গ্রিক মিথলজির অবাক নারী চরিত্র আটলান্টা। গহিন অরণ্যে মা-ভাল্লুকের দুগ্ধ পান করে বেড়ে ওঠা আটলান্টা ছিল দক্ষ শিকারি। তার রোমাঞ্চকর জীবন-যাপনের গল্প বিস্ময় জাগায়। অবশেষে দেবী আর্টেমিসের অভিশাপে সিংহীতে রূপান্তরিত হতে হয় আটলান্টাকে...গ্রিক মিথে দেখা যায়, আটলান্টাকে ট্র্যাজেডির ছোবলে বিষাক্রান্ত এক চরিত্ররূপে। দৈহিক সৌন্দর্যের আধার আটলান্টা ছিলেন দুর্ধর্ষ শিকারি আর তার জীবনী মিষ্টি প্রেমের গল্পের ছকে যেন বাঁধা।
আটলান্টা গ্রিক পুরাণের সবচেয়ে আলোচিত নারী শিকারিদের একজন। গ্রিক মিথলজির যে কোনো নারী চরিত্রের তুলনায় তার নৈপুণ্য আর সাহসিকতার বর্ণনা এসেছে সবচেয়ে উজ্জ্বলভাবে। যে কারও চেয়ে আটলান্টার জীবনকাহিনী বর্ণিল ও বিচিত্রতায় ভরপুর। আটলান্টার শৈশব সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, আটলান্টা শৈশবেই মা-বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারপর জঙ্গলে বেড়ে উঠতে শুরু করে।
গ্রিক মিথের অনবদ্য উপাখ্যান হিসেবে আটলান্টার জীবনী বেশ প্রাচুর্যময়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে তার অদম্য সাহস ও নারীর সহজাত ভালোবাসার ক্ষমতার কাছে। তার উপাখ্যান গ্রিক সাম্রাজ্যের স্বর্গ হিসেবে খ্যাত আর্কেডিয়ায়। আর্কেডিয়া রাজ্যটি তখন আইয়াসুসের শাসনে ছিল। তার স্ত্রী ক্লাইমেনে ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী।
রানী হিসেবেও তিনি বেশ খ্যাত ছিলেন। রাজার পুত্রসন্তানের খুব শখ ছিল। রাজ্যের ভবিষ্যৎ কর্ণধারের আশায় রাজা তখন বিভোর। কিন্তু অদৃষ্টের লিখন ছিল অন্যরকম। তার ঘরে জন্ম নিল ফুটফুটে এক কন্যাশিশু।
স্বাভাবিকভাবেই আশাহত রাজার ক্রোধে পড়তে হলো অবুঝ শিশু সন্তানকে। নির্দয় আইয়াসুস অনুচরদের নির্দেশ দিলেন তার কন্যাটিকে আর্কেডিয়ার গহিন জঙ্গলে রেখে আসতে। তবে হত্যার নির্দেশ ছিল না। রানী ক্লাইমেনে এতে বাধা দেন। মায়ের আকুতি রাজা শুনলেন না।
ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান হারানো রাজার কথামতো সন্তানটিকে অরণ্যের গভীরে রেখে আসা হলো। এসব দেখছিলেন দেবী আর্টেমিস। কিন্তু তিনি শেষটা জানেন বলেই কোনো অভিশাপ দিলেন না। আর্টেমিস দৈব্যবলে একটি মা-ভালুক পাঠান আর্কেডিয়ার অরণ্যপ্রান্তরে। ভাল্লকের বুকের দুধ খেয়েই প্রাণ বাঁচল শিশুটির।
এ এক অন্যন্য দৃষ্টান্ত। অরণ্যের বৈরী পরিবেশে মা-ভাল্লুক মানব শিশুকে এতটাই আদর-যত্নে লালন-পালন করতে লাগলেন যেন কোনো কমতি ছিল না। প্রখর রোদ, ঝড়, বৃষ্টি অথবা প্রচণ্ড শীত যাই হোক না কেন- মা-ভাল্লুক আগলে রাখে শিশুটিকে। তার রোমশ উষ্ণতায় নিশ্চিন্তে বেড়ে উঠতে শুরু করে মানব সন্তানটি। গহিন অরণ্যে একা একাই বড় হতে শুরু করে শিশুটি।
দেবী আর্টেমিস প্রয়োজনে এসে শিশুসন্তানটির খোঁজখবর নিয়ে যান। দেবী আর্টেমিস শিশুকন্যার নাম রাখলেন আটলান্টা। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দেয় আটলান্টা, বন্য পরিবেশের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে উঠছে। বৈরী পরিবেশে থেকে অস্ত্র চালনার কৌশল শিখেছে অনন্য নৈপুণ্যে। তার তীর-ধনুকের নিশানা ছিল অব্যর্থ।
কুমারী আটলান্টা দেবী আর্টেমিসের মতোই দক্ষ শিকারি হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। আর্কেডিয়ার অরণ্যে ঘুরে বেড়াত ব্যাধেরা। তারা আটলান্টার সৌন্দর্য ও সাহস দেখে অবাক না হয়ে পারত না। শিকারে ভীষণ পারদর্শী হয়ে ওঠা আটলান্টা খুব দ্রুতগতিতে ছুটতে পারত। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিখ্যাত সব বীরযোদ্ধা আর শিকারিরাও হার মানত।
মেষের চামড়া সংগ্রহ করার জন্য তখন বনে গ্রিক বীর জেসনের অভিযানেও ছিল আটলান্টা। যদিও এ নিয়ে সন্দেহ আছে শুধু নারী বলেই জেসন তাকে অভিযানে নেয়নি। যৌবনে এসে আটলান্টার রূপ-মাধুর্যে পাগলপ্রায় ছিল প্রায় সবাই। খ্যাতিমান যোদ্ধা পুরুষরা তাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব পাঠাত। কিন্তু আজীবন কুমারী থাকার ইচ্ছা রয়েছে বলে সব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিত আটলান্টা।
