লেখাটি হোটেল প্যালেসে(বগুড়া) বসে ২৭/ ৭/২০১২তে লেখা।
গত ১৯শে জুলাই,২০১২ হুমায়ুন আহমেদ নউইয়র্কের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তিকাল করেন। এই পৃথিবীতে প্রতিদিন প্রতি মহুর্তে কত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। কারও বিদায় বেলায় হয়তো দু’ফোটা চোখের জল ফেলানোর মানুষটিও থাকে না। আবার কারও কফিন যাতায় লাখো কোটি মানুষের ফুলেল সিক্ত ভালবাসা,শ্রদ্ধায় অবনত মস্তক বিদায়ের বিষন্নতায় ভরে ওঠে।
পৃথিবীর আনাচে-কানাচে জাতিতে জাতিতে হুমায়ুনেরা নিভৃতেই জন্মে। আর বিদায় বেলায় এভাবেই কাঁদিয়ে ছাড়ে।
হুমায়ুনের অপেক্ষায় জনতা
খনিজ সম্পদ,বর্তমান পৃথিবীর উন্নয়নের চাবিকাঠি। এর ব্যবহার ও নিরাপত্তায় রাষ্ট্রের পরিশ্রমের কমতি থাকে না। সোনা,খনিজ তেল,প্রাকৃতিক গ্যাস,কয়লা ইত্যাদি কোন কিছুই মাটির উপরিভাগে থাকে না।
মাটির হাজার হাজার ফুট গভীরতায় এদের বসবাস। ধরিত্রী আপন মমতায় তাঁর পেটে এই মহামূল্যবান সম্পদ ধারণ করে রাখে। অনেক অনুসন্ধান ও গবেষণায় তাঁকে খুঁজে বের করে তুলে এনে আমরা মানব কল্যাণে ব্যবহার করি। মানুষের দেহটাও মাটি দিয়ে তৈরী। আর মাটির তৈরী মা তাঁর গর্ভে আপন মমতায় হুমায়ুনদের ধারণ করে।
মাটি পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞরা খনিজ সম্পদের অস্তিত্ব নিরুপণ করে,মানব কল্যাণে কোন কাজে লাগবে তাও বলে দেয়। কিন্তু মাতৃগর্ভ পরীক্ষা করে ডাক্টারেরা যে শিশুর অস্তিত্ব নিরুপণ করে সে শিশু কোন অংশে নিজেকে প্রস্ফুটিত করে জগতের কল্যাণে নিয়োজিত করবে তা বলতে পারে না।
রবী ঠাকুরের শান্তিনিকেতন আর হুমায়ুনের নুহাশ পল্লী। নজরুল মসজিদের পাশে আর হুমায়ুন লিচুতলায়। মানুষ কবে,কখন,কোথায়,কিভাবে মারা যাবে তা কেউ বলতে পারে না।
কোন কোন দূর্ঘটনায় অনেক সময় লাশই খুঁজে পাওয়া যায় না। সেখানে মসজিদ,লিচুতলার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। আর হুমায়ুনের নুহাশ পল্লীর লিচুতলা ? সাধ ও সাধ্যের অপূর্ব সমন্বয়,ভাগ্য লক্ষ্ণীর কৃপাও বটে।
দারিদ্রতা নজরুলের চিরসাথী। নজরুলের লেখা পড়ে বিদ্যা অর্জন করি,বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ডিগ্রিধারী হই।
কিন্তু কেউ নজরুল হতে চাই না। ভয়, যদি দারিদ্রতা পিছু নেয় ? অবিভাকেরাও কেউ চায় না তাঁর সন্তান নজরুল হোক,চায় অন্য কিছূ। যেখানে কেবল অর্থ আসবে কাঁড়ি কাঁড়ি। সন্তান হবে অর্থ যোগানের মেশিন।
হুমায়ুন নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়েও আপন পরিশ্রমে স্বচ্ছল হয়েছিলেন।
সাহিত্যকেও করেছিলেন সমৃদ্ধ। হুমায়ুন তিলে তিলে গড়েছিলেন নুহাশ পল্লী। সঙ্গী ছিল তাঁর বহুধা প্রতিভা। নুহাশ পল্লীতে বসেই গেঁথেছেন একেকটা জাদুর কীর্তি। গাছ থেকে কেবল ফল নয়,পরিচর্যায় ফুল,ফল ও নির্মল অক্সিজেন সবই মেলে।
