতে পানির সাথে সম্পৃক্ত সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
৪. পানি ব্যবহারকারী অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পানি ব্যবহার ও প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে এ আইনের অধীন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে। পানি সম্পদ রক্ষা ও ব্যবহারে এ ধরনের সমন্বয় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

পানি আইন, ২০১৩-এর দূর্বল দিক
১. আইনে পানিকে প্রাণ ও প্রকৃতির অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি।


২. জলাধার দখল, দূষণএবং ভরাট একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। এ আইনে নির্বাহী কমিটির প্রধান হিসেবে পানি সম্পদ মন্ত্রী ছাড়াও কমিটির সদস্য হিসাবে একাধিক মন্ত্রী ও সচিব রয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের এ সকল ব্যক্তিবর্গের জন্য জলাধার দখল, দূষণএবং ভরাট মতো নৈমিত্তিক ঘটনা তদারকি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন। এ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্বাহী কমিটির ক্ষমতা অর্পণ সংক্রান্ত সুস্পষ্ট বিধান করা জরুরি।
৩. পানি বা জলাধারে সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এ আইনের কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা ও সমন্বয়ে ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।


৪. এ আইনে জেল ও জরিমানা বিধান করা হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তি যদি কোন কোম্পানি হয় সে কোম্পানির ক্ষেত্রে শুধু অর্থ দন্ডের বিধান রয়েছে। প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি কর্তৃক একাধিক অপরাধের ক্ষেত্রে কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল বা স্থগিত বা অর্থ জব্দ করার কোন ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি।
৫. এ আইনে কোম্পানির ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমান খুবই কম বিধায় কোম্পানিগুলো দখল, ভরাট ও দুষণরোধে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে না।
৬. কোন প্রতিষ্ঠান জলাধারের ক্ষতিসাধন করলে উক্ত প্রতিষ্ঠান হতে ক্ষতিপুরণ আদায় করার ক্ষমতা বা সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা জরুরি।


৭. এ আইনের অধীন কোন অপরাধ আমলযোগ্য (ঈড়মহরুধনষব) হবে কিনা তা সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি।
৮. জলাধার-এর সংজ্ঞা পানি আইন, ২০১৩, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এবং জলাধার আইন, ২০০০ ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে।
৯. জলাধার রক্ষায় অগ্রগতি বা ব্যর্থতার দায় এ আইনের অধীন ক্ষমতা প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা হিসাবে নিশ্চিত করা হয়নি।


জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩

নদী রক্ষার লক্ষে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে একটি নদী কমিশন আইন প্রণয়ন করে। এ আইনে ০৫ (পাচ) সদস্য বিশিষ্ট একটি স্বতন্ত্র কমিশন গঠন করার বিধান রয়েছে।

এ আইনের অধীন কমিশন নদী দখল, দুষণ, ভরাট ও খনন, প্রতিবেশ, জনসচেতনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে সুপারিশ প্রদান করতে পারবে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩ এর দূর্বল দিক

১. কমিশন একটি উপদেশ প্রদানমূলক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানকে দখল, দুষণ, ভরাটরোধে কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি।
২. এ সংস্থার নিকট অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতার কোন বিধান নেই।
৩. এ প্রতিষ্ঠানকে দখল, দুষণ, ভরাটরোধসহ নদী রক্ষায় যে কোন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদানের ক্ষমতা প্রদান জরুরি।


৪. দখল, দুষণ, ভরাটসহ নদীর যে কোন ক্ষতি সাধিত হলে উক্ত কর্মকান্ড বন্ধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে জরিমানা
অথবা কার্যক্রম বন্ধে নির্দেশনা প্রদানের ক্ষমতা প্রদান জরুরি।
৫. নদী ক্ষতিসাধনকারী ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান হতে ক্ষতিপুরণ আদায়ের ক্ষমতা প্রদান জরুরি।

মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০

প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০-এর গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ:

