১৯৭১ সালে বা তারও কিছু আগে বাঙালীর সংস্কৃতি বিশ্বের যে কোন উন্নত দেশের সংস্কৃতির সাথে প্রতিযোগিতা করত । ৬০ বা ৭০ এর দশকে এ বঙ্গীয় সংস্কৃতি দেশের পার্শ্ববর্তী ভারতসহ বিশ্বের বাঘা বাঘা দেশের সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে জোড় দাপটে এগিয়ে চলছিল । তখনকার জহির রায়হান, সত্যজিৎ রায়ের অবদান আজও চির ভাস্মর হয়ে আছে । সময় পাল্টাতে শুরু করল ৮০ দশকের মাঝামাঝি । বানের জলের মত পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ এবং তার অন্ধ অনুকরণ আমাদের সংস্কৃতিকে ভস্ম করে দিল ।
বিশ্বের যে সকল দেশগুলো আমাদের সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে তাদের সংস্কৃতিকে সাজাতে চেষ্টা করত সেই তাদের সংস্কৃতিকে উল্টো আমরা বাছ-বিচার না করেই অনুকরণ করতে লাগলাম । এরপর ধীরে ধীরে আমাদের সংস্কৃতিতে বন্যার পানির মত প্রবেশ করতে লাগল অশ্লীলতা । বাংলাদেশের ফিল্ম প্রোডাকশন থেকে সামাজিক ভাবধারার ছবি নির্মান বন্ধ হয়ে গেলে । যা দু’একজন পরিচালক দু’একটি সামাজিক, রুচিসম্মত ছবি নির্মান করতে সাহস করত তারাও ব্যবসায়ীকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ত । সে কারনে পারিবারিক গল্পের সামাজিক ছবি নির্মাও বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারনে বন্ধ হয়ে গেল ।
যৌবনের সুড়সুড়ি কয়েকদিন ভালো লাগলেও ধীরে ধীরে এমন অবস্থা হল যে, ধীরে ধীরে অরুচিপূর্ণ মানুষও এমন আবেদনময়ী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দৃষ্টি সড়াতে শুরু করল । কিছু নতুন প্রযোজক ভাল গল্প নিয়ে ছবি নির্মান করতে চাইলেও বিকৃত মস্তিষ্ক এবং সেন্সর বোর্ডের দৌরত্ব তাদেরকে সেপথে ঠিকমত এগুতে দিচ্ছে না । তবে আশার কথা সকল প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে বাংলাদেশের সংস্কৃতি আবারো তার হারানো পথে ফিরে আসতে শুরু করেছে । নতুন সাংস্কৃতিক কর্মীরা এমন সংস্কৃতি সাপ্লাই দিতে শুরু করেছে যার কারনে আবারও দর্শকদের পেক্ষাগৃহে টানতে শুরু করেছে । পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে আবারও ছবি দেখারমত আবহ সৃষ্টি হয়েছে ।
যে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের নাগ-পাশে চলত সে সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতি থেকে কয়েক ক্রোন এগিয়ে গেছে । এ এগুনোটা গল্পের শিক্ষার দিক থেকে নয় বরং আমরা অশ্লীলতায় নিম +
জ্জিত হয়েছি তাদের সংস্কৃতি এখনো পারিবারিক পরিমন্ডলে রয়ে গেছে । পোশাকের পরিবর্তনই কেবল সভ্য সংস্কৃতির মাপকাঠী নয় । সভ্যতার ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহারও যথেষ্ট ভূমিকা রাখে । সে ক্ষেত্রে পশ্চিম বঙ্গের সংস্কৃতি মৌখিক অশ্লীলতা থেকে আমাদের সংস্কৃতিকেও ছাপিয়ে গেছে ।
