আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটন ছোটন ডাক পারি(মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একটি ছোট গল্প)

https://www.facebook.com/tanvir.mh ছোটনের আজ মন ভালো নেই। মাঠে খেলতে গিয়ে দেখে আজ সব বড় ভাইয়েরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এর জন্য রেডিও সামনে নিয়ে বসে আছে। আজ খেলা হবেনা। ছোটন চলে আসার জন্য প্রস্তুতি নিতেই খালিদ ভাই ডাক দিয়ে বসতে বলল। অবশেষে ভাষণ শুরু হল।

ছোটন খুব মনোযোগী হয়ে উঠলো। রেডিওর সাউন্ড বেশি ছিলোনা কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কথা যেন রেডিওর স্পীকার ফেটে বের হয়ে আসছে। “এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম” বলার সাথে সাথেই সবার মুখ দিয়ে জোরে বের হয়ে এলো “জয় বাংলা”। ছোটনের কাছে মনে হল সমস্থ কিশোরগঞ্জ যেন কেপে উঠলো এই ছোট গ্রাম এর কিছু স্বাধীনতাকামী মানুষের চিৎকারে। কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের ছোট একটি গ্রাম লক্ষ্মীপুর।

১৬ বছরের ছোটনের বাবা নেই। মা আর ছোটন মিলে তাদের ছোট একটা সংসার। তার বাসার পাশেই মাঠ। ছোটন ছোট হলে কি হবে খেলাধুলা করে এলাকার বড় ভাইদের সাথেই। কিন্তু ১মাস যাবত কোন ধরনের খেলা হচ্ছেনা।

খালিদ ভাই,কাকন ভাই বলে গেছে দেশ যেদিন স্বাধীন হবে সেদিন এই মাঠে আবার খেলা শুরু হবে। তারা এখন ব্যস্ত যুদ্ধে যেতে। কিছুদিন হল এলাকায় আশেপাশে পাকিস্তানীরা ঘুরাঘুরি করে। সাথে কিছু বাঙালী রাজাকার নিয়ে। খালিদ ভাইদের বাড়িতেও পাকিস্তানী আর্মি গেছে বলে শুনেছি।

কিন্তু তাদের কাউকে পায়নি। ছোটনের বন্ধু আবির একদিন রাতের বেলা হাপাতে হাপাতে এসে খবর দেয় “ব্রিজের নিচে খালিদ ভাই কাকন ভাই সহ ১২ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ”ছোটনের বিশ্বাস হচ্ছিলনা আবিরের কথা। তারা এভাবে মারা যাবে ভাবতে পারেনি সে। খালিদ ভাইকে কখনও হারতে দেখেনি ছোটন।

তিনি আমাদের কথা দিয়েছেন দেশ স্বাধীন করে আমরা আবার খেলবো,কিন্তু তিনি কিভাবে চলে গেলেন। -মা আমি বাইরে যাবো। খালিদ ভাইদের কে যেন মেরে ফেলেছে। -এত রাতে যেতে হবেনা। কালকে যাবি।

চোখের পানি মুছতে মুছতে মায়ের কথা না শুনেই বের হয়ে গেলো আবিরের সাথে। কিন্তু ব্রিজের পাশে গিয়ে একদল রাজাকার আর আর্মিকে দেখে আর সামনে যায়নি। শার্টের এক কোনা দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে আবির কে বলে যুদ্ধে যাওয়ার কথা। -কাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে আগরতলা যাব। তুই যাবি আমার সাথে? -তুই কি পাগল?তোকে কেউ যুদ্ধে নিবে।

-তুই যাবি কিনা বল। আমি রাস্তা চিনি। খালিদ ভাই আমাকে সব বলছিল তারা কিভাবে যাবে। এই দেশ স্বাধীন করেই ছাড়বো। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বাসায় ফিরে ছোটন।

কিন্তু মাকে বলার সাহস পায়না। মাকে কিভাবে বুঝাবে সে?মায়ের কাছে যে একমাত্র ছোটনই তার দুনিয়া। সারারাত জেগে থাকে। ভোর ৪.৩০ টার দিকে আবির আসে। মা তখনও ঘুমিয়ে।

মায়ের পাশে ছোট একটি চিঠি লিখে যায় ছোটন। “মা আমি খুব দ্রুত ফিরে আসবো। তুমি প্রেশারের ওষুধ ঠিকমতো খাবে। তোমার জন্য একটি স্বাধীন বাংলা নিয়ে তবেই ফিরবো। তুমি কিন্তু কান্না করতে পারবেনা।

তোমার ছেলে আজ সেই ছোট ছোটন নেই। তুমি কান্না করলে আমি ঠিকমতো লড়াই করতে পারবনা। তাহলে দেশ স্বাধীন হতে আরও দেরি হবে। ” সমস্থ দিন লেগে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেতেই। তখন প্রায় মাঝরাত।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নৌকা দিয়ে পালিয়ে আগরতলা। সেখানেই মুক্তিযুদ্ধাদের ট্রেনিং দেয়ার ক্যাম্প। নৌকায় উঠতেই চোখে পরে অনেক বয়সী লোক। কেউ ঘর বাড়িয়ে হারিয়ে জীবনে বেচে থাকার তাগিদে চলে যাচ্ছে। আর কেউ তীব্র তেজ নিয়ে দেশের জন্য লড়াই এর প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছে।