সত্যি বলতে মা-ভাল্লুকের দুগ্ধপান করা, অরণ্যের ব্যতিক্রমী পরিবেশ তাকে বৈচিত্র্যমণ্ডিত করেছে। নারী শিকারি হিসেবে তখন আটলান্টাকে চেনে আর্কিডিয়া রাজ্য। একবার আটলান্টা কালিদোনীয় শূকর শিকারে অংশ নেয়। আর তার পারদর্শিতার কারণে দ্রুতই বিখ্যাত হয়ে ওঠে সে। কালিদোনীয় রাজা অনিউস একবার দেবী আর্টেমিসের উদ্দেশ্যে পশু উৎসর্গ করতে ভুলে গিয়েছিলেন।
আর্টেমিস প্রতিশোধ নিতেই কালিদোনিয়ায় বিশাল এক শূকর পাঠালেন। শূকরটি কালিদোনীয় ফসলের ক্ষেত, আঙুরের ক্ষেত তছনছ করল। মানুষ প্রাণভয়ে ছুটে পালাল। রাজা অনিউস ছেলে মেলিয়াজার। রাজা মেলিয়াজারকে শূকর হত্যা করতে নির্দেশ দিলেন।
এদিকে মেলিয়াজার শূকর হত্যা অভিযানে যাওয়ার জন্য সেরা শিকারিদের একত্রিত করলেন। আটলান্টাও এসে হাজির হলো। আটলান্টাকে দেখেই তার রূপ-সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলেন মেলিয়াজার। একে অন্যকে দেখা মাত্রই প্রেম। কিন্তু আটলান্টার সেদিকে মন নেই।
শিকার শুরু হলে আটলান্টা প্রথমেই শূকরটিকে তীর ছুড়ে আহত রক্তাক্ত করল। তার তীরের অব্যর্থ নিশানার নমুনা দেখে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল বীর শিকারিরাও। এদিকে আটলান্টার বাবা আর্কেডিয়া রাজ্যের রাজা আইয়াসুস তার কন্যাকে অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। তার কন্যাকে আর্কেডিয়ার রাজবাড়িতে ফিরিয়ে নিলেন। রাজপ্রাসাদে সুখেই দিন কাটতে লাগল আটলান্টার।
রাজা আইয়াসুস মেয়ের বিয়ে দেবেন বলে ঠিক করলেন। কিন্তু আজীবন কুমারী থাকতে চায় আটলান্টা। অবশ্য এক পর্যায়ে সে বিয়ে করতে রাজি হলো। তবে সে দুটি শর্তজুড়ে দেয়। তার প্রথম শর্ত ছিল- যে আটলান্টাকে দৌড় প্রতিযোগিতায় হারাতে পারবে তাকেই সে বিয়ে করবে।
দ্বিতীয় শর্ত ছিল- দৌড় প্রতিযোগিতায় যে হেরে যাবে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। আটলান্টাকে বিয়ে করার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত অনেক বীরযোদ্ধাও। গ্রিসের অনেক বীর দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এলো। সবাই হেরে গেল এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। প্রাণভয়ে সবাই যখন পিছিয়ে যেতে শুরু করে তখন রাজপ্রাসাদে এসে হাজির হিপপোমেনেস।
সেও গ্রিসের এক সাহসী বীর যোদ্ধা। সে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এ বিষয়ে দেবী আর্টেমিসের সাহায্য প্রার্থনা করে। দেবী আর্টেমিস তাকে তিনটি সোনালি আপেল দিলেন। তারপর বললেন, দৌড়ানোর সময় তুমি পথের ওপর একটা একটা করে আপেল ছুড়ে ফেলবে। পথে সোনালি আপেল দেখে আটলান্টা না থেমে পারবে না।
সেই ফাঁকে তুমি দৌড়ে শেষপ্রান্তে পেঁৗছে যাবে। দৌড় শুরু হলো। হিপপোমেনেস দেবী আর্টেমিসের কথামতো একটা একটা করে আপেল ছুড়ে মারল। আটলান্টা সোনার আপেল দেখে না থেমে পারল না। চতুর কৌশলের কাছে দৌড় প্রতিযোগিতায় আটলান্টা হেরে গেল।
শর্ত পূরণ হওয়ায় হিপপোমেনেস এবং আটলান্টার বিয়ে হলো। কিন্তু বিয়ের পর হিপপোমেনেস আটলান্টাকে নিয়েই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। এদিকে দেবী আর্টেমিসের গুণগান গাওয়া দূরে থাক তার অবদানের কথাও ভুলে বসে আছে হিপপোমেনেস। এ কারণেই দেবী আর্টেমিস ভয়ানক ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলেন। তিনি প্রতিশোধ নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন।
হিপপোমেনেস এবং আটলান্টা যখন দেবতা জিউসের উপাসনালয়ে প্রার্থনা করছিল তখন অভিশাপ ছুড়ে দেন আর্টেমিস। মুহূর্তে আটলান্টা সিংহীতে রূপান্তরিত হলো। দেবীর অভিশাপের ফলে সিংহী শুধু চিতাবাঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারত। এ কারণেই বাকি জীবন হিপপোমেনেস এবং আটলান্টাকে একজন আরেকজনের কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে হলো। ট্র্যাজেডিক পরিণতি আটলান্টার সব সুখ কেড়ে নিল।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।