বিশ্বসাহিত্য ও শিল্পে ‘আধুনিকতা‘ এবং ‘রোম্যান্টিসিজম‘র সূচনা লগ্ন প্রথাগত পাঠকদের মেজাজে নানান প্রশ্নের জন্ম দেয়। সে সময় প্রথাগত সাহিত্যের দেয়াল ভেঙ্গে যুক্ত হয় নতুন চিন্তা-দর্শন। যা পাঠকদের বোধগম্যতায় মতদ্বৈততার সৃষ্টি করে। আধুনিক সাহিত্যে যে দূরূহতার সূচনা হয় তা পাঠককে ভাগ করে ফেলে দুই ভাগে। তবে বেশিরভাগ প্রথাগত পাঠক তাদের বোধগম্যতার আসন ছেড়ে আধুনিকতায় প্রবেশ করতে চায় নি।
কারণ আধুনিক সাহিত্যের চরিত্র তাদের বোধ-চিন্তা এবং অনূভ’তির সাথে পরিচিত নয়। সে সময় প্রথম আধুনিকতার দূরূহতার ব্যাখা বিষয়ে লেখালেখি করেন স্পেনিস দার্শনিক জুসে আর্তেগা ই গাসেত( ৯ মে ১৮৮৩-১৮ আক্টোবর ১৯৫৫)। তাঁর লেখায় প্রথম আধুনিকতার চরিত্র ধরা দেয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে ‘রোম্যান্টিসিজম‘ এর সূচনা লগ্নের কথা। এ নিয়েও গোলযোগের কমতি ছিলো না।
তবে সব বাঁধা কাটিয়ে মানুষের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘রোম্যান্টিসিজম‘। জর্মন কবি ফ্রিডরিচ স্ক্যাগেল(১০ মার্চ ১৭৭২-১২ জানুয়ারী ১৮২৯) প্রথম সাহিত্যে ‘রোম্যান্টিসিজম‘ ব্যবহারের একটি গ্রহনযোগ্য ব্যাখা দেন। বলেন- “Literature Depicting emotional matter in an imaginative form” আমি মনে করি এই একটি লাইন ‘রোম্যান্টিসিজম‘ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখা না দিলেও অল্প কথায় বহুকথা বলেছে। আর এই সময়ের দ্যুতনায় আমরা পেয়ে যাই ইংরেজ রোম্যান্টিক কবি উইলয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, বায়রন, শেলী, কিটসের মত কবি। আমেরিকান কবি রাফ ওয়ালডো ইমারসন, নাথালিয়েন হওথর্ণ, এডগার এলেন পো, হেনরি ডেভিড থরিও, হারমেন মেনভিলি এবং ওয়াল্ট হোইটম্যান-কে।
‘আধুনিকতা‘ এবং ‘রোম্যান্টিসিজম‘ এ দু‘টি অধ্যায় ১৮ শতক থেকে যে বিপ্লব সুচনা করেছিলো তা সমৃদ্ধ করেছে বিশ্বসাহিত্য ভান্ডার। যার সরাসির প্রভাব পড়ে বাংলা সাহিত্যে। বাংলা গল্প, উপন্যাস এবং কবিতায় ‘আধুনিকতা‘ এবং ‘রোম্যান্টিসিজম‘ যোগ করে একটি গতিশীল নান্দনিক চাকা। যাতে ভ্রমণ করে তৃপ্ত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের পাঠক। ত্রিশের পাঁচ আধুনিক কবি এরই প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে কবিতার পালে যে হাওয়া লাগিয়েছিলেন তাতে আমরাও ভেসে চলেছি।
আমি কবিতায় ‘সময়‘ এবং ‘পরিবেশ-প্রতিবেশ‘কে সব সময় প্রধান্য দিয়েছি। আমি লেখালেখির শুরু থেকেই কবিতা রচনা করে কখনো তৃপ্ত হতে পারি নি। তারপরও বারবার কবিতার সাথে আত্মীয়তা করার চেষ্টা করেছি। পঠন-পাঠন এবং কবিতার দর্শন ও রসায়ন বুঝার চেষ্টা করেছি নিরন্তর। ‘আধুনিকতা‘ এবং ‘রোম্যান্টিসিজম‘ এর যাত্রাপথে নিজেকে স্থাপন করার চেষ্টা করেছি।
