কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সদস্য থাকাকালীন ১৯৮৭ সালের ৯ অক্টোবর আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। দিনাজপুরে স্কুলে পড়াশোনার সময়ই তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ভাষাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গেও তিনি যুক্ত হন এবং দিনাজপুরের ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্ব দেন। তিনি কলেজছাত্র সংসদেও সাধারণ সম্পাদক এবং সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এসব আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি দিনাজপুরের কমিউনিস্ট ও কৃষক আন্দোলনের নেতাদের সংস্পর্শে আসেন।
দিনাজপুর এবং গোটা উত্তরবঙ্গে কমিউনিস্ট ও কৃষক আন্দোলন তখন বেশ শক্তিশালী। তরুণ সমাজের অনেকেই সেদিন প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। অনেকেই আত্মগোপন অবস্থায় কর্মরত কিংবদন্তিতুল্য নেতাদের সংস্পর্শে আসেন।
১৯৩৮ সালের ৫ জুলাই ফরহাদের জন্ম। অল্প বয়সেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।
১৯৫৮ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালের আইয়ুবের সামরিক শাসন জারির পর গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের ওপর দমননীতি নেমে আসে। সেই অবস্থায় ফরহাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে গোপনে ছাত্রদের সংগঠিত করতে থাকেন। ১৯৬১ সালের সে সময়ে আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক কমরেড মণি সিংহ এবং আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে কয়েক দফা গোপন বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে সমঝোতা হয়।
ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগসহ ছাত্র সমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আরো জোরদার হতে থাকে। গড়ে ওঠে ঐতিহাসিক শিক্ষা আন্দোলন। এ আন্দোলনের মূল নেতা ছিলেন কমরেড ফরহাদ। গোপন অবস্থায় থেকে ছাত্রছাত্রীদের সংগঠিত করা, আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলা, তরুণদের মধ্য থেকে অগ্রসর কর্মীদের পার্টিতে টেনে আনা- এসব ক্ষেত্রে ফরহাদের অবদান ছিল ঐতিহাসিক। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে তিনি প্রথমে কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা কমিটি করে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন।
১৯৬৬ সালে মস্কো-পিকিং বিরোধের সময় পার্টিকে রক্ষা করার ব্যাপারে ফরহাদ বিশেষ অবদান রাখেন। ষাটের দশকের শেষের দিক থেকে বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা-সংগ্রাম যখন ক্রমেই দানা বেঁধে উঠছিল কমরেড ফরহাদ তখন তা সঠিকভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে তিনি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও স্তরের মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট ছিলেন। একই সঙ্গে গণতন্ত্র ও স্বাধিকার-সংগ্রাম যাতে প্রগতি ও মুক্তিসংগ্রামের পথেই অগ্রসর হয়, সে ব্যাপারেও তিনি সচেতন ছিলেন। ১৯৬৯ সালের সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবিতে বাংলার স্বাধিকারের দাবির সঙ্গে শ্রমিক কৃষক জনগণের দাবি, জাতীয়করণের দাবি এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে কমরেড ফরহাদ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কমরেড ফরহাদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। মুক্তিফ্রন্ট বা কোনো ধরনের ঐক্য গঠনে আওয়ামী লীগের অস্বীকৃতি, একটি বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থায় কমিউনিস্টদের সশস্ত্র ট্রেনিং সংগঠিত করা ছিল জটিল কাজ। মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা, ভারতে সিপিআইয়ের অবস্থান ও মিসেস গান্ধীর সঙ্গে সিপিআইয়ের সম্পর্ক ইত্যাদি পরিস্থিতির মধ্যে পার্টি নেতাদের এবং কমরেড ফরহাদের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের বিশেষ গেরিলা বাহিনী।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে সিপিবির দ্বিতীয় কংগ্রেসে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
কমরেড ফরহাদ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যেসব নেতা-কর্মী দৈনন্দিন যত্নের মধ্য দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন, তাঁদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে পার্টির কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতৃত্বে অতিষ্ঠিত হন। তাঁদের অনেকেই ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, ক্ষেতমজুর সমিতি, মহিলা পরিষদ, কৃষক সমিতি প্রভৃতি গণসংগঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর নতুন করে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলা, হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে প্রথম মিছিল সংগঠিত করা- সব ক্ষেত্রেই ফরহাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের জন্য, শ্রমিক কৃষক জনগণের স্বার্থে লড়াই করতে গিয়ে কমিউনিস্টরা বারবার দমন-পীড়নের শিকার হন। কমরেড ফরহাদকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে 'রাষ্ট্রদ্রোহ' মামলা করা হয়।
১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৫ দল গড়ে তোলার ব্যাপারেও ফরহাদের বিশেষ অবদান ছিল। ষাটের দশক থেকে তিন দশকেরও বেশি সময়জুড়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ফরহাদ দেশের মানুষের মুক্তিসংগ্রামের পুরোভাগে থেকেছেন। অনেক সময়জুড়ে আত্মগোপন অবস্থায় নেপথ্যে থেকে কাজ করার জন্য তাঁর ভূমিকা তেমন প্রকাশিত নয়। কিন্তু সেসব আন্দোলনে যাঁরা আগ্রহী ছিলেন তাঁরা ফরহাদকে জানতেন এবং তাঁর ভূমিকা উপলব্ধি করতেন। ফরহাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, একজন পেশাদার বিপ্লবীর চরিত্র, অপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতা, নীতিতে অবিচল থেকে কৌশলে নমনীয়তা তাঁকে ক্রমেই জাতীয় পর্যায়ে একজন স্বীকৃত সংগঠক ও জননেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
আদর্শ, নিষ্ঠা, দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, সমাজতন্ত্র ও মানবমুক্তির সংকল্পে অবিচল কমরেড ফরহাদের মতো সংগঠক ও নেতার আজ খুবই প্রয়োজন।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও লেখক ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।