১. এ আইনে “প্রাকৃতিক জলাধার” অর্থ নদী, খাল, বিল, দীঘি, ঝর্ণা বা জলাশয় হিসাবে মাষ্টার প্লানে চিহ্নিত বা সরকার, স্থানীয় সরকার বা কোন সংস্থা কর্তৃক, সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, বন্যা প্রবাহ এলাকা হিসাবে ঘোষিত কোন জায়গা এবং সলিল পানি এবং বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন কোন ভূমিও এর অন্তর্ভুক্ত হবে বলে নির্দিষ্ট করা হয়েছে;
“কর্তৃপক্ষ” অর্থ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং আপাততঃ বলবত্ অন্য কোন আইনের অধীন প্রতিষ্ঠিত কোন শহর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশন এবং বিভাগীয় ও জেলা শহরের পৌরসভাসহ দেশের সকল পৌরসভা;

২. এই আইনের বিধান অনুযায়ী ব্যতীত, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসাবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না বা উক্তরূপ জায়গা অন্য কোনভাবে ব্যবহার করা যাবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনভাবে হস্তান্তর করা যাবে না৷

৩. কোন জায়গা বা জায়গার অংশবিশেষের শ্রেণী পরিবর্তন করার প্রয়োজন হলে উক্ত জায়গার মালিক, প্রস্তাবিত পরিবর্তনের কারণ লিপিবদ্ধ করে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের নিকট আবেদন করবে৷ আবেদনপত্র প্রাপ্তির ৬০ দিনের মধ্যে কর্তৃপক্ষ আবেদনপত্রটি বিবেচনা করে আবেদনাধীন জায়গার শ্রেণী পরিবর্তন জনস্বার্থে সমীচীন হবে কিনা সেই সম্পর্কে, অন্যান্যের মধ্যে, নি¤œবর্ণিত বিষয়ের উপর সুষ্পষ্ট মতামত এবং সুপারিশ সহকারে আবেদনটি সরকার বরাবরে প্রেরণ করবে, যথাbr />
(ক) আবেদনাধীন জায়গার শ্রেণী পরিবর্তন করা হইলে মাষ্টার প্লানের উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিনা, হলে এর পরিমাণ; এবং

(খ) শ্রেণী পরিবর্তনজনিত কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশের উপর কোন ক্ষতিকর প্রভাব পড়িবে কিনা বা বসবাসকারীগণের অন্য কোনপ্রকার ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা আছে কিনা৷

৫. কোন ব্যক্তি এই আইনের কোন বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অনধিক ৫ বৎসরের কারাদন্ডে বা অনধিক ৫০(পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদন্ডে অথবা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হবেন৷বিধান লঙ্ঘন করে যদি কোন জায়গা বা জায়গার অংশ বিশেষের শ্রেণী পরিবর্তন করা হয়, তা হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নোটিশ দ্বারা জমির মালিককে অথবা বিধান লঙ্ঘনকারী ব্যক্তিকে নোটিশে উল্লেখিত জায়গার শ্রেণী পরিবর্তনের কাজে বাধা প্রদান করতে পারবে এবং নির্ধারিত পদ্ধতিতে অননুমোদিত নির্মাণ কাজ ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দিতে পারবে এবং অন্য কোন আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, উক্তরূপ ভেঙ্গে ফেলার জন্য কোন ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে না৷

প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০-এর দূর্বল দিক

১. এ আইনে প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে মাষ্টার প্লান বা গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা চিহ্নিত স্থানকে বোঝানো হয়েছে। দেশে বর্তমানে নদী দখল ও ভরাট অব্যাহতভাবে চলছে এবং অনেক এলাকা/স্থান রয়েছে, যেখানে মাষ্টার প্লান তৈরি হয়নি। ফলে এ সকল স্থানের জলাধারগুলো অরক্ষিত হবে।


২. ব্যক্তিগত জলাধারগুলো এ আইনের মাধ্যমে সংরক্ষরণ করা যাবে না।
৩. জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদের এ আইনে কোন ধরনের ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি।
৪. সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে জলাধারের শ্রেণী পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। যা জলাধারের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরুপ।
৫. এ আইনে জেল ও জরিমানা বিধান রাখাা হয়েছে।

এ আইনে কোম্পানির ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমান খুবই কম বিধায় কোম্পানিগুলো দখল রোধে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে না।
৬. ব্যক্তি যদি কোন কোম্পানি হয় সে ক্ষেত্রে কোম্পানিকে জরিমানার বিধান নেই। প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি কর্তৃক অপরাধের ক্ষেত্রে কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল বা স্থগিত বা অর্থ জব্দ করার কোন ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি।
৭. কোন প্রতিষ্ঠান জলাধারের ক্ষতিসাধন করলে উক্ত প্রতিষ্ঠান হতে ক্ষতিপুরণ আদায় করার ক্ষমতা বা সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা জরুরি।
৮. জলাধার রক্ষায় অগ্রগতি বা ব্যর্থতায় এ আইনের অধীন ক্ষমতা প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হয়নি।



স্থানীয় সরকার আইনসমূহে জলাধার সংরক্ষণের ক্ষমতা

ইউনিয়ন পরিষদ আইন, ২০০৯

ইউনিয়ন পরিষদ আইন, ২০০৯ এর দ্বিতীয় তফসিলের ধারা ২৪ বলা হয়েছে ‘‘ কুয়া, পানি তোলার কল, জলাধার, পুকুর এবং পানি সরবরাহের অন্যান্য উৎসের ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব হবে। এ আইনের ধারা ৯৭ (ঢ) অনুসারে ইউনিয়ন পরিষদকে অবৈধ দখল রোধে প্রবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।

স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯
১. এ আইনের ধারা ২ এর উপধারা ১২ তে “ওয়াটার ওয়ার্কস” অর্থে কোন হ্রদ, জলপ্রবাহ, ঝর্ণা, কূপ, পাম্প, সংরক্ষিত-জলাধার, পুকুর, নল, জলকপাট, পাইপ, কালভার্ট এবং পানি সরবরাহ বা ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত অন্যান্য যন্ত্রপাতিকে বুঝানো হয়েছে।

২. আইনের তৃতীয় তফসিলে সরকারী জলাধার শিরোনামে বলা হয়েছে,
ক) সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে কর্পোরেশন ব্যক্তি মালিকাধীন নহে এবং নগরীরর মধ্যে অবস্থিত এইরূপ সকল পানির উৎস, ঝর্ণা, নদী, দীঘি, পুকুর ও ধারা অথবা উহার কোন অংশকে সরকারী জলাধার হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে। (৮.১৫)

খ) উক্ত সরকারী জলাধারে চিত্ত-বিনোদন এবং জীবন রক্ষার নিমিত্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে এবং পানি সেচ, পানি নিষ্কাশন ও নৌ-চলাচল সম্পর্কিত আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনের বিধান সাপেক্ষে এর উন্নয়ন ও সংস্কার করতে পারবে।

(৮.১৬)

গ) কর্পোরেশন জলাধার আইনের বিধান অনুযায়ী কর্পোরেশনভুক্ত সকল জলাধার রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী থাকবে। (৮.১৭)



স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯

পৌরসভা আইনে তফসিলের ধারা ১৬-এ জলাধার সংরক্ষণ সর্ম্পকে বলা হয়েছে-
১. যথাযথ কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদনক্রমে পৌরসভা ব্যক্তি মালিকাধীন নহে এবং নগরীর মধ্যে অবস্থিত এইরূপ সকল পানির উৎস, ঝর্ণা, নদী, দীঘি, পুকুর ও ধারা অথবা উহার কোন অংশকে সরকারী জলাধার হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে।

২. পৌরসভা প্রবিধান অনুযায়ী কোন সরকারী জলাধারে আমোদ-প্রমোদ এবং জীবন রক্ষার নিমিত্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে এবং পানি সেচ, পানি নিষ্কাশন ও নৌ-চলাচল সম্পর্কিত আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনের বিধান সাপেক্ষে এর উন্নয়ন ও সংস্কার করতে পারবে।