হুমায়ুন নিজেকে স্বচ্ছল রেখে যে অঙ্গনে হাত দিয়েছেন সোনা ফলিয়েছেন। হুমায়ুন বৈরাগী নন,রীতিমত সংসার ধর্মে অন্তঃপ্রাণ একজন মানুষ। ছাত্র জীবনে হুমায়ুন ছিলেন মেধাবী। সন্তানদের মধ্যেও সে মেধার কমতি নেই। যারা ভাবি সাহিত্যিক মানেই ভাববাদী,তাঁর বাসস্থান নর্দমা ঘেঁরা কুঁড়ে ঘর,হুমায়ুন তাদের প্রশ্নোত্তর।
অতএব,সন্তান নজরুল না হোক, হুমায়ুন হতেও এখন আর বাঁধ থাকার কথা নয়।
তথ্য প্রযুক্তির এই যুগ বিশ্বকে নিয়ত ছোট করে আনছে একথা আমরা প্রায়ঃশ বলি। কিন্তু আমাদের পারিপার্শ্বিক অতি ক্ষুদ্রত্তম বিষয়ের মাঝেও যে এমন গুরু রহস্য রয়েছে তা কেউ উপলব্ধি করতে পারিনা। হুমায়ুন মানব চরিত্রের অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়কে রং রস মিশিয়ে এমন বর্ণিলভাবে উপস্থাপন করেছেন যে পাঠক-দর্শক অবলীলাক্রমে তা উপভোগ করেছেন। এটাই লেখকের স্বার্থকতা,সাহিত্যের ধর্ম।
প্রতিভার সঠিক সংজ্ঞা কি জানি না। তবে পরিশ্রম করলে ভাল ছাত্র হওয়া যায়। রাত জেগে পীথাগোরাস মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করা যায়, নতুন করে কি আরেকটা পীথাগোরাস তৈরী করা যায়। রবীন্দ্রনাথ,নজরুল,হুমায়ুন হওয়া যায় ? প্রতিভা এক অমূল্য ধন। যার কল্যাণে সোনার চামচ আর শত দারিদ্রতার মাঝেও জাতি পায় রবীন্দ্রনাথ,নজরুল,শরৎ চন্দ্র,মধুসূদন,সত্যেন্দ্রনাথ,শামসুর রহমান,হুমায়ুনদের।
ধনী-গরিব মাপকাঠি নয়,মাপকাঠি অন্তরাত্বার। প্রকৃতি যে গোলাপকে ফুটাবে তাকে আটকিয়ে রেখে সৌন্দর্যহানি করা যায়,প্রস্ফুটিত হওয়া থেকে বিরত রাখা যায় না। সৃষ্টিকর্তা যার মধ্যে যে প্রতিভা লুকিয়ে রেখেছেনে পরিচর্যা পেলে তা বিকশিত হবেই। আর সে প্রতিভার সাথে যদি মেধার সম্মিলন ঘটে। দিগন্ত বিস্তৃত করে জগৎকে আলোকিত করে তোলে।
এ রত্ন নিরুপণে বিশেষজ্ঞের অভাবও বৈকি। বলি ”বিদ্রোহী” কন্ঠস্থেই বেলা সায় ! নজরুলকে বল আরেকটা লিখে দিবে। এটাই প্রতিভার সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা।
অনাহুত অতিথি উঠানে দেখলে চলে যেতে বলতেও বুকে বাঁধে। কিন্তু যে সংসার আপন মমতায় গড়ে তোলা শেষ নিঃশ্বাসটা বের হয়ে গেলে নিথর দেহটাকে নিকটজন বা প্রতিবেশী কতক্ষণ আগলে ধরে রাখে ? জাতির ইতিহাস কখনও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে না।
কিছু না পেলে অন্তত খড়কুটা আগলে হলেও নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। নজরুল উত্তর সাহিত্য সেবকেরা বাংলাকে যে যতটুকু পারেন দিয়েছেন। কিন্তু হুমায়ূন দ্যুতিতে সবাই কেমন নিস্প্রভ,নিরাকার। যেদিকে যাই সবই হুমায়ূনময়। যেন নেপোলিয়নের প্রত্যাবর্তন।
এ নক্ষত্র বিদায়ে পুরো জাতি বিমর্ষ নির্বিকার। বিমানে কফিন বন্দি হুমায়ুন চির নিদ্রিত,জাতি নির্ঘুম সারা রাত। সুনসান নিরবতায় প্রকৃতির হাহাকার,অব্যক্ত বেদনা ঢুকরে কেঁদে উঠে হিমুদের চোখের জলে।