এক মা তার বাচ্চাকে তার কোলে নিয়ে খুব শক্ত করে জড়িয়ে আছে। একটা মা যত ভাবে তার বাচ্চাটাকে আগলে রাখতে পারে ততটুকুই করে যাচ্ছে। ছোটনের খুব মায়ের কথা মনে পড়লো। আমার মা থাকলেও আমাকে এভাবেই ধরে রাখতেন। কি করছেন আমার মা?মা খুব জানতে ইচ্ছে করছে তুমি কি প্রেশারের ওষুধ খেয়েছ কিনা? ৩০মিনিট নৌকা চলার হটাত থেমে যায়।

দূরে একটা ব্রিজ চোখে পরে মাঝির। ব্রিজের উপরে কয়েকজন মানুষ দাড়িয়ে। বুঝা যাচ্ছে রাজাকার বাহিনী। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হয় রাজাকারগুলি একটু সামনে গেলেই নৌকা ছাড়বে। সবাই যাতে চুপ থাকে।

নৌকায় ২০ থেকে ২৫ জন মানুষ। কিন্তু হটাত মায়ের কোলের ছোট বাচ্চাটি চিৎকার করা শুরু করে। মা তাকে কোনভাবেই চুপ করাতে পারছেনা। বুকের দুধও বাচ্চাটি খেতে চাইছেনা। যে বাচ্চাটির এখন একটি গরম বিছানায় ঘুমিয়ে থাকার কথা তার জন্য এই পরিবেশে অপ্রস্তুত লাগবেই।

বাচ্চাকে চুপ করার জন্য বাচ্চার মুখ চেপে ধরে মা। ছোটন বলে উঠে আমরা না হয় একটু পিছিয়ে যাই। বাচ্চাটি শান্ত হলে পরে রউনা করি। কিন্তু সবাই রেগে যায়। এক বাচ্চার জন্য ২৫ জন বিপদে পরবো নাকি?নৌকাটি ব্রিজের নিচ দিয়ে সফল ভাবেই যায়।

বাচ্চাটিও মায়ের কোলে আরাম করে শুয়ে ছিল। কিন্তু সে এখন আর কান্না করছেনা। কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে তার মা ও বলতে পারবেনা। যে ঘুমে গেলে কেউ আর কখনও চিৎকার করেনা। ২৫ জনের জীবন বাচাতে এই মা বিসর্জন দিয়েছেন নিজের আপন বাচ্চাটিকে।

ছোটনের মা তার ছেলের চিঠিটি হাতে নিয়ে এখন সারাদিন কাঁদে। চিঠিতে চোখের পানি পরলে তা আবার রোদে শোকাতে দেয়। মানসিকভাবে এখন তিনি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। ছেলের ইচ্ছা যাতে পূর্ণ হয় সেই প্রত্যাশায় স্কুলের মাঠটির দিকে চেয়ে থাকেন। এই মাঠ দিয়ে হেটে হেটে আমার সোনা ছোটন এসে বলবে মা আমি দেশ স্বাধীন করে এসেছি।

গ্রামের সবাই অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছে। কিন্তু ছোটনের মা কোথায় যাবেননা বলে পণ করেছেন। ছেলে আমাকে কোথায় খোঁজে পাবে আমি এখান থেকে চলে গেলে? বর্ডার পাড় হয়ে খুব ক্লান্ত অবস্থায় ক্যাম্পে পৌঁছে ছোটন আর আবির। কিন্তু সেখানকার মুক্তিকামী মানুষ কিছুতেই ছোটন আর আবিরকে ট্রেনিংএ নিচ্ছেনা। তাদের বয়স নাকি খুব কম।

ছোটন এত সহজে হেরে যাওয়ার ছেলে না। -আপনারা আমাদের নেন। আমাদের বন্ধুক দিতে হবেনা। আপানদের সাথে সাথে থেকেই না হয় বন্ধুকের গুলি নিয়ে ঘুরবো। -ভয় পাবেনা তো? -ভয় পেলে কি এত দূরে চলে আসি? -কেন আসছ এখানে? -ছোট বলে কি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন আমরা দেখতে পারিনা? দেশ স্বাধীন করতে আসছি।

পরাধীনতার শিকল খুলে ফেলতে চাই। অবশেষে তাদের নেয়া হয়। খুব দ্রুতই সব কিছু আয়ত্ত করে ফেলে ছোটন। কিন্তু আবির খুব কান্নাকাটি করে বাড়ি যেতে। -তুই চলে যা আবির।

-না যাবনা। তোর সাথে থাকবো। -তাহলে কান্নাকাটি করিস কেন? -তোর কাছ থেকে চলে গেলে তখনতো আরও বেশি কাঁদবোরে। হবিগঞ্জের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাক হানাদার বাহিনির ক্যাম্পে সফল আক্রমন করে মুক্তিযুদ্ধারা। পাক হানাদার বাহিনী পিছু হাটতে বাধ্য হয়।

