আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হঠাৎ বৃষ্টি - দি মুনছুন রেইন

- ও ডাক্তার সাব, পুলার তো উঠলে আর নামেনা।
আমি মনে মনে মকবুলকে দুইটা গালি দিয়ে বিরক্ত মুখে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। আমি নিশ্চিত মকবুল হারামজাদা ফাজলামো করে এই পেশেন্ট আমার কাছে গছিয়েছে। মকবুল চর্ম যৌন, বদরুল নিউরো, সাদেক হার্ট, নাজমুল হাড় আর আমি মেন্টাল। প্রায় প্রতি শুক্রবারেই আমরা আড্ডায় বসি।

গত সপ্তাহের আড্ডার সময় এই পেশেন্ট গছিয়েছে মকবুল। বলে, খানদানি জমিদার ফ্যামিলি। গাজীপুরে বিশাল জায়গা নিয়ে বাংলো বাড়ি। কেসও খুব ইন্টারেস্টিং। ছেলের বাপ তোকে গাড়ি করে এসে নিয়ে যাবে।

সারাদিন থাকলি, ঘুরলি, সাথে রোগীও দেখলি। মকবুলকে কয়েকবার চাপাচাপির পরেও পেশেন্টের সমস্যা কি খুলে বলে না। আমি আসার আগে ছেলের বাপকে ফোনে জিজ্ঞেস করেছিলাম সমস্যা কি। ছেলের বাপও কিছু বলে না। শুধু বলে ডাক্তার সাব আপনি গরীবের বাসায় আগে একটু আসেন।

চাইরটা ডাইল ভাত খান। পরে সব খুলে বলবো।

বারো পদের ভূরিভোজন শেষ করে এখন মন্টুর বাপের প্রথম কথা শুনেই মনে হচ্ছে এটা ক্লিয়ার চর্ম যৌন কেস। আমি এখানে কি করবো? কিন্তু আস্তে আস্তে সব খুলে বলায় বিষয়টা একটু পরিষ্কার হয়।
মন্টুর বাপ বলে যায়,
- এই হইলো গিয়ে সমস্যা।

পুলার দেশপ্রেম মনে করেন একটু বেশী। সমস্যা হইলো দেশপ্রেম একবার উঠলে আর নামতে চায়না। আর দেশপ্রেম বেশী বলেই ইন্ডিয়ার উপর রাগটাও একটু বেশী।

মন্টুর মা এসে এক ফাঁকে চা বিস্কুট দিয়ে যায়। খাওয়ার পরিমাণটা একটু বেশীই হয়ে গেছে।

তারপরেও তিনি আবার পীড়াপীড়ি করেন,
- খান ডাক্তার সাব, বিস্কুট খান। বিদেশী বিস্কুট।
আমি মুচমুচে ব্রিটানিয়া বিস্কুটে দুইটা কামড় দিয়ে চায়ের কাপ হাতে নেই।
মন্টুর বাপ বলে যায়
- পুলা মনে করেন ইন্ডিয়ার নাম শুনলেই খাড়ায়া যায়। প্রথমে আমরা অত পাত্তা দিতাম না।

ভাবতাম দেশের প্রতি একটু মায়া মহব্বত বেশী তো, তাই ইন্ডিয়ারে এক্কেবারে দেখতেই পারেনা। কিন্তু দিনকে দিন মনে করেন অবস্থা বেশী খারাপের দিকে যাইতেছে। আগে দেশপ্রেম খাড়াইলে মনে করেন দশ মিনিটের মধ্যে আবার নাইমাও যাইত। কিন্তু এখন মাঝেমাঝে মনে করেন চার পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেও নামে না।
- হুম, ডাক্তার খবর দিয়ে ভালোই করছেন তাহলে।

শাস্ত্রে বলেছে, ইফ ইয়োর দেশপ্রেম লাস্ট ফর লঙ্গার দ্যান ফোর আওয়ারস প্লিজ কনসাল্ট এ ডক্টর।
- কি বলেন ডাক্তার সাব
কিছু না, কিছু না বলে আমি চায়ে গম্ভীর মুখে চায়ে চুমুক দেই।
- খান ডাক্তার সাব খান। বিদেশী চা, দার্জিলিং এর পাতা।

মন্টুর বাপ বলে যায়,
- গত সপ্তাহে পুলারে ধরে আনলাম ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে।

এ আর রহমান মাত্র ষ্টেজে উঠে দাম দারা দাম দারা মাস্ত মাস্ত বলে টান দিছে আর সাথে সাথে আমার পুলার দেশপ্রেম দাঁড়ায়ে গেল। বাঁশ নিয়ে এ আর রহমানরে এমন ধাওয়া দিল যে তিনি মওলা মেরে মওলা মেরে বলতে বলতে দৌড়ায়ে স্টেডিয়াম থেকে ভাগলেন। ভারতীয় গায়কদের কোনভাবেই দেশের মাটিতে গান গাইতে দিবে না আমার পুলা। থানা পুলিশ হয়া একাকার কাণ্ড।
আমার চা বিস্কুট শেষ হতে না হতেই মন্টুর বাপ চানাচুর এগিয়ে দেয়,
- খান ডাক্তার সাব, চানাচুর খান।

