গণমানুষের সংবিধান, মুক্তিসংগ্রামের সূর্যছটা
ফকির ইলিয়াস
======================================
কথা হচ্ছিল সরকারি দলের একজন প্রভাবশালী সাংসদের সাথে। তিনি বললেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের সরকার বদ্ধপরিকর। বললেন, এ জন্য নিজ দলীয় কোন সন্ত্রাসীকেও তারা ছাড় দিচ্ছেন না। তার কথা শোনে আমি হেসে উঠি। বলি, সন্ত্রাসীদের আবার দল হয় না কি? তিনি জবাব দেন।
বলেন, না হয় না। তবে আরো কিছু রাজনৈতিক দলতো প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী পোষে। আমি বলি, জনগণ তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে বলেই তো আপনাদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে নিরংকুশ ভোট দিয়েছে।
হ্যাঁ, দুই তৃতীয়াংশ ব্রুট মেজরিটি নিয়ে মতায় এসেছে মহাজোট সরকার। তারা কি জন প্রত্যাশা পূরণে ঠিক মতো কাজ করছে কিংবা করতে পারছে ? এই প্রশ্নটি নানা ভাবে আসছে।
সরকারকে অস্থিতিশীল করে তুলতে বিভিন্ন মহল তৎপর। দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে সর্বহারা পার্টি নামের একটি চরমপন্থী বাহিনীও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি কুষ্টিয়ার তসলিমা খানম আঁখি নামের একজন চরমপন্থী ক্যাডার গ্রেফতার হয়েছে। এই ‘লেডী মাস্তান’ স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেত্রী বলেও খবর বেরিয়েছে। তার কাছ থেকে একটি ‘একে ফরটি সেভেন’ রাইফেলসও উদ্ধার করা হয়েছে।
তাকে আওয়ামী নাম থেকে বহিষ্কারের আদেশও দিয়েছে স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা।
সরকারের ভেতরে চরম সন্ত্রাসীরা ঢুকে গিয়ে নানা মতলব হাসিল করার ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসকরা যখন বাংলাদেশের গণমানুষের উপর ঝেঁকে বসে তখনই সন্ত্রাসীরা রাষ্ট্রীয় আশ্রয় পাবার মদদ পায়। রাজাকার, রাষ্ট্রদ্রোহী পেশী শক্তিকে আসকারা দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার অপচেষ্টা করেন ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোট প্রদানকারী সামরিক জান্তারা।
এর পরের ইতিহাস আরো মর্মান্তিক।
এক সময়ের যুব মন্ত্রী আবুল কাশেমের বাসায় নিরাপদ আশ্রয় থেকে গ্রেফতার করা হয় গাল কাটা কামাল, ইমদু প্রভৃতি শীর্ষ সন্ত্রাসীকে। আর সেভাবেই সন্ত্রাস লালনে আরেক ধাপ এগিয়ে এদেশে দীর্ঘতম সামরিক শাসন কায়েম করেন জেনারেল হোসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এরশাদের ট্রাক উঠে গিয়েছিলেন গণমানুষের মিছিলের উপর। নূর হোসেন, ডা· মিলন, শাহজাহান সিরাজ, রউফুন বসুনিয়া প্রমুখ অনেক মেধাবী নেতা কর্মীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বিশেষ বাহিনী লেলিয়ে দেয়া হয় নিরীহ জনগণের উপর।
বাংলাদেশের মহান সংবিধানকে কারণে-অকারণে সংশোধনের নামে , দলীয় স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করা হয়।
বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল। সেই সংবিধানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে একটি বাঙালির মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল। সেই সংবিধানটি হত্যা করেই সামরিক সুবিধাভোগীরা নতুন দল করেন। নতুন জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা সাজেন।
একটি কথা মনে রাখা দরকার, মহান মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, মণিপুরী, গারো, মারমা, হাজং , সাওতাল প্রভৃতি জাতি-উপজাতি, ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ ,কি চেতনা নিয়ে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল? তা ছিল একটি স্বাধীন জন্মভূমি প্রতিষ্ঠা। একটি পরিশুদ্ধ সামাজিক রাষ্ট্র।