ছোটন সেই স্পটে সবার নজরে আসে। ছোট একটি ছেলে কিন্তু কি অপরিসীম দক্ষতা নিয়ে বড়দের সাথে পাশাপাশি থেকে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। ছোটন এখন এক চৌকস যুদ্ধা। কিন্তু সে কিশোরগঞ্জ যেতে চায় এখন। সেখানের কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চায়।

তার ফাকে যদি মাকে একবার দেখে আসা যায়। কমান্ডারের কাছে এই সুপারিশ করার পর অনুমতি মিলে কিন্তু শুধু সুনামগঞ্জ এর এক ছোট অপারেশান শেষ করে তারপর যেতে বলে। ছোটন তাতেই খুশি হয় অনেক। সাথে আবির ও। আবির কে না নিয়ে আসলেই পারতাম।

আমার বন্ধু না হলে হয়তো আজ তাকে এত কষ্ট করতে হতোনা। যাই হোক একটু ছুটি তো মিলবে। তখন না হয় বন্ধুকে রেখে আসবো। সুনামগঞ্জের অপারেশানের পথে এখন নদী পাড় হচ্ছে তারা। ছোটন হাতে রাইফেল নিয়ে নৌকায় হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

আজ মনে হয় পূর্ণিমা। কিন্তু না চাঁদ তো পুরো হয়নি। এই সুন্দর চাঁদটা তাহলে আজ এত আলো দিচ্ছে কেন?আমরা যে স্বাধীন হতে চলেছি তা কি চাঁদটাও যেনে গেছে?আবির গেয়ে চলছে জীবন কাটে যুদ্ধ করে , প্রাণের মায়া সাঙ্গ করে, জীবনের স্বাদ নাহি পাই। ঘরবাড়ির ঠিকানা নাই, দিনরাত্রি জানা নাই, চলার সীমানা সঠিক নাই। জানি শুধু চলতে হবে, এ তরী বাইতে হবে, আমি যে সাগর মাঝি রে।

তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে। আমরা ক'জন নবীন মাঝি হাল ধরেছি, শক্ত করে রে। নদীর দূর পথে একটি স্টিমার চোখে পরে। যতটুকু অনুমান করা যায় এই স্টিমারে পাক হানাদার অনেক। তাদের উপর অতর্কিত আক্রমন করে পারা যাবেনা।

আগে থেকে যা প্ল্যান করা ছিল তা এখন পরিবর্তন করে সবাই কচুরিপানা মাথায় নিয়ে নদীর ধারে অবস্থান করছে। আর তাদের নৌকায় রেখে এসেছে কয়েকটি বোমা। তাদের নৌকাটি চোখে পরে পাক বাহিনির। স্টিমার থেকে ছোট নৌকা দিয়ে নেমে কয়েকজন তাদের নৌকার কাছে আসতেই নৌকায় রাখা বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয় দূর থেকে। নৌকা যারা দেখতে এসেছিল সবাই মারা পরে।

কিন্তু দূর স্টিমার থেকে পাক বাহিনী গোলাগুলি শুরু করে দেয়। আবির গুলিবিদ্ধ হয়। আবির কে কাধে নিয়ে পাশের এক স্কুলের বারান্দায় আশ্রয় নেয় ছোটন। আবির বারবার বলে তুই যা ছোটন তুই যা। আমার কথা ভাবিস না।

সবাই দৌড়াচ্ছে। আবির কে কাধে নিয়েই দৌড় শুরু করে ছোটন। পেছনে না তাকিয়েই দৌড়াতে থাকে। আকস্মিক একটি গুলি লেগে যায় ছোটনের পায়ে। আবিরকে ফেলে দিয়ে ছোটন ও পরে যায় মাটিতে।

চোখ দুটি খুলতে পারছেনা ছোটন। চারদিকে পাক বাহিনী ঘিরে ফেলেছে তাদের। চোখ একটু খুলতেই চোখের সামনে কয়েকটি বন্ধুকের নল দেখতে পারছে কিন্তু এত বন্ধুকের নলের থেকে সে তাকিয়ে আছে দূরে চাঁদের দিকে। চাঁদটি এখন আরও আলো ছড়াচ্ছে। টেনে হিঁচড়ে তাদের ২জন কে নিয়ে যায় পাকিস্তানী ক্যাম্পে।

আবির ততক্ষনে মারা গেছে। ছোটন চোখ খুলছেনা। চোখ বন্ধ রেখে সে তার মাকে দেখতে পারছে। মায়ের মুখ যখন সামনে আসছে তখন আর কোন কষ্টও হচ্ছেনা। মায়ের সাথে আনমনে কথা বলে যাচ্ছে।

“মা আমি আসছি,বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে তোমার বুকে আসছি। সমস্ত গ্রামে আমি বিজয় মিছিল বের করবো তুমিও থাকবে সেই মিছিলে,আচ্ছা মা তