আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হাওরে.....


ডিমের কুসুমরাঙ্গা একরাশ পানি সরিয়ে সবে উঁকি মেরেছে। সেই আগুন রাঙ্গা পানিতে অসংখ্য মাছ ধরা নৌকায় সাত সকাল থেকেই জাল টানার ব্যাসততা । সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চোখে সকালের নরম ভিজে আলোয় এ এক অসাধারন রোম্যান্টিক দৃশ্য। টাঙ্গুয়া হাওরের যে মুল্লুকেই যাওয়া হোক না কেন, এমন রোম্যান্টিক সূর্যোদয়ের মুখোমুখি হতে হয় বার বার।
ঈদ এর পর দল বেধে ঘুরতে যাওয়া 'ভ্রমণ বাংলাদেশ' এর ট্রেডিশনে পরিনত হয়েছে।

কিন্তু এবারের ঈদ বর্ষার ঠিক মাঝামাঝি হওয়াতে কোথায় যাওয়া যায় এ নিয়ে একটু দোটানায় পরতে হল। পাহাড় না পানি? শেষ পর্যন্ত পাহাড়ের ডাক উপেক্ষা করে, পানির টানে আমরা ছুটে চলেছি 'টাঙ্গুয়া হাওরে'।
হাওর! নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে চারদিকে বিশাল জলরাশি। কূল নেই, কিনারা নেই। শুধু পানি আর পানি।

বাতাসের তীব্র বেগের তালে তালে হাওর একেক সময় একেক রূপ ধারণ করে। হাওরের পানি কখনো গ্রামের সদ্য বিবাহিতা লাজুক নববধূর মতো শান্ত, আবার কখনো বা চঞ্চল কিশোরীর মতো দুরন্ত।
১৬ তারিখ সকালে সুনামগঞ্জে নাস্তা সেরে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমরা রওনা হলাম তাহিরপুরের উদ্দেশে। বৈঠাভাঙ্গা ঘাট পার হয়ে লেগুনায় চড়ে আমরা যখন তাহিরপুর পৌঁছলাম তখন প্রায় ১২ টা। হাবিব সারওয়ার ভাই আমাদের জন্য নৌকা রেডি করে অপেক্ষা করছেন সেই সকাল থেকে।

দুপুর হয়ে যাওয়াতে আমরা দুপুরের খাবার সেরেই হাওরে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। খাবার শেষ করেই টাঙ্গুয়া হাওরের প্রবেশদ্বার খ্যাত পাটলাই নদী দিয়ে আমরা ঢুকে গেলাম হাওরের মূল অংশে। অপূর্ব সে দৃশ্য। দু'পাশের হিজল করচের পাতা বাতাসে দুলে দুলে যেন আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছে। চারদিকের বিশাল জলরাশি যেন মিশে গেছে দূর নীলিমায়।


টাঙ্গুয়া হাওর মূলত সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার দশটি মৌজা নিয়ে বিস্তৃত। প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই হাওরে ছোট-বড় ১২০ টি বিল আছে। প্রতি বছর এ হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে। ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভয়চর প্রাণী নিয়ে জীব বৈচিত্রে ভরপুর এই টাঙ্গুয়া হাওর।
টাঙ্গুয়া হাওরে ঢোকা মাত্রই চারদিকের দৃশ্যপট কেমন জানি বদলে গেল।

বিশাল জলরাশির বুকে ছোট ছোট মাছ ধরা নৌকা, মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে নিজেদের অস্তিত্ব জানিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। আমরা অপলক দৃষ্টিতে টাঙ্গুয়ার পূর্ণ যৌবন উপভোগ করছি। দলের সবাই যার যার মতো ছবি তুলতে ব্যস্ত। কেউ কেউ আবার আয়েশি ভঙ্গিতে উপভোগ করছে চারদিকের অপার সৌন্দর্য। হাওরের স্বচ্ছ পানি দেখে এতে জলকেলি করার লোভ সামলায় এমন সাধ্য কার? আমরা মাঝিকে অনুরোধ করলাম সুবিধামত একটি জায়গায় নৌকা ভিড়াতে।