বিশেষ করে ভারতের হিন্দি ও তামিল ফিল্মের অবস্থা আরো করুন । ভারতের সংস্কৃতি থেকে হিন্দি, তামিল, মারাঠী কিংবা কলকাতার খাঁটি বাংলা ভাষার মুভিগুলো আমাদের জীবন যাত্রাকে তেমনভাবে প্রভাবিত করতে পারে নি । ভারতের সকল সংস্কৃতিকে ঢালাওভাবে অশ্লীল ও অরুচিকর বলা যাবে না তবে স্টার জলসাসহ স্টার গ্রুপের কয়েকটি চ্যানেলের ধারাবাহিক নাটকগুলো সত্যিকারার্থের অরুচিকর এবং সময়ক্ষয়ী ।
কথিত আছে, জার্মানের হিটলার তার বাহিনী নিয়ে একবার একটি দেশ জয় করতে রওয়ানা দিয়েছিলেন । পথিমধ্যে কিছু যুবককে ক্রিকেট খেলারত অবস্থায় দেখে গিয়েছিলেন ।
হিটলার তার বাহিনী নিয়ে কয়েকটি দেশ জয় করে ফেরার পথে সেই যুবকগুলোকে পূর্বের অবস্থায় খেলারত দেখে জিজ্ঞাসা করল ওরা এখানে কি করছে ? একজন উত্তর করল স্যার ওরা, টেষ্ট ক্রিকেট খেলছে । হিটলার এমনিতেই প্রচন্ড বদরাগী ছিল । সৈনিকের এ কথা শুনে তার রাগ আরও বেড়ে গেল । তিনি বললেন, আমি দেশ জয় করে এলাম আর এরা এখনও খেলা শেষ করতে পারল না । হিটলার তাদের সবাইকে হত্যা করল এবং জার্মানীতে ক্রিকেট লেখা নিষিদ্ধ করল ।
হিটলারের দর্শন ছিল ক্ষনিকেই যে কাজের ফলাফল পাওয়া যায় তার উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে । সে থেকেই জার্মানীতে ফুটবল খেলার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হল । জার্মানীরা আজও হিটলারের সে নীতির উপর অটল আছে । বাংলাদেশে তেমন কোন হিটলার আজও জন্মগ্রহন করে নি অথচ একজন হিটলার চরিত্রের মানুষ খুবই প্রয়োজন ।
স্টার জলসায় ২৪ ঘন্টা ব্যাপী সিরিয়াল নাটক চলতে থাকে ।
একটা শেষ হয়, আরেকটা শুরু হয় । এরপর থেকে চলে পুনঃপ্রচার । এসকল সিরিয়াল গুলো ভারতীয় মানুষের জন্য যুঁতসই কেননা তাদের নিজস্ব পারিবারিক ব্যবস্থা, সামাজিক ব্যবস্থা বলতে কোন আলাদা কাঠামো নেই । মানবতাবোধ যেন ভারতের ২৮টি অঙ্গরাজ্যের কোথাও বাস করে না । এসকল সিরিয়াল গুলোর শিক্ষা নিয়েই চলন্ত বাসে নারীকে ধর্ষণ করা হয়, বিদেশী পঞ্চাশোর্ধ পর্যটক এসেও তাদের লোলুপতার শিকার হয় ।
বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে নারীদের মধ্যে এসকল অপসংস্কৃতির শিক্ষা বেশ ভালো ভাবেই কাজ দিতে শুরু করেছে । পূর্বের তুলনায় ডিভোর্সের, তালাকের প্রভাব অনেকগুনে বেড়ে চলেছে । যার কারনে বৈবাহিক সম্পর্ক হুমকির দ্বারপ্রান্তে । পরকীয়া এমনভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে যেন পরকীয়ার মধ্যেই পৃথিবীর সকল সূখ পুঞ্জীবুত । মিথ্যা শেখানোর চলছে প্রতিযোগিতা ।