সেই চেতনাটিকেই ভূলুণ্ঠিত করে রাজাকারদের মদদপুষ্ট সামরিক সরকার। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ধবজাধারীরা ‘হিন্দু-মুসলমান’ তত্ত্ব বাধিয়ে যে রায়ট ঘটিয়েছিল, সেই চেতনার ছুরিতে শান দিতে উদ্যত হয় এই প্রতারক দুষ্ট চক্র।
দুই·
এটি অত্যন্ত আশার কথা মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাহাত্তর এর সংবিধান পুনর্বহাল করার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন।
সেই সংবিধানে ফিরে যাবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর প্রতি নজর রাখার জন্যও অনুরোধ জানিয়েছেন। সবমিলিয়ে জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছে ফিরে যাচ্ছে এটা অত্যন্তই আশার কথা।
এই ঘোষণাটি ইতোমধ্যে অনেকের গাত্রদাহের কারণ হয়েছে। তারা বলছে, আওয়ামীলীগই বহুদলীয়, গণতন্ত্র হত্যা করেছিল।
যারা সেই সময় বাকশালে যোগ দেবার জন্য তৎপর ছিলেন, যোগ দিয়েছিলেন কিংবা বাকশালকে অভিনন্দন জানিয়ে লাইম লাইটে আসার চেষ্টা করেছিলেন, আজ তাদের লম্পঝম্প দেখলে, করুণা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। বাকশালের ‘গভর্ণর’ হয়ে যারা ক্ষমতা ভোগ করেছিলেন আজ তারাই হয়ে গেছেন চরম বাকশাল বিরোধী।
একটি কথা মনে রাখা দরকার, জাতি ও প্রজন্ম কখনই সত্য বিস্মৃত হয় না। আর সংবিধান সেই জাতির আশা আকাংখাই বহন করে চলে। বাংলাদেশের কতিপয় সুবিধাবাদী রাজনীতিকরা, যারা নৈতিকভাবে একাত্তরে পরাজিত হয়ে ছিলেন তারা শোধ নেবার জন্যই বাহাত্তরের সংবিধানটিকে কাটা ছেঁড়া করেছেন নির্মমভাবে।
সেই পক্ষটিই আজ শিক্ষানীতি নিয়েও নানা প্রপাগান্ডা ছড়াবার অপচেষ্টা করছে। একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দুটি শিক্ষানীতি কখনই থাকতে পারে না। এছাড়া সেকেলে শিক্ষানীতি পরিবর্তন করে এর আধুনিকরণ সময়ের দাবীও। বাংলাদেশের একটি মহল ধর্মের দোহাই দিয়ে সব সময়ই তাদের মতলব হাসিল করার চেষ্টা করে আসছে। সময় এসেছে এই চক্রটির সকল অশুভ তৎপরতা রুখে দেবার।
শিক্ষানীতি সম্পর্কে প্রতিবেশী দেশসমূহ এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আদর্শ হতে পারে। মনে রাখতে হবে, সরকারকে যে কোন সৃজনশীল কাজে হাত দিলেও একটি পক্ষ এর বিরোধিতা করবেই। কিন্তু সকল বিরোধিতাকে পাত্তা দিলে তো জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
বর্তমান সরকারের প্রধান শক্তি হচ্ছে তাদের হাতে দুই তৃতীয়াংশ ব্রুট মেজরিটি রয়েছে। কিন্তু তাই বলে এর অপচয় কিংবা অপব্যবহার করা সমীচিন হবে না।
দেশের মানুষ আসলেই পরিবর্তন চায়। এই পরিবর্তনের স্বরূপ কি তা সরকারকেই অনুধাবন করতে হবে। প্রধান বিরোধী দল ক্রমশঃ হরতাল অবরোধ প্রভৃতির হুমকি দেবে। এবং তা করাও শুরু করবে। তাই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই সরকারকে সমকালের সাথে পাল্লা দিয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত।
১৯৭১ সালে মুক্তি সংগ্রামের যে সূর্যছটা মানুষ দেখেছিল, সেই স্বপ্নের রেশ ধরেই প্রজন্ম খুঁজছে সুখী বাংলাদেশের সুখ। আর এই সুখের প্রধান চাওয়াটি হচ্ছে, জানমালের নিরাপত্তা। যে সংবিধান সেটা নিশ্চিত করে সেটাই হচ্ছে, গণমানুষের সংবিধান। বাংলাদেশের বর্তমান পার্লামেন্টে ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণেতা যে সব সম্মানিত এম পিরা রয়েছেন, তাদেরকে সেই সংবিধানের প্রকৃত চেতনাটি তুলে ধরার বিনীত অনুরোধ জানাই। আগামী যে কোন একটি সংসদ অধিবেশনে এই বিষয়ে দীর্ঘ আলোকপাত করা হোক।
বাহাত্তর এর সংবিধানটির নানা দিক তুলে ধরা হোক। এই প্রজন্ম জানুক, দেখুক-কী স্বপ্ন বুকে নিয়ে তাদের পূর্বসূরিরা মহান মুক্তিসংগ্রাম করেছিলেন।
----------------------------------------------------------------------
দৈনিক উত্তরপূর্ব । সিলেট । ২২ নভেম্বর ২০০৯ রোববার প্রকাশিত
ছবি- কেলি ডিগিনস
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।