২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি । এই দিনটার কথা খুব সম্ভবত আমার সারাজীবন মনে থাকবে । কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় শোনার অপেক্ষায় যখন প্রমোদ গুনছিলাম , ঠিক তখন টিভিতে কাদের মোল্লার সেই বিখ্যাত "ভি" সাইন দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম । কাদের মোল্লার আসলে ফাঁসি হচ্ছে না , বিষয়টা বিশ্বাস করতে আমার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল । মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবি করে আসা দলের শাসন আমলেও একজন চিহ্নিত রাজাকারের বেঁচে যাওয়া দেখতে পারার দুর্ভাগ্য হবে কখনও ভাবিনি ।
একজন অতি সাধারণ নগণ্য নাগরিক হিসেবে , এই অবস্থায় আমার আসলে কি করা উচিৎ হবে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না ।
ফেসবুকে আমার মত অসংখ্য মানুষের হাহাকার আর্তনাদ দেখলাম । তখনও আমার ধারণা ছিল না , আদালতের দেওয়া একটি রায়ের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ হিসেবে আসলেই আমাদের কি ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ । সেই ফেসবুকেই দেখলাম একটি ইভেন্ট খোলা হয়েছে । শাহবাগে আপনারা যেভাবে পারেন আসুন , এই রায়ের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ করি ।
একজন সাধারণ নগণ্য প্রতিবাদকারি হিসেবে শাহবাগের সেই ইভেন্টে যোগ দিলাম । শাহবাগের সেই অল্প জনস্রোত একসময় ফেনিল সমুদ্রের মত উত্তাল হয়ে গেল । চারিদিক থেকে মানুষ এসে শাহবাগে জড়ো হতে থাকল । তারপরের ঘটনা সবার জানা ।
শাহবাগ হল প্রজন্ম চত্তর সেই সাথে তৈরি হল গণজাগরণ মঞ্চ ।
সেই মঞ্চ একজন মুখপাত্রও পেল । প্রজন্ম চত্তর দেখতে পেল নানা সংগঠনের ব্যানারে লোকজন সেখানে জমা হচ্ছে । দিনের পর দিন নিজস্ব কায়দায় অথবা সাংগঠনিক কায়দায় সবাই প্রতিবাদ জানাচ্ছে । কেউ মুহুর্মুহু স্লোগান দিচ্ছে , কেউ বা মোম জ্বালিয়ে , ফুল সাজিয়ে প্রতিবাদ করছে । সবকিছু ঠিকই ছিল , কিন্তু ঝামেলাটা বাঁধল আর একটু পরেই ।
ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগও শাহবাগে এতো মানুষের ভিড় কোনভাবে আশা করেনি । শাহবাগে যেসব মানুষ ছিল বা প্রতিবাদ করছিল তাঁদের সবার দাবি ছিল এক । আওয়ামীলীগও বুঝেছিল , মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এই স্রোত কখনও তাঁদের বিপক্ষে যাবে না , তাই শাহবাগকে পুলিশি নিরাপত্তা দিতে সরকারের কোন বাঁধা ছিল না । শাহবাগে যেমন সাংস্কৃতিক সংগঠন যুক্ত হয়েছিল ঠিক তেমন রাজনৈতিক সংগঠনও যুক্ত হয়েছিল । ছাত্রলীগ প্রায় প্রথম থেকে শাহবাগে ছিল , কিন্তু একবারে প্রথমে তাঁরা সবাই ব্যাক্তিগত ভাবে শাহবাগে যুক্ত ছিলেন এরপর একসময় তারা সাংগঠনিকভাবেই শাহবাগের সাথে যুক্ত হবার সিদ্ধান্ত নেয় ।
অন্যদিকে বাংলাদেশের চিরবিপ্লবী বামদলগুলোও বসে ছিল না । তারাও শাহবাগের সাথে যুক্ত হয় , এবং এতো বড় বিপ্লব করার সুযোগ দেখে তাঁদের খুব সম্ভবত মাথা খারাপের মত অবস্থা হয়ে যায় । শাহবাগ হয়ে পড়ে নিজেদের চেনানোর মঞ্চ । যে বামদলের নেতাদের কালে ভাদ্রে নিজেদের টিভিতে দেখানোর সুযোগ মিলত সেই দল এবং তাঁদের নেতাদের প্রতিদিন টিভি ক্যামেরায় দেখানোর সুযোগ মিলে যায় এই শাহবাগে এসে ।
অনদিকে ক্ষমতাসীন দলের কাছে শাহবাগকে মনে হতে থাকে , সোনার ডিম পাড়া হাঁস ।
পদ্মা সেতু , শেয়ার বাজার , আবুল , সাহারা খাতুন সবার পাপ মোচনের গুরু দায়িত্ব শাহবাগের কাঁধে এসে পড়ে । গণজাগরণ মঞ্চের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে চলে যায় । ইমরান এইচ সরকার হয়ে যান পুতুল সরকার ।
শাহবাগের আন্দোলনে মানুষের খরস্রোতা নদীর মত স্বতঃস্ফূর্ততার চারপাশে দেওয়া হতে থাকে রাজনিতিকরনের বাঁধ । বামপন্থীদের ধারণা হতে থাকে এদেশে বিপ্লব হতে হলে তাদের হাত ধরেই হতে হবে ।
অন্যদিকে আওয়ামিলীগের ধারণা হতে থাকে , শাহবাগই পারবে তাঁদের নির্বাচনী বৈতরণী পার করিয়ে দিতে । তাই একে বাধ্য ঘোড়ার মত নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী চালিয়ে নিতে হবে ।
অন্যদিকে জামাত শিবির , এবং বিএনপি শাহবাগের এই তুমুল জনপ্রিয়তা দেখে শংকিত হয়ে পড়ে । জামাত যেভাবে পেরেছে এই আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে তৎপরতা শুরু করে দেয় । এবং বরাবরের মত জামাত তাদের সবচেয়ে ভয়ানক মরনঅস্ত্র ধর্মীও অনুভুতিকে এখানেও কাজে লাগায় ।
তাদের এই অস্ত্র ভয়ানকভাবে কাজে লেগে যায় । ফটোশপ , গুজব সবকিছু ব্যাবহার করে তারা অনেকাংশে প্রমান করতে সমর্থ হয় , শাহবাগ আসলে ধর্মবিরোধী আন্দোলন । ঠিক যেমনভাবে তারা প্রমান করেছিল মুক্তিযুদ্ধ আসলে ধর্মযুদ্ধ । অবশ্য শাহবাগের অতি বামপন্থী নাস্তিকরা তাদের হাস্যকর অনলাইন কার্যক্রমের মাধ্যমে জামায়াতকে বিশাল সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল , এবং জামাত শিবির এই কুড়িয়ে পাওয়া সুযোগ পুরোপুরিভাবে কাজে লাগায় । জামায়াতের এই ধর্মীয়চেতনার প্রচার থেকেই মুলত শাহবাগের জনসম্পৃক্ততা কমতির দিকে যেতে থাকে ।
অন্যদিকে শাহবাগে একটি পক্ষ ইমরান এইচ সরকারের অদ্ভুত মোম জ্বালানো নেভানো , বেলুনে চিঠি ভরে উড়িয়ে দেওয়া , অট্টহাসি কর্মসূচী দেখে হতাশ হয়ে পড়ে । শাহবাগ আন্দোলনকে যখন গতি দেবার দরকার ছিল কিছুটা আক্রমণাত্মক এবং আপোষহীন ভুমিকা পালন করে , তখন মুখপাত্রের এসব একক সিদ্ধান্তে নেওয়া কর্মসূচী দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল , তিনি সরকারের ইচ্ছাই কেবল বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন । কেননা সরকার কোনভাবেই চাচ্ছিল না , এই উত্তাল জনস্রোত তার বিরুদ্ধে যাক । কোনভাবে এই জনস্রোত কিছুটা স্থিমিত করা গেলে , এবং নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নেওয়া গেলে তাদের পুনরায় ক্ষমতায় আসা সহজ হবে ।
বাস্তবিক পক্ষে শাহবাগের অবস্থা হয়ে পরেছিল শুস্ক মরুতে অনেকটা হঠাৎ আসা নদীর মত ।
রাজনৈতিক দল , বিভিন্ন সংগঠন , কিংবা মুখপাত্র যে যেভাবে পেরেছে এই স্রোতকে নিজের দিকে টানতে চেয়েছে । এর ফলে শাহবাগ গতি হারিয়েছে । যখন বন্ধ হবার প্রয়োজন ছিল কিংবা কার্যক্রম সংকোচনের দরকার ছিল তখনও এটিকে লেবুর মত কচলিয়ে কচলিয়ে সবাই রস বের করে নিতে চেয়েছে । সবাই সবার চাওয়া শাহবাগকে দিয়েই বার বার পূরণের চেষ্টা করে গেছে । এরফলে সাধারণ মানুষের যে আন্দোলন হবার কথা ছিল এইটা আর তা থাকেনি ।
ক্রমেই গণজাগরণ মঞ্চ হয়ে পড়ে কাড়াকাড়ির মঞ্চ । শাহবাগকে আস্তে আস্তে সবাই ছেড়ে গেছে । এখনও কেউ একে ধরে রেখছে । কেউ হয়তো ভালবাসা থেকে আবার কেউ হয়তো বা শাহবাগ লেবু থেকে শেষফোঁটা রস শুষে নিতে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।