সীমাহীন পথে ছুটে চলা নদীতে সাঁতার কাটি আমার অবারিত স্বপ্নের বৈতরনি নিয়ে ..........
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগে পাকিস্তান এর কাছে বাংলাদেশ এর যে অবস্থান , বিক্রপুর এর এক বিখ্যাত পরিবারের বৈমাত্রেয় বড় ভাই দের কাছে আমার দাদা এর অবস্থান কে ও সামানুপাতিক বলা চলে ।
পূর্ব বংগ হল দুঃখিনী বাংলা , আর দাদা জান হলেন দুইক্ষা । দ্বিতীয় পত্নীর ঘরে জন্মাবার পর যে ছেলে র বাবা মারা যায় , তার জন্য আফতাব উদ্দিন তালুকদার বড্ড গাল ভরা বৈকি ।
উত্তরাধিকার সুত্রে কিছু সম্পতি পেয়েছিলেন , উচ্চাভিলাষী একটা মন পেয়েছিলেন কিন্তু সব চাইতে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনার অভাবে ব্যাবসার প্রসার জমাতে আসাম চলে আসেন বড় দুই ছেলে সহ ।
বছর খানেক এর মাথায় খবর আসে কালা জ্বর এ আক্রান্ত হবার ।
দাদা জান এর বড় দুই চাচা সহ মৃত্যুর পর পরিবার এর হাল ধরেন বড় কাকা , জীবিত ৪ সন্তান এর মাঝে আব্বা ছিলেন ছোট, নিজেদের পারিবাকির স্কুল থাকায় প্রাথমিক শিক্ষায় বেগ পেতে হয়নি , বাধ সাধল মাধ্যমিক এর বেলায় , বড় ভাই এর বক্তব্য ছিল , স্কুল এ যে সময় টা নষ্ট করবে , ওই সময় এর মাঝে অর্ধেক জমির ধান কেটে ঘড়ে তোলা যায় ।
একমাত্র আশ্রয় ভাই এর কথা অমান্য করার উপায় এবং ইচ্ছা ও ছিল না , সকালে র পান্তা শেষ এ খেলা ফেলে ধান কাটায় ব্যাস্ত হয়ে যেতেন , সূর্যের দিকে নজর রেখে নির্দিষ্ট পরিমাণ শেষ করতে হত , হাতের কাচি ( কাস্তে) ধান এর গাদায় লুকিয়ে রেখে , হাত মুখ ধুয়ে ভাজ করে রাখা পিরান ( শার্ট) গায়ে চলে যেতেন স্কুল এ ।
এভাবে ই শেষ হল গাঁয়ের মাধ্যমিক পর্ব ,উচ্চ মাধ্যমিক এ সময় সুযোগ ,ব্যায় সব কিছুই উচ্চ পর্যায়ে চলে গেলে , মা এর অনুমতি নিয়ে একরাতে বাড়ি ছাড়লেন কলেজ এ ভর্তির আশায় , স্কুল এর সদয় শিক্ষক এর সহায়তায় , লজিং মাষ্টার থাকার সুবাদে ,উচ্চ মাধ্যমিক এর প্রথম বিভাগীয় সনদ হাতে আসে ।
বড় ভাই( আমার কাকা ) এর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ,আমি দেখেছি আব্বা উনার প্রতিটি নির্দেশ বিনা প্রশ্নে পালন করেছেন ।
না এর গ্রাজুয়েট হবার সৌভাগ্য আমার আব্বা র হয় নী, যার জন্য পরবর্তী জীবনে অনেক বেশি তৃষ্ণার্ত ছিলেন ।
পরিতৃপ্ত হয়েছিলেন ৫ সন্তান এর বাংলাদেশ এর সবচাইতে বড় বিদ্যা পীঠ গুল থেকে শিক্ষা সনদ প্রাপ্তি তে ।