সত্যের উপর মিথ্যাকে রাজত্ব করানো মত যোগ্যতা যে কোন মূল্যে অর্জন করাতেই হবে । সম্মানীত মায়েরা-বোনেরা এমনভাবে কূটবুদ্ধি শিখছে যার কারনে পারিবারিক শান্তি পালানোর পথ খুজছে যেন পালাতে ব্যাকুল । স্টার জলসার যে সকল সিরিয়াল গুলোর প্রতি মানুষ এমনকি শিশুরা আকৃষ্ট সে সকল সিরিয়াল গুলো সন্ধ্যার পর থেকে ৯.৩০ পর্যন্ত প্রচার করা হয় অথচ শিক্ষার্থীদের পাঠের মূল সময় হিসেবে সন্ধ্যার পরের সময়টুকুই স্বীকৃত । যার কারনে শিক্ষার্থীরা যেমন প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে ছিটকে পড়ছে তেমনি শিক্ষার মানেরও অবনতি হচ্ছে । এভাবে চলতে থাকলে প্রাচীন যুগ কিংবা চার্বাকদের ধুর্ত যুগে ফিরে যেতে বেশি দিন লাগবে না ।
সকল সংস্কৃতি ঢালাওভাবে অপসংস্কৃত নয় । ভাল সংস্কৃতিতে অবশ্যই জীবনের শিক্ষা আছে । বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শ্রুতিমধুর শব্দ বিশ্বায়ন বা বিশ্বের সকল মানুষ একই ছাদের নিচের বাসিন্দা । এ সূত্রমতে একদেশের সংস্কৃতি তার নিজস্ব গন্ডি পেরিয়ে অন্য দেশে প্রবেশ করবে এটাই হওয়া উচিত ছিল । বন্ধু প্রতীম ভারতের সাথে তেমনটা হয় নি ।
বাংলাদেশীরা উদারপন্থী হিসেবে ভারতের সকল সংস্কৃতিকেই নিজেদের মধ্যে টেনে এনেছে । ভারত সেরকম কিছুই করেনি । অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, যেখানে ভারতের ডজন ডজন স্যাটেলাইট চ্যানেল বাংলাদেশে প্রচার করা হয় সেখানে বাংলাদেশের একটি চ্যানেলও ভারতে দেখানো হয় না । এমনকি বাংলাদেশের মানুষের গর্ব দেশের সর্বোচ্চ সম্মানের প্রতীক জাতীয় পতাকাকে ভারতের একটি টিভি চ্যানেল তাদের ডায়াসের পদতলের পাপস করেছিল । যে অপসংস্কৃতি বিক্রি করে ভারতের সাংস্কৃতিক ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে সেই ভারতের কাছ থেকে আমাদের সংস্কৃতি বিক্রি করে একটি কানা কাড়িও পাচ্ছি না ।
এমনকি ২০১৩ সালে ভারতের বিভিন্ন চ্যানেলকে মোট ১১কোটি টাকা দিতে হয়েছিল ।
বন্ধুর ছদ্মবেশে থাকা ভারত আমাদের সাথে বন্ধুত্ব সূলভ আচরণ করে নি, নিকট ভবিষ্যতেও যে করবে সেরকম কোন আশা আপাতত নাই । সুতরাং ভারত যদি সংস্কৃতির নামে আমাদেরকে উত্তম কিছু দিত সেটা আমরা নির্দিধায় গ্রহন করতাম । তখন তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক হত ক্রেতা-বিক্রেতার । কিন্তু তাদের সংস্কৃতি আমাদের আবহাওয়া, প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে মোটেও মাননাসই নয় ।
সুতরাং টাকা দিয়ে এমন কিছু খরিদ করা উচিত নয় যেগুলো মানুষ এবং মানবতার জন্য ক্ষতিকর । কাজেই টাকা দিয়ে তো নয়ই ভারত যদি তাদের সংস্কৃতিকে বিনে পয়সায় দেয় তবুও সেটা গ্রহন করা উচিত হবে না । সর্বোপরি ভারতে সংস্কৃতি ত্যাগ করতে পারলে আমাদের হারানো পারিবারিক সম্পর্ক শ্রদ্ধাবোধ পূনরায় ফিরে পাব ।
রাজু আহমেদ । কলাম লেখক ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।