বারবার অতীতের পাঠ নিয়েছি। দ্বিধাজর্জর ছিলাম কবিতার ব্যাকরণ নিয়ে। কোন অবয়ব দেবো কবিতাকে? অবয়বের ভেতরে যে প্রান দেবো তার কি রূপ হবে? কখনো কখনো এজরা পাউন্ডের কথা মনে হতো। তিনি বলেছিলেন, উচ্চ মার্গীয় কবিতা কে হতে হবে উচ্চ মার্গীয় গদ্যের মতই সুলিখিত। এতো দেয়ালের মাঝে কিভাবে কবিতাবিশ্বকে সাজাবো তা নিয়ে বহুকাল অতিক্রম করেছি।
এক সময় কবিতা ধরা দিলো! আমি চমতকৃত হয়েছি। আমি অভিভ’ত হয়েছি এই ভেবে যে, কবিতা আমার চিন্তা-দর্শনকে যথাযথ প্রকাশের সুযোগ করে দিচ্ছে। কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকের মন্তব্য আমাকে কখনো অস্থির করেছে আর কখনো স্থির করেছে। এক সময় আবিস্কার করলাম আমার কবিতার নেশাগ্রস্ত পাঠকও আছেন। আছেন বোদ্ধা পাঠক ও সমালোচক।
যাঁদের সমালোচনা আমাকে সিদ্ধ করেছে।
তবে আমি বরাবরই জনপ্রিয়তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছি। মার্গীয় সাহিত্য কখেনো জনপ্রিয় হয় না। তার পাঠক প্রিয়তা পেতেও সময় লাগে। ‘জনপ্রিয়‘ নিতান্ত একটি বাজারী শব্দ।
তাই কতিপয় সমালোচকের অতিকথনে আমি কখনো বিশ্বাস স্থাপন করিনি। নিজের ভাবনায় কেবল দেখার চেষ্টা করেছি প্রতিবেশকে। অনূভব করার চেষ্টা করেছি কবিতা শিল্পের ¯্রােতধারায় বহমান আত্মার নি:শ্বাস। প্রাকৃতিক উপকরণ ও উপসর্গের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খুলে দেখার চেষ্টা করেছি এবং তার ভেতরে নিজেকে নিমজ্জমান রাখতে পছন্দ করেছি কেবল। এতে করে যে ধ্যান তৈরী হয়েছে তাকে কবিতার সূত্র বলে মেনেছি।
যে সূত্রের নির্দিষ্ট কোন গন্ডি নেই। যাকে কোন মতেই নির্দিষ্ঠ ছকে বাঁধা যায় না। কেউ আমার কাছ থেকে এই সূত্রের সংজ্ঞা জানতে চাইলে আমি বিব্রত বোধ করি। কারণ যখনি এর কোন ব্যাখা দাঁড় করাতে যাই দেখেছি নদীর পানি অন্যদিকেও প্রবাহিত হচ্ছে। একে কোন রকেমেই একমুখি করার সুযোগ নেই।
এইভাবে অবাধ্য সূত্রের ভেতর জেগে উঠেছে আমার এক একটি কবিতা। আমার বেশিরভাগ কবিতায় উঠে এসেছে ‘সময়‘। এই সময়ের ভেতরে নারী, প্রেম,প্রকৃতি, অন্তদ্বন্ধ জেগে উঠেছে বারবার। কোথাও কোথাও ফ্রয়েডীয় চিন্তার প্রকাশ দৃশ্যমান। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘চূর্ণকাল‘প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে।
গ্রন্থের ফ্ল্যাবে লেখা আছে ‘প্রায় সব ক‘টি কবিতার শরীরে ক্ষতচিহ্ন। ¯স্নিগ্ধ আলোকরশ্নি থেকে যা প্রকাশ হয়েছে তাতেও মায়া বিস্তারি বিষ কিংবা রঙের ছাপ। আকাঙ্খার সব কিছুই থাকে অধরা। ‘ ২০০৭ সালে আমি মাটি ছেড়ে লন্ডেনে আসি। ফলে প্রবাসে মাটি ছেড়ে আসার বেদনা বারবার আমাকে আহত করেছে।
এই নি:সঙ্গ সময়ে কখনো কখনো দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্য নারী আমাকে মাদকতৃপ্তি দিয়েছে। যার প্রকাশ রয়েছে আমার ‘চূর্ণকাল‘ এর প্রায় সব ক‘টি কবিতায়। এ গ্রন্থের অনেকগুলো কবিতা আমার প্রিয়। যেমন একটি কবিতার কিছু অংশ উদৃত করা যেতে পারে।
‘তুমি কি বুঝোনা পিরানী
জেগে থাকি তোমার সহবতে
পঙ্কালয়ে পাতো হাত
পাবে দীর্ঘশ্বাস মথুরা বৈরাগী
বাউলীয়া মায়া রেখো...
বাউলীয়া ছায়া রেখো
ধূপানলে আমায় রেখো
তোমার বাজুবন্ধে রেখো
রেখো পাঁজর-ভাজে(তীর্থক/চূর্ণকাল)।
এই কবিতায় একটি অন্তর্গত অবিশ্বাস দূর্লক্ষ্য নয়। যে নারীর কাছে আমি ‘মায়া‘ চেয়েছি, সেই তাকেই আবার বলেছি আমাকে ‘ধূপানলে‘ নিক্ষেপ করতে। এই যে আত্মহনণের প্ররোচনা একে আমার মনে হয়েছে ‘রোম্যান্টিসিজম‘র নান্দনিক প্রকাশ। কিংবা যদি বলি-
‘চান্নিপ্রহর রাইতে ঝুলি বরফের লাশ
ওড়ে তুষারের লোবান কাফন
যদ্দিন নির্লক্ষ্য ছায়াবাজি খেলিলাম
বাঁচি নাই গূঢ় সত্য মাতোয়ালী জানে(যাত্রী/চূর্ণকাল)।
আমার দীর্ঘ কবিতা খুব কম।
আমার কবিতাকে যে শারীরিক অবকাঠামো আমি দিই তা স্বায়ত্বশাসিত। আধুনিক শিল্পকলার বলেই তা স্বাধীন। এইযে অবকাঠামো এর ভেতরে আমি সব সময় পুরো একটি দৃশ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। আমার কোন কোন পাঠক মাঝে মাঝে মন্তব্য করে থাকেন‘কবিতাটি দূরূহ‘ বলে। সেই পাঠক কিংবা সমালোচকদের বুঝতে হবে ঊনিশ শতকের শিল্পচিন্তার সাথে আধুনিক এবং রোমান্টিক চিন্তার এক করা চলবে না।
আধুনিক মানেই দূরূহতার প্রকাশ। আধুনিক কবির কাজই হচ্ছে অদৃশ্যকে উপস্থাপন করা। ‘চূর্ণকাল‘ কাব্যগ্রন্থে আমার আরো বেশ কয়েকটি প্রিয় কবিতা রয়েছে যেমন, ত্রিশ্বরী, চক্র, নোঙর, রুদ্রাক্ষ, নূরজাহান, মহুয়াকথা এবং উত্তরচাঁদসহ আরো কয়েকটি কবিতা।
২০১২ সালে প্রকাশিত হয় আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নিষঙ্গ‘। এই গ্রন্থভ’ক্ত কবিতাগুলো রচনার সময় আমি লন্ডনে আমার শিকড়-বাকড় গজিয়ে যায়।
ফলে ‘চূর্ণকাল‘ এ আমি সমর্পিত ছিলাম কিন্তু ‘নিষঙ্গ‘তে এসে দেখা যায় আমি সেই নারী কিংবা প্রকৃতির জন্য করুণা প্রকাশ করছি। যেমন-
ভেঙে ফেলছি আকাশের ভাসমান কেশর
ওই উড়ন্ত ভেলায় ছিলো যোনিযৌবনের মৃতহাঁস
তোমার ফেলে যাওয়া সাদা আফিমের ঘ্রাণে(তেজস/নিষঙ্গ)।
লন্ডনে রচিত আমার দূটি কাব্যগ্রন্থ পাঠ করলে পাঠকমাত্রই আবিস্কার করতে পারবেন সময়ের ভিন্নতা এবং অবস্থান। ‘চূর্ণকাল‘ এবং ‘নিষঙ্গ‘ এই দু‘টি কাব্যগ্রন্থে আমার বেশ কয়েকটি প্রিয় কবিতা রয়েছে। আমি নিজেও পাঠ করে একবার হেঁটে আসি ফেলে আসার সময়ের ভেতর দিয়ে।
টের পাই সময়ের পদছাপ কিভাবে বদলেছে এবং কিভাবে বদলে দিয়েছে আমার কাব্যচিন্তা। যেমন ‘নিষঙ্গ‘ থেকে আরো দু‘টি কবিতার ক‘টি পঙক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে।
আবার সওয়ার হই মিসিসিপি জল থেকে
উড়–ক্কু মায়াবী ডোবায়
এনে হচ্ছে উলঙ্গ ফিকিরবাজ আকাশ
আমার ছায়া হয়ে যাচ্ছে
ঠিক তোমার মত(নিসঙ্গ/নিষঙ্গ)।
কিংবা
আজ হিমাগারে রেখে এলাম নিজের লাশ
প্রতিদিন মরে যেতে যেতে
আর ইচ্ছে করে না মাটি খুঁড়তে
.....................................
আমি তো লাশ হয়ে গেছি
প্রতিদিন তোমার মরে যাওয়া দেখতে দেখতে(হিমাঙ্ক/নিষঙ্গ)।
‘নিষঙ্গ‘ কাব্যগ্রন্থের আরো বেশ ক‘টি কবিতা আমার প্রিয়।
প্রবাসে এসে আমার কবিতায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে বলে আমি মনে করি। তৈরী হয়েছে নতুন চিন্তা-দর্শন ও ভাষাভঙ্গি। গ্যেটে‘র ভাষায় যদি বলি তাহলে বলবো নতুনভাবে বিকশিত হয়েছে প্রত্যঙ্গ। এর প্রকাশ আমার কবিতার পাঠক মাত্রই বুঝতে পারেন বলে মনে করি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।