ডিকশনারি বা ষ্টক অফ ওয়ার্ড এই নামেই পরিচিত ছিলেন নিজের কর্ম স্থানে , পেশাগত জীবনের সবচাইতে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী রাও স্বীকার করেছেন সে কথা ।
আমার আব্বা র জীবনের সব চাইতে বড় প্রাপ্তি , অর্জন এবং সম্পদ আমার " মা " একজন মানুষ হিসেবে যতটুকু অপূর্ণতা ছিল ,আমার মা ,একজন আত্মার সঙ্গী হিসেবে বাবা কে পূর্ণতা দেন ।
হুমায়ূন আজাদ এর " আমার মা " কবিতা পড়ে আমি উনার মা বা একজন মা এর জন্য যতটা কেঁদেছি , তার চাইতে বেশী কেঁদেছি (সেখানে যে বাবার বর্ণনা উঠে এসছে , তা দেখে ) আমার আব্বা র মহত্তে ।
ছোট বেলায় ঈদ এর দিন সকালের ঘুম ভাঙত পরিচিত একটি দৃশ্য তে , রান্না ঘরে ফজর শেষ করে রান্না শুরু করছেন মা , দরজার সামনে বেত এর মোড়ায় আব্বা বসে গল্প করছেন আর খাবার এর মিষ্টি র পরিমান ঠিক আছে কিনা দেখে দিচ্ছেন ।
যা আমার জীবনের দেখা অসম্ভব কিছু মহামূল্যবান দৃশের একটি ।
পেশাগত জীবনে হোক বা ব্যাক্তিগত জীবনে সামান্য সুজুগ ও কাজে লাগিয়েছেন মানব কল্যাণে , স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরী করতেন বিধায় আমাদের বাসা যেমন ছিল, আধা হাসপাতাল , তেমনি শিক্ষা র প্রতি অনুরাগ এর কারনে অর্ধেক ছাত্রাবাস ।
খুব ছোট একটা চাকরী করতেন আব্বা , ছোট কেরানীর চেয়ারে বসে ই সপ্নে দেখতেন দরজার ওপাশে র রুম এ বিশাল মেহগনি টেবল এর অপর প্রান্তে বসা ছেলে মেয়ে র মুখ । মাসের বেতনে সেইন্ট ফান্সিস এর মত স্কুল এর খরচ যোগাতে প্রতি বছর একবার গ্রামের জমি বেচে দিতেন । বিন্দু মাত্র দুঃখ না অনুশোচনা ছিল না এর জন্য ।
মধ্যবিত্ত সমাজের সব গল্প ও কবিতায় দেখি উঠে আসে কন্যা দায়গস্থ পিতা র আসহায়ত্ত , নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার এর মেয়ে হয়ে ও "কন্যা দায় না অহংকার" আব্বার এই সপ্নের সাথে আমারা পথ চলতে শিখেছি ।
তখন টেলিভিশন মোটামুটি নতুন , পাড়ায় একটা টি, ভি অনেক , বড় আপা কার বাসায় দেখতে যেয়ে না দেখে ই ফিরে এসছেন , মেয়ের সেই অভিমানি চোখ দেখে ঠিক ১ মাসের মাথায় বাসায় টেলিভিশন এনেছিলেন , প্রতিবেশী রা আমাকে ডেকে বলতেন ,বড় মেয়ে র কান্নায় বাসায় টেলিভিশন এসছে , তোমরা কাদলে নিশ্চয় বাড়ি কিনে ফেলবেন তোমার বাবা , আমিও তাই বিশ্বাস করি , কিন্তু জাগতিক অনেক কিছু র মোহ থেকে মুক্তি সেটাও উত্তরাধিকার সুত্রে আব্বা র কাছে ই পেয়েছি ।
আমরা হয় পড়তে বসেছি ,কাল বৈশাখী ঝড় , বৃষ্টি তে বাইরের শুকনো কাপড় তুলতে আব্বা যাচ্ছেন মা এর সাথে , পড়তে বসেছি , আব্বা এসে পানি দিয়ে যাচ্ছেন , চলতে পথে কিছু মাটি তে পরেছে , ধুর পরে তুলব ভেবে পাশ কাটিয়ে চলে গেছি , ঠিক পিছন থেকে এসে আব্বা সেটা তুলে দিয়েছেন , বাইরে যাবার সময় কোথায় চিরুনি খুজে পাচ্ছি না, ঠিক আব্বা তুলে রেখেছেন । যতক্ষণ বাসায় থাকতেন ছায়া হয়ে ছুয়ে যেতেন ।
সিধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা ছিল পুরটাই , দিক- নির্দেশনা দিতেন ।
মাঝে মাঝে বড্ড কষ্ট হয় এত টা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম বলে । এখন মনে পরে পরিবারের বড় সিধান্ত নেয়ার মুহূর্ত গুল , বড় বোন এর বিয়ের সময় ,আমার ছোট বোন এর বয়স মাত্র ৮ বছর কিন্তু দুলাভাই নির্বাচনে তার মতামত বিবেচ্য ছিল । যখন কোন ভুল সিধান্ত নিয়েছি , বুঝয়ে বলায় সেটা মানতে তাই আমাদের কোন কষ্ট হয়নি , এতে করে আমরা সবাই অনেক বেশী সহনশীল হয়েছি যেমন তেমনি পরমত সহিষ্ণুতা ও অনেক খানি বেড়েছে ।
সাবসিডিয়ারি পরীক্ষা শেষ করে ফিরছিলাম ,ভীষণ মন খারাপ , বাসায় যাবার উপায় নেই , ঠিক হল গেট এর সামনে আব্বা র উৎকণ্ঠিত মুখ ।
আমার বিয়ের পর ছুটি জটিলতার কারনে বৌভাত এর দিন নির্ধারিত হয়েছিল ৭ দিন পর , আমি জানি না আর কোন বাবা এমন টা করেছিলেন কিনা বিনা দাওয়াতে ঠিক তৃতীয় দিন উনি উনার খালা কে দেখতে চলে এসছিলেন , আমার বাবা র কাছে এই পোস্ট ই খালি ছিল , আমার বড় বোন ছিলেন আব্বা র শাশুড়ি আম্মা , মেজ বোন মা , আর আমি ছিলাম খালা , জানি না মা চাইতে মাসির দরদ বেশী তা প্রমান করতে পেরেছিলাম কিনা ।
একদম ই রান্না পারতেন না , কিন্তু মা কোথাও গেলে আমার জন্য অপটু হাতে বসানো মুসুর ডাল আর ডিম ভাঁজা , এখন ও আমার কাছে পৃথিবীর যে কোন খাবারের চাইতে বেশী লোভনীয় ।
রাত জেগে বিশকাপ ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা দেখার সময় চুরি করে মা কে লুকিয়ে আব্বার হাতে বানানো চা ভাগ করে খেতাম ,খেলা দেখা যাই হোক চা এর নেশা টা বড় ছিল ।
আমাদেরর বাসায় বিছানার নিচে , বাসার সব খুচরা টাকা পয়সা থাকত , শেখানো হয়েছিল টাকা বা পয়সা বড়দের না জিজ্ঞেস করে ছুতে নেই , শেখান কথা কতটা আমরা কার্যক্ষেত্রে পালন করছি সেটার পরিক্ষা ও নিতেন , যা মারা যাবার আগে আমাদের কে বলে গেছেন ।
এতটা মুগ্ধতা নিয়ে দেখতেন , নিজেদের কে পরিপূর্ণ মনে হত ,এখন আমি নিজেও মা হয়েছি , কোথায় এত টা মুগ্ধতা তো ধরে রাখতে পারি না । সহজেই বিরক্ত হয়ে যাই ।
কখন যদি কোণ ভাবে আমাদের উপর বিরক্তি দেখাতেন , চরম বিপদে ও স্থির আমরা যে কেউ ভেঙ্গে পরতাম কান্নায় ।
স্বল্পাহারী ছিলেন , প্রতিবার খাবারের সময় মনে করিয়ে দিতেন এক ভাগ খালী রাখতে হবে, এক ভাগ পানি আর বাকি একভাগ খাবার দিয়ে পূর্ণ করতে হবে , কিন্তু সেই আব্বা ই আমরা হোস্টেল থেকে বাসায় গেলে ব্যস্ত হয়ে পরতেন কিভাবে আমাদের কোন টা খাওয়াবেন , প্রতিবার বাসায় এসে একটা কথা শুনতাম " নাহ মেয়ে গুলি না খেতে খেতে মনে হয় খাদ্য নালি শুকিয়ে গেছে , এরা এখন ভাল মত খেতে ও পারে না ।
আমাদের জীবনে সিক্রেট বুক আমাদের পরিবার , আব্বা র কাছেই শিখেছি অকপটে বলতে পেরেছি ,আমাদের পছন্দ অপছন্দের কথা , হাসি কান্নার গল্প বা ভালালাগার মুহূর্ত ,জীবনের এই বেলায় এসে যখন সব চাইতে প্রিয় বন্ধু কে খুজে ফিরি , বা রচনা লিখতে বসেছি ছাত্র জীবনে , ভাল বন্ধু অনেক পেয়েছি খুজে , কিন্তু প্রিয় বন্ধু বলতে পরিবার কেই জেনেছি , যার মধ্যমণি আমার বাবা ।
শ্বাস কষ্ট ছিল আব্বার , যেদিন অসম্ভব কষ্ট হচ্ছিল , বাসা ভর্তি আত্মীয় স্বজন এর সামনে কনফেস করে গেছেন ।
০৪ ।
০৬। ২০০২ এই দিন রাত দশটা বেজে ৪৫ মিনিটে আমার আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন
মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয় কেন আব্বা কে আমরা আমাদের পুর সফলতা টুকু দেখাতে পারলাম না , কেন উপভোগ করতে পারলেন না আমাদের আজকের এই পথাচলা , পর-মুহূর্তে মনে পরে যায় বেঁচে থাকতে নিজের উপার্জনে যিনি কিচ্ছতা সাধন করে গেছেন তার জন্য আল্লাহ সঠিক সময় ই নির্ধারণ করেছিলেন ।
শুধু পরম করুনা ময় মহান রাব্বুল আলামিন এর দরবারে প্রার্থনা করি , আব্বার শিখান পথ ই ...।
রাব্বানাগফির লী-অলি ওয়ালিদাইয়্যা অলিল মু'মিনী-না ইয়াওমা ইয়াকু-মুল হিছাব।
-হে আমাদের প্রতিপালক,যেদিন হিসাব হবে সব কাজের সেদিন আমাকে,আমার পিতা-মাতাকে এবং মু'মিনগনকে ক্ষমা করুন।
(সূরা ইব্রাহীম-৪১)
রাব্বির হামহুমা-কামা রাব্বাইয়ানি ছাগী-রা।
-হে আমাদের প্রতিপালক,আমাদের পিতা-মাতাদের প্রতি দয়া করুন,যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন। (সূরা আল-ইসরা-২৪)
আমি কি আমার অতি সাধারন একজন মানুষ ও-সাধারন পিতা আব্বা র জন্য আপনাদের দোয়া আশা করতে পারি ।
সবাই দোয়া করবেন ,আমার পিতার কবরের আজাব যেন আল্লাহ মাফ করে দেন , উনার ইচ্ছাকৃত অনিচ্ছাকৃত , জানা -অজানা সব ধরনের গুনাহ জেন আল্লাহ মাফ করে বেহেশত নসিব করেন ,আমিন ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।