৩. সরকারি জলাধারকে দূষণমুক্ত রাখার লক্ষে, যদি কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ দূষিত করার প্রয়াস চালায়, দূষিত করেন বা দুষিত করার সাথে জড়িত থাকেন, তা হলে পৌরসভা তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

৪. যে ক্ষেত্রে দূষণের উৎসমূল পৌরসভা বর্হিভুত হয় সেই ক্ষেত্রে পৌরসভা প্রচলিত আইন অনুসারে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।



পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিবেশগত মান উন্নয়ন, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমন-এ সময়োপযোগী, কার্যকর ও শক্তিশালী একটি আইন। এ আইনটি ২০১০ সালে সংশোধনের মাধ্যমে জলাধার সংক্রান্ত বিধান সংযোজন করা হয়েছে।

১. আইনের ধারা ২ উপধারা (কক) অনুসারে ‘‘জলাধার” অর্থ নদী, খাল, বিল, হাওড়, দীঘি, পুকুর, ঝর্ণা বা জলাশয় হিসেবে সরকারী ভুমি রেকর্ডে চিহ্নিত ভূমি বা সরকার, স্থানীয় সরকার বা সরকারী কোন সংস্থা কর্তৃক সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা ঘোষিত কোন জলাভূমি, বন্যাপ্রবাহ এলাকা, সলল পানি ও বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন কোন ভূমি;

২. আইনের ধারা ৬ঙ তে বলা হয়েছে আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনের যাহা কিছুই থাকুক না কেন জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গা ভরাট বা অন্য কোনভাবে শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না। তবে শর্ত থাকে যে, অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণক্রমে জলাধার সম্পর্কিত বাধা নিষেধ শিথিল করা যেতে পারে।


সুপারিশ
 পানি আইন অনুসারে জলাধার রক্ষায় একটি পৃথক বিধিমালা প্রণয়ন

 জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস) প্রযুক্তির মাধ্যমে সিএস অনুসারে নদী, খাল, হাওর, বাওয়ার, পুকুরগুলো সীমানা চিহ্নিত ও প্রকাশ করা।



 জেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব প্রদান জলাধারগুলো উদ্ধারের

 স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতা প্রদান জলাধার সংরক্ষন করার

 জলাধার রক্ষার আইনের বাস্তবায়নে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাজেট বরাদ্ধ

 জলাধার রক্ষায় উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিশন গঠন করা।

 জলাধার রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জবাবদিহীতা নিশ্চিত করা।


বৃহৎ সুপেয় পানি আর নদী-নালার দেশ বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক জলাধার ছাড়াও, এ দেশের রয়েছে অসংখ্য কৃত্রিমভাবে তৈরি জলাধার যেমন পুকুর, দীঘি, খাল। পানি সংকট নিরসনে এ দেশে একসময় সৃষ্টি করা হয়েছে অসংখ্য কৃত্রিম জলাধার।

কিন্তু দিনে দিনে দখল, দূষণ আর ভরাটের শিকার হয়েছে দেশের প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম জলাধারগুলো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলাধার দূষণ, দখল ও ভরাটের মাত্রা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারী ও বেসরকারী উভয় ভাবেই দেশের জলাধারগুলো দখল, দূষণআর ভরাট হয়ে আসছে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অর্ন্তগত জলাধারগুলো রক্ষায় সুষ্পষ্ট আইন না থাকলেও, প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষায় আইন রয়েছে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা, বিদ্যমান আইন প্রয়োগে দূর্বলতা, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও মনিটরিং-এর সীমাবদ্ধতা, অদূরদর্শীতার কারণে দেশের অনেক জলাধার ধ্বংস হয়ে গেছে।



আশার কথা হচ্ছে দেশের জলাধার রক্ষায় পরিবেশ সচেতন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অব্যাহত কার্যক্রমের প্রেক্ষিতে সরকার জলাধার রক্ষায় ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এ সকল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে আইন প্রণয়ন ও সংশোধন, প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ, আইন বাস্তবায়ন ও মনিটরিং প্রক্রিয়া জোরদারকরণ ইত্যাদি। জলাধার রক্ষায় সর্বোচ্চ আদালতের কঠোর অবস্থানের প্রেক্ষিতে বিদ্যমান আইন বাস্তবায়ন কার্যক্রম বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সকল আইনের সঠিক প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন দেশের জলাধারগুলো রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালণ করতে পারে।