বেশ খানিকটা এগিয়ে চমৎকার এক জায়গায় মাঝি নৌকা ভিড়াতেই আমরা নেমে পড়লাম পানিতে। ছোট্ট শিশুর মতো সবাই মিলে পানিতে দাপাদাপি করলাম প্রায় ঘণ্টাখানেক। আমাদের নৌকা আবার ছুটে চলেছে। আমাদের এবারের গন্তব্য টাঙ্গুয়া হাওরের কোলে পাহাড়ের গা ঘেঁসে গড়ে ওঠা ছোট্ট এক জনপদ ট্যাঁকেরঘাট।
বিকেলে সূর্যের সোনালী আলোর প্রতিফলনে টাঙ্গুয়ার পানিতে যেন আগুন ধরে গেছে।

এ যেন এক অবাক দৃশ্য। ট্রলারের শব্দে কয়েকটা সাদা বক পাশের একটি হিজল গাছ থেকে উড়ে দূরের একটি করচ গাছে গিয়ে বসল। আমাদের ঠিক সোজাসুজি নীল আকাশের সাথে পাহাড় যেন মিতালি পেতেছে। দিগন্তের নীল আকাশ আর স্বচ্ছ পানি যেন মিলেমিশে একাকার। এদিকে রুমা আপু, ইতি আপু, তুহিন ভাই, সুমন ভাই ঝালমুড়ি বানাতে ব্যস্ত।

ঝালমুড়ি খেতে খেতে টাঙ্গুয়ার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ভাবুক হয়ে গেলাম। এই সৌন্দর্য শুধু দেখলে হয় না, অনুভবও করতে হয়। সন্ধ্যার একটু আগে ট্যাঁকেরঘাটে আমাদের নৌকা ভিড়ল। নৌকা থেকে নেমে সবাই হাটা ধরলাম বাজারের দিকে। এখানকার একমাত্র প্রাইভেট গেস্ট হাউজে মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা করা হল।

ছেলেদের ইচ্ছা নৌকায় রাত কাটাবার। হোটেলে জম্পেশ একটা আড্ডা দিয়ে আমরা চলে এলাম নৌকায়। রাতের অন্ধকার ভেদ করে অসংখ্য নক্ষত্র মিটমিট করে জ্বলছে ওই দূর আকাশে। মনে হয় একটু জোরে বাতাস বইতে শুরু করলে নিমিষেই নিভে যাবে আকাশের ওই মিটিমিটি আলোর নক্ষত্রগুলো!
রাতের হাওর দেখার মজাই আলাদা। চারদিকে যেন কোন যুবতীর ঘন কালো চুলের মতো মাদকতাময় ভরপুর আঁধার।

রাত দ্রুত বেড়ে চলল। গান আর আড্ডা চলল সমানতালে। ধীরে ধীরে মেঘ এসে তারার রাজত্বের দখল নিল। একটু পর শুরু হল গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। আমাদের আসর ভাঙ্গল।

নৌকার ছইয়ের ভিতরে ঢুকে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।
ট্যাঁকেরঘাটের ভোর হয় পাখির ডাকে। চেনা অচেনা হরেক পাখির মিলিত কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মেঘালয়ের পাহাড় ঠেলে পূব আকাশে উকি মারে দিনমণি। হাওরের শান্ত সবুজ পানি লাল রঙ ধারণ করে।

সামনের বিশাল প্রাকৃতিক ক্যানভাসে অনায়াসে আঁকা হয়ে যায় কত কত মাস্টারপিস।
নাস্তা সেরে সকালের নরম রোদ গায়ে মেখে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম বারেক টিলার উদ্দেশ্যে। অদ্ভুত সুন্দর পাহাড় ঘেরা যাদুকাটা নদী বয়ে চলেছে তরতর করে। নদী-পাহার-আকাশ যেন মিলেমিশে একাকার। ঘড়ি বলছে আমাদের ফিরতে হবে।

অসংখ্য মাছধরা জালের গলকধাঁধা কাটিয়ে আমাদের ট্রলার ফিরে চলেছে সুনামগঞ্জের পথে। পিছনের পথ অতীতে মিশে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। স্মৃতির পাতায় যুক্ত হয় আরও একটি নতুন অধ্যায়।

 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।