আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল আজ সকালে অফিসের গাড়িটা না পেয়ে, "তো কি হইছে" ভঙ্গিতে বুক চেতিয়ে বাসা থেকে বের হলাম; মিরপুর থেকে উত্তরার অভিমুখে। রাস্তায় গিয়ে কিছুক্ষণ কিছু সিএনজি ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে কথা বলার চেষ্টা চালালাম। অনেক চেষ্টার পর যাদের টিকিটা'র লাগুর পাচ্ছিলাম, তারা অদ্ভুত সব সংখ্যার কথা বলছিল! আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম। ভাড়ার কথা বলে? নাকি আমার হাতের ল্যাপটপের ব্যাগটা কিনতে চেয়ে দাম হাঁকায়?
তারপর রাস্তার পাশে আমার মত ট্যাক্সির জন্য ছুটাছুটি করে হাঁপাতে থাকা গোমড়া-মুখো এক ভদ্রলোক, আমাকে বলল কিনা বুঝলাম না, তবে পাশে গিয়ে দাঁড়াতে আনমনে মুখ আরও গোমড়া করে বিড়বিড় করল, "বাস"।
আমিও আনমনে ঐ দিকে রওয়ানা হলাম।
ফ্লাইওভার চালু হবার পর থেকে ওটার উপর দিয়ে নাকি একটা বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। খবরটা শুনার পর আমি হাসি ভরা গাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মাঝে মাঝে খুশিতে পায়ের আঙ্গুলে টিল্কি দিচ্ছি! ১০ মিনিট যেতে না যেতেই বাস চলে আসল। আনন্দে আমি রীতিমত শব্দ করে হাসতে হাসতে বাসের দরজার দিকে দৌড় দিলাম। হা হা হা হা!
কিন্তু উঠতে চাইতেই হেল্পার আর বাসে উঠে বসার যাত্রী ক্যান্ডিডেট'রা আমার দিকে জম্বির মত নিষ্প্রাণ চোখগুলো নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
আমি ভয়ে থমকে গেলাম!
হেল্পার বলল, "ভাই"।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম "জি ভাই?"
"ঐ যে দেখতে পাচ্ছেন, আপনার পেছনে, ঐটা লাইন। "
আমার মুখের প্রাণবন্ত হাসিটা নিমিষে একজন জম্বির হাসি'তে রূপ নিলো! আকাশ-বাতাস দুলে উঠল! তাকিয়ে দেখি, একটা বিকলাঙ্গ সাপের মত অদ্ভুত ভাবে একে-বেঁকে একটা লাইন বহুদূর চলে গেছে। কড়া রৌদ্রের কারণে লেজের দিকটা দিগন্তের কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টের ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে। ওখানে রেস্টুরেন্টের সাদা পোশাক পড়া একটা ছেলে ক্রমাগত লেজের অংশ হয়ে থাকা একটা লোককে রেস্টুরেন্ট থেকে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
ভাঙা গলায় প্রশ্ন করলাম, "ওওওঐ দিকে?"
উত্তর দেওয়ার জন্য তারা সেখানে নাই। বাস চলে গেছে। কি যাত্রী নিলো? লাইনের লেজ'তো এখনও রেস্তোরাঁর ভেতরে!
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সেই গোমড়া-মুখো ভদ্রলোকের মত চেহারা করে, ক্লান্ত পায়ে অনেকক্ষণ হেঁটে পৌঁছলাম লাইনের পিছনে। রেস্টুরেন্টের বয়ের সাথে কিছুক্ষণ ফাইট করলাম।
কিছু সময় যেতে খেয়াল করলাম মাঝে মাঝেই বেনামী, নম্বর বিহীন কিছু বাস আসছে।
বিভিন্ন অফিসের বাস। তাদের সাধারণ যাত্রী নেওয়ার কথা না, কিন্তু নেয়। চুরি করে নেয়।
হেল্পারের চোখেমুখে কৃত্রিম অনিচ্ছা। দরজা খুলে হেল্পার বেটা অন্য দিকে তাকিয়ে "আব্দুল্লাহপুর" বলে যাক্কুইর* দিয়ে বাসের ভেতর গিয়ে বসে থাকে।
আর যাত্রীরা লাইনের বাসের লাইন ভেঙে পাখির ঝাঁক হয়ে হৈ হৈ করে বাসগুলোতে ওঠার চেষ্টা চালায়।
হেল্পার কিছুক্ষণ পর দরজার সিঁড়িতে নেমে এসে, প্রবল বেগে, না' সূচক হাত নাড়তে থাকে। প্রতিবাদ করে কেউ কেউ প্রবল হাত নাড়াকে উপেক্ষা করে উঠে যায়। হেল্পার তার নিষেধ অমান্য করা সত্ত্বেও প্রতিবাদী যাত্রীর পিঠে চাপড় দিয়ে বাসের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে আবার না সূচক হাত নাড়তে থাকে।
আমিও একবার গেলাম থেকেথেকে উড়া-উড়ি করতে থাকা যাত্রী-পাখির ঝাঁকের সাথে।
কিন্তু হায়!
আমার সামনের জনও পিঠে চাপড় পেল। আমি পেলাম প্রবল বেগের হাত নাড়া। লাজুক লাজুক মুখ করে ফিরে আসতে হল লাইনে।
মাঝে মাঝেই দেখলাম খালি প্রাইভেট গাড়ি'গুলো থেমে থেমে ডাকছে, আর ডাকতেই লাইন থেকে দলছুট পাখির মত লোকজন ছুটে ছুটে যাচ্ছে ওগুলোর দিকে। যাচ্ছে পাঁচ জন।
হাত নাড়া খেয়ে লাজুক মুখে ফিরে আসছে তিন হন।
ফিরে এসে লাইনের ছেড়ে যাওয়ার স্থানটা খুঁজছে। কিন্তু সহজে পাচ্ছে না, কারণ যারা ঝাঁকের সাথে যায় নাই, তারা প্রতিশোধ নিতে একজন আরেক জনের পিছনে এত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে যে, সেখানে মানুষ কি, একটা চড়ুই পাখিও কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
যাহোক পাক্কা ৪৫ মিনিট পর বাসে উঠতে পারলাম। অফিসে ঢুকতেই, দেড়ি করার জন্য প্রতিদিন যাদের কথা শুনাই, তারা আনন্দিত মুখে ঘুরে তাকাল আমার দিকে।
ঘড়িতে তখন এগারোটা বাজে বাজে করছে।
আমি তাঁদের আনন্দিত সম্ভাষণের উত্তরে আরও বেশি আনন্দিত হবার ভান করে উত্তর দিলাম "সুপ্রভাত"! মনে মনে বললাম, "কি ব্যাপার আজকে আপনারা এত তাড়াতাড়ি যে"! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।