পানি সাথে সম্পর্কিত অনেকগুলো আইন রয়েছে।

সরকারের ৪০ টির বেশি সংস্থা এই আইন ও পানি ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত। জাতীয় পানি নীতি অনুসারে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় পানি সম্পদ পরিষদ। পানি ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম তদারকি করার দায়িত্ব পরিষদের এবং পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা পরিষদের সচিবিক দায়িত্ব পালন করে থাকে। এ পর্যালোচনায় পানি উৎস সংরক্ষনের সাথে জড়িত নীতিসমূহ বিশেষভাবে আলোচনা করা হল।

পানি ও জলাধার সম্পর্কিত নীতিমালাসমূহ:
জাতীয় পানি নীতি (১৯৯৯), জাতীয় পরিবেশ নীতি (১৯৯২), জাতীয় মৎস নীতি (১৯৯৮), জাতীয় পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন নীতি (১৯৯৮), জাতীয় কৃষি নীতি (১৯৯৯), জাতীয় বনায়ন নীতি (১৯৯৪), জাতীয় শিল্প নীতি (২০১০), জাতীয় পাটনীতি ২০০২, জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালা, জাতীয় নৌ-নীতিমালা (২০০০), স্বাস্থ্যনীতি ২০১১, জাতীয় নারীনীতি ২০১১, জাতীয় ভূমি নীতি, বাংলাদেশে পানি ও স্যানিটেশনের জন্য জাতীয় হাইজিন প্রমোশন কৌশল ২০১১, National Water Management Plan, Coastal Zone Policy| ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।



পানি ও জলাধার সম্পর্কিত আইনসমূহ:
বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩; জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩, ২০১৩; মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০; পানি সম্পদ পরিকল্পনা আইন ১৯৯২; বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন, ২০০০; গ্রাউন্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট অর্ডিন্যান্স ১৯৮৫; বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫; ; The Canal Act 1864; The Embankment and Drainage Act 1952; পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন ১৯৯৬; রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০; The Ports Act 1908; The Public Parks Act 1904; The Irrigation Act 1876; The Tanks Improvement Act 1939; The Cantonments Act 1924; The Territorial Waters and Maritime Zones Act 1974; স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন ২০০৯; স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯; স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ইত্যাদি।

পানি সংক্রান্ত অনেক আইন রয়েছে এবং বিভিন্ন সংস্থা এ আইনগুলোর সাথে সম্পৃক্ত। পানি সংক্রান্ত আইনগুলোকে প্রধানত তিনভাবে ভাগ করা যায়। 1) সংরক্ষণের জন্য আইন, ২) অধিকার সংক্রান্ত এবং ৩) অপরগুলো পানি সম্পদ ব্যবহার সংক্রান্ত আইন। আজকের আলোচনায় পানি সম্পদ বা জলাধার সংরক্ষণের সাথে সম্পর্কিত আইনগুলো বিশ্লেষণ করা হলো।



বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩

পানি সম্পদের সমন্বিত উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা, আহরণ, বিতরণ, ব্যবহার, সুরক্ষা ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে পানি আইন প্রণয়ন করে। এ আইনে গুরুত্বপুর্ণ দিকসমূহ:

১. পানি আইনে খাল, জলাধার, জলাভূমি, বাঁওড়, বাঁধ, বিল, হাওর ইত্যাদিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। জলাধার-এর সংজ্ঞায় নদ-নদী, খাল, বিল, হাওর, বাওর, দীর্ঘি, পুকুর, হ্রদ, ঝর্ণা বা অন্য কোন ধারককে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

২. ভূ-উপরিস্থ, ভূগর্ভস্থ, সামুদ্রিক, বৃষ্টির পানি, বায়ুমন্ডলের পানির উপর অধিকার জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের উপর অর্পণ করা হয়েছে।