অরিজিনাল বোম্বে চানাচুর।
মন্টুর বাপ আবার মন্টুর কথা শুরু করে,
- আগের মাসে পুলারে ধরে আনছি সাতক্ষীরা থেকে। কই থেকে জানি খবর পাইছে সাতক্ষীরা বর্ডার দিয়া ইন্ডিয়ান আর্মি ঢুইকা পটাপট নাকি মানুষ মারতেছে। আর শুনে পুলার দেশপ্রেম গেল মনে করেন খাড়ায়ে। বাঁশের লাঠি হাতে নিয়া সেইদিনই চইলা গেল বর্ডার পাহারা দিতে।

বহুত ঝামেলা হইছে পুলারে সাতক্ষীরা থেকে ফিরায়ে আনতে। ওইবার মনে করেন এমন খাড়ান খাড়াইছিল যে আর নামেই না। এইরকম প্রতি মাসেই এইটা সেইটা লাইগাই আছে। কোন মাসে বাঁশ নিয়া যশোর বর্ডারে দৌড় দেয় তো কোন মাসে যায়গা তেতুলিয়া। পুলারে নানা যায়গা থাইকা উদ্ধার কইরা আনতে আনতে মনে করেন আমার দিন যায়, রাত যায়।

- আচ্ছা, ডাকেন আপনার ছেলেকে ডাকেন। দেখি কি অবস্থা।
আমি চানাচুর শেষ করে বলি।

মন্টুর বাপ মন্টুকে ডাকতে যায়। আমি রিমোট হাতে নিয়ে চ্যানেল ঘুরাই।

স্টারপ্লাস, সনি, জীবন মানে জি বাংলা পার হয়ে এসে খেলার চ্যানেলে এসে থিতু হই। বাংলাদেশ ব্যাট করে, কি যেন একটা প্রস্তুতি ম্যাচ চলছে। হার্টে ভাল্ভ লাগানোর পর সাদেক আমাকে নিষেধ করে দিয়েছিল বাংলাদেশের খেলা দেখতে। তবুও মাঝেমাঝে লোভ সামলাতে পারিনা। মন্টু ঘরে ঢুকেই টিভির দিকে তাকিয়ে একটা গগনবিদারী আর্ত চিৎকার দেয়।

চিৎকার করে শুধু সাহারা সাহারা বলতে বলতে একসময় মুখে ফ্যানা উঠে আধা অজ্ঞান হয়ে যায় প্রায়। মন্টুর বাপ দৌড়ে এসে আমার হাত থেকে রিমোট কেড়ে নিয়ে চ্যানেল বদল করে। মন্টুর বাপ নিচু স্বরে বলে,
- বাংলাদেশ দলের জার্সিতে সাহারা লেখা দেইখা পুলা খাড়ায়ে গেছে। ইন্ডিয়ান কোম্পানি তো, পুলা সহ্যই করতে পারেনা।

মন্টুর বাপ চ্যানেল বদলাতে বদলাতে স্টারপ্লাসে এসে থিতু হয়।

স্টারপ্লাসে তুলসীর চেহারা দেখা যায়। মন্টু আস্তে আস্তে একটু শান্ত হয়।
আমি মন দিয়ে মন্টুকে খেয়াল করি। চৌদ্দ পনের বয়েসই একটা ছেলে। বেশ জেদি জেদি একটা চেহারা।

পরনে কাজকরা বেশ দামি একটা পাঞ্জাবী, বিদেশী হয়তো!

ছেলের বাপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
- পুলার আর দোষ কি দিব বলেন। ইন্ডিয়া দেশটারে একেবারে গিলে খাইল মনে করেন। পাবলিকে খালি ৭১ সালে পাক মিলিটারি কয়টা মানুষ মারছে সেগুলা দেখে। গত চল্লিশ বছর ধরে ইন্ডিয়া যে তার দশগুণ মানুষ হাতে মারল আর ভাতে মারল সেইটা চোখে দেখে না।

মন্টু চিকিৎসার ঊর্ধ্বে জেনেও আমি মন্টুর নানারকম পরীক্ষা করি।

বুকে স্টেথোস্কোপ বসানো থেকে শুরু করে জেনার টেস্ট পর্যন্ত হাবিজাবি যা মনে আসে টেস্ট করে আমার সারাদিনের খাওয়াদাওয়া আর মোটা ফি উসুল করার চেষ্টা করি। মন্টুর বাপ খুশী হয়। সন্ধ্যা নামতেই মন্টুর বাপ রাতে খেয়ে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। আমি ভদ্রতা বজায় রাখতে একটু না না করি। মন্টুর বাপ লোভ দেখায়,
- কুরবানির গুস রান্না হইছে ডাক্তার সাব।