হুমায়ূনকে দেশে এনে সারারাত হিমঘরে রাখা হয় কেবল দাফন জনিত জটিলতায়। এখানেই চারটি কথা বলব।
প্রথমেই বলেছি হুমায়ূনেরা নিভৃতেই জন্মে। অসময়ে আজানের ধ্বনিতে হয়তো ক্ষণিক হতচকিত,পরে তা আদমশুমারীর ক্রমিক সংখ্যার ধারা বর্ণনায়। দুষ্ট শিশুর চঞ্চলতায় অতিষ্ট মা কুঁন্চি হাতে খুঁজে ফেরে গ্রামময়। আবার সন্ধ্যায় নাড়ী ছেঁড়া ধনের উষ্ঞতায় আপনকে মোহিত করে মা জনমকে স্বার্থক করে তোলে। বড় হয়ে যখন খুন্তি - কুড়াল নিয়ে নেমে পড়ে জীবিকার তাগিদে তখন সে পরিবারের সম্পদ।
কিন্তু জাতির অন্তরাত্বার টানে কখন সে নিজেকে হুমায়ূন করে তুলে জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়েছে হয়তো পরিবারও খেয়াল করেনি। নয়তো বিদায় বেলা এ সংকীর্ণতা কেন ? বলি প্রকৃতি বৃষ্টি বিলিয়ে ধরাকে কেবল শ্রাতই করে না,সাথে ঝড়ো হাওয়া বইয়ে অনেকের সাজানো বাগান তছনছও করে দিয়ে যায়।
শুনেছি ভালবাসার প্রেমিক-প্রেমিকাকে পাশাপাশি কবর দেওয়া হয়। একজন সুখী দম্পতির স্ত্রী আগে মারা গেলে স্বামী অছিয়ত করে যান তাকে যেন স্ত্রীর কবরের পাশে কবর দেওয়া হয়। কেউ কেউ বিড়ম্বনা এড়াতে আপন কবর নিজেই খুঁড়ে রেখে যান।
বিদেশে দূর্ঘটনায় মনিবের সাথে আদরের কুকুরটির মৃত্যু হলে দু’টিকে পাশাপাশি কবরস্থ করা হয় এমনটিও দেখা যায়। নুহাশ পল্লী হুমায়ুনের রক্তে মিশে ছিল। তাঁর যাবতীয় সৃষ্টি এই নুহাশ পল্লীকে ঘিরে। মানুষ যাকে ভালবাসে তাকে আপন করে পেতে চায়। সবসময় তার কাছে থাকতে চায় নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে।
মানুষ মারা যাবার পর নিথর দেহের কোন মূল্য থাকেনা। পাখি ছাড়া খাঁচা যেমন। প্রাণহীন মাটির দেহের মাটির সাথে মিশে যেতেও সময় লাগে না। অনেক দিন পর মাটির তলায় পলিথিন খুঁজে পাওয়া যায়,মানবদেহের কয়েকটি হাড়হাড্ডি ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। তবুও এই নশ্বর দেহের সাথে আত্বার আশ্চর্য মিল।
তাই জীবদ্দশায় কেউ যদি কোন জায়গাকে অছিহত করে যান এবং সেই সুযোগটা যদি তার প্রাপ্য হয় তবে তা পালন করা কি কর্তব্য নয় ? মিরপুর-বনানীতে সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা আছে। হুমায়ুনকে সেখানে সমাহিত করলে ভক্তকূল বা পরিবারের লোকদের শ্রদ্ধা জানাতে সুবিধা হয়। মানুষ মৃত ব্যক্তির কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তার বিদেহী আত্বার শান্তির জন্য দোয়া খায়ের করে,মোনাজাত করে। এ দোয়া কি দূর থেকে হয় না ? দয়াময় কি এতই বধির যে দূর থেকে দোয়া করলে তার কাছে পৌছে না ? জীবিত হুমায়ুনেরা জাতির জন্য এত করে। আর মারা গেলে সেই জাতির শ্রদ্ধা কুড়াতে তাদের মিরপুর-বনানীতে দৌড়াতে হবে ! বাঙ্গালী কি এতই কৃপণ ? হুমায়ুনের না হয় লিচুতলা ছিল।
যার কোন তলাই নেই তাঁকে জাতি কিভাবে শ্রদ্ধা জানাবে ?
শেষ শয্যায় হুমায়ুন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।