৩. সুপেয় পানি এবং পরিচ্ছন্নতা ও পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য ব্যবহার্য পানির অধিকার সর্বাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে।



৪. নীতি নির্ধারক ও দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সভাপতি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী/ সচিব এবং বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় পানি পরিষদ নামে একটি উপদেষ্টামূলক পরিষদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

৫. জাতীয় পানি পরিষদের কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একটি নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়েছে। নির্বাহী কমিটির কার্যক্রমে সহযোগিতা করার জন্য পানি পরিকল্পনা সংস্থার মহাপরিচালকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।

৬ এ আইনে যে সকল ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে তা হলো, অপসারণ আদেশ ইস্যু করার ক্ষমতা, জাতীয় পানি সম্পদ পরিকল্পনা অনুমোদন, পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের ছাড়পত্র ইস্যুকরণ, পানি সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা ও উহার ব্যবস্থাপনা, পানি সংকটাপন্ন এলাকায় পানি সম্পদের অগ্রাধিকারভিত্তিক ব্যবহার ও অব্যাহতি, ভূগর্ভস্থ পানিধারক স্তরের সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ ও ভূগর্ভস্থ পানি আহরণে বিধি-নিষেধ, জলস্রোতের স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিতকরণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের সুরক্ষা, জলাধার সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, পানি অঞ্চলে বিভক্তিকরণ ও উহার ব্যবস্থাপনা, পানি মজুদকরণে বিধি-নিষেধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ অঞ্চল ঘোষণা ও উহার ব্যবস্থাপনা, জলাধারের সমগ্র পানি আহরণে বিধি-নিষেধ, সুরক্ষা আদেশ ইস্যু ও উহার দ্ধারা বিধি-নিষেধ বা শর্তারোপের ক্ষমতা, পানির দূষণ নিয়ন্ত্রণ, ইত্যাদি।

৭. এ আইন অনুসারে নির্বাহী কমিটি আইনের অধীনে আদেশ প্রদানসহ অর্থদন্ড আরোপ করতে পারবে।

এ আইনভঙ্গের ক্ষেত্রে জেল ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

পানি আইন, ২০১৩-এর ইতিবাচক দিক

১. পানি আইনে বাংলাদেশের ভুখন্ডের পানি সম্পদকে একক কর্তৃত্বের অধীনে আনা হয়েছে।
২. পানিকে রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে।
৩. পানি পরিষদ ও নির্বাহী কমিটিতে পানির সাথে সম্পৃক্ত সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
৪. পানি ব্যবহারকারী অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পানি ব্যবহার ও প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে এ আইনের অধীন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে।

পানি সম্পদ রক্ষা ও ব্যবহারে এ ধরনের সমন্বয় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

পানি আইন, ২০১৩-এর দূর্বল দিক
১. আইনে পানিকে প্রাণ ও প্রকৃতির অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি।
২. জলাধার দখল, দূষণএবং ভরাট একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। এ আইনে নির্বাহী কমিটির প্রধান হিসেবে পানি সম্পদ মন্ত্রী ছাড়াও কমিটির সদস্য হিসাবে একাধিক মন্ত্রী ও সচিব রয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের এ সকল ব্যক্তিবর্গের জন্য জলাধার দখল, দূষণএবং ভরাট মতো নৈমিত্তিক ঘটনা তদারকি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন।

এ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্বাহী কমিটির ক্ষমতা অর্পণ সংক্রান্ত সুস্পষ্ট বিধান করা জরুরি।
৩. পানি বা জলাধারে সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এ আইনের কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা ও সমন্বয়ে ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।
৪. এ আইনে জেল ও জরিমানা বিধান করা হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তি যদি কোন কোম্পানি হয় সে কোম্পানির ক্ষেত্রে শুধু অর্থ দন্ডের বিধান রয়েছে। প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি কর্তৃক একাধিক অপরাধের ক্ষেত্রে কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল বা স্থগিত বা অর্থ জব্দ করার কোন ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি।


৫. এ আইনে কোম্পানির ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমান খুবই কম বিধায় কোম্পানিগুলো দখল, ভরাট ও দুষণরোধে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে না।
৬. কোন প্রতিষ্ঠান জলাধারের ক্ষতিসাধন করলে উক্ত প্রতিষ্ঠান হতে ক্ষতিপুরণ আদায় করার ক্ষমতা বা সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা জরুরি।
৭. এ আইনের অধীন কোন অপরাধ আমলযোগ্য (ঈড়মহরুধনষব) হবে কিনা তা সুস্পষ্ট করে বলা হয়নি।
৮. জলাধার-এর সংজ্ঞা পানি আইন, ২০১৩, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এবং জলাধার আইন, ২০০০ ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে।
৯. জলাধার রক্ষায় অগ্রগতি বা ব্যর্থতার দায় এ আইনের অধীন ক্ষমতা প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা হিসাবে নিশ্চিত করা হয়নি।




জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩

নদী রক্ষার লক্ষে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে একটি নদী কমিশন আইন প্রণয়ন করে। এ আইনে ০৫ (পাচ) সদস্য বিশিষ্ট একটি স্বতন্ত্র কমিশন গঠন করার বিধান রয়েছে। এ আইনের অধীন কমিশন নদী দখল, দুষণ, ভরাট ও খনন, প্রতিবেশ, জনসচেতনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারকে সুপারিশ প্রদান করতে পারবে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩ এর দূর্বল দিক

১. কমিশন একটি উপদেশ প্রদানমূলক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানকে দখল, দুষণ, ভরাটরোধে কোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি।


২. এ সংস্থার নিকট অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতার কোন বিধান নেই।
৩. এ প্রতিষ্ঠানকে দখল, দুষণ, ভরাটরোধসহ নদী রক্ষায় যে কোন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদানের ক্ষমতা প্রদান জরুরি।
৪. দখল, দুষণ, ভরাটসহ নদীর যে কোন ক্ষতি সাধিত হলে উক্ত কর্মকান্ড বন্ধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাকে জরিমানা
অথবা কার্যক্রম বন্ধে নির্দেশনা প্রদানের ক্ষমতা প্রদান জরুরি।
৫. নদী ক্ষতিসাধনকারী ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান হতে ক্ষতিপুরণ আদায়ের ক্ষমতা প্রদান জরুরি।

মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০

প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০-এর গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ:

১. এ আইনে “প্রাকৃতিক জলাধার” অর্থ নদী, খাল, বিল, দীঘি, ঝর্ণা বা জলাশয় হিসাবে মাষ্টার প্লানে চিহ্নিত বা সরকার, স্থানীয় সরকার বা কোন সংস্থা কর্তৃক, সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, বন্যা প্রবাহ এলাকা হিসাবে ঘোষিত কোন জায়গা এবং সলিল পানি এবং বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন কোন ভূমিও এর অন্তর্ভুক্ত হবে বলে নির্দিষ্ট করা হয়েছে;
“কর্তৃপক্ষ” অর্থ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং আপাততঃ বলবত্ অন্য কোন আইনের অধীন প্রতিষ্ঠিত কোন শহর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশন এবং বিভাগীয় ও জেলা শহরের পৌরসভাসহ দেশের সকল পৌরসভা;

২. এই আইনের বিধান অনুযায়ী ব্যতীত, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসাবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না বা উক্তরূপ জায়গা অন্য কোনভাবে ব্যবহার করা যাবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনভাবে হস্তান্তর করা যাবে না৷

৩. কোন জায়গা বা জায়গার অংশবিশেষের শ্রেণী পরিবর্তন করার প্রয়োজন হলে উক্ত জায়গার মালিক, প্রস্তাবিত পরিবর্তনের কারণ লিপিবদ্ধ করে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের নিকট আবেদন করবে৷ আবেদনপত্র প্রাপ্তির ৬০ দিনের মধ্যে কর্তৃপক্ষ আবেদনপত্রটি বিবেচনা করে আবেদনাধীন জায়গার শ্রেণী পরিবর্তন ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.