একটু হলেও মুখে দিয়া যান। পুরা দেড় লাখ টাকায় কেনা গরু। এই এলাকায় আমার জানামতে এর চেয়ে বড় গরু এইবার কেউ কুরবানি দেয় নাই সেইরকমের তাগড়া গরু ছিল কিন্তু মাংস মনে করেন একেবারে মাখনের মতো মোলায়েম।
- ইন্ডিয়ান গরু?
- নাইলে আর কি? দেশী গরুর গায়ে গুস আছে নাকি, খালি হাড্ডি আর হাড্ডি।

আমি, মন্টু, মন্টুর বাপ সবাই মিলে কুরবানি গুস দিয়ে ডিনার করি।

মন্টুকে বেশ স্বাভাবিক মনে হয়। সম্ভবত আজকের দেশপ্রেম যা উঠার উঠে আবার নেমে গেছে। আমি গুস খেতে খেতে মন্টু আর মন্টুর বাপের সাথে গল্প করি। মন্টুর বাপ জানতে চায় আমি এর আগে মন্টুর মতো কোন কেস দেখেছি কিনা।
- পাগলের ডাক্তার তো আমি তাই অনেক আজব আজব সাইকোলজিক্যাল কেস নিয়ে ডিল করতে হয়।

আচ্ছা একটা কেস শুনাই তাহলে। এক লোক হোমোফবিক।
- কি ফবিক?
- মানে কিনা, আচ্ছা ঠিক হোমোফবিকও না আসলে। কি বলা যায় আমি নিজেও জানিনা। ঘটনা হচ্ছে ভদ্রলোকের রাতে ঘুম হয়না।

তার ধারণা সে ঘুমালেই কেউ না কেউ এসে তার ইয়ে মেরে দিবে?
- কি মারবে? মানিব্যাগ?
- আরে নাহ, ইয়ে মানে পুটু
- কি!
- ধুর, গল্প শেষ করতে দেন আগে। তো সে বাসায় লোহার গেট লাগায়। ঘরের দরজা লাগায়। জানালা লাগায়। তার ওয়ারড্রব ঠেলে দরজার সামনে এনে ব্যারিকেড দেয়।

এমনকি মশারিও টানায়!
- হ্যাঁ হ্যাঁ বলা যায়না, আজকালকার মশারাও বড় খাচ্চর।
- তো এত কিছু করেও তার শান্তি হয়না। ঘুম আসেনা রাতে। তো আমি প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে তাকে কিছু ঘুমের ওষুধ দিলাম। অনেকদিন পর তার রাতে ঘুম ভালো হল।

কিন্তু পরদিন সকালে আমার চেম্বারে এসে হাউমাউ কান্না। কান্নার চোটে ঠিকমতো বাংলাও বলতে পারেনা। বাংলা হিন্দি মিশিয়ে খালি বিলাপ করে, মার দিয়া, মার দিয়া। আমি বারবার জিজ্ঞেস করি, কি মার দিয়া। অনেকক্ষণ পর ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, পুটু।


- কিন্তু ক্যামনে কি? দরজা জানালা তো সব বন্ধই ছিল।
- রহস্যময় ব্যাপার। এভাবে প্রায় এক মাস চলে গেল। নির্ঘুম রাত কাটে। যেই রাতেই ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে যায় সকালে এসে হাউমাউ কান্না, মার দিয়া মার দিয়া বলে।


- আজিব কাণ্ড!
- আসলেই আজিব কাণ্ড। পরে ঘটনা কি বোঝার জন্য আমি তার ঘরে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগানোর ব্যবস্থা করলাম। পরদিন সকালে গিয়ে সেটার ফুটেজ দেখে সব বিষয় পানির মতো ক্লিয়ার!
- কি? কি বিষয়?
- মানে ঐ যে ক্লাসিক্যাল সাইকো কেস। ডাবল পারসোনালিটি আরকি। ভদ্রলোক নিজের ইয়ে নিজে মারেন।

সকালে উঠে আর মনে থাকেনা। ভাবেন অন্য কেউ মেরে দিয়ে গেছে।
- এটা কি সম্ভব নাকি?
- সম্ভব যে নিজের চোখেই তো দেখলাম।
- তো এর সাথে মন্টুর সমস্যার সম্পর্ক কি?
- সমস্যার সম্পর্ক নাই। এমনি একটা গল্প বললাম আরকি।

আমি প্রসঙ্গ পাল্টে মন্টুকে জিজ্ঞেস করি,
- কি মন্টু মিয়া। কুরবানির গুস খাইতে কেমন?
মন্টু গাল ভরতি মাংস নিয়ে হাসিমুখে জবাব দেয়,
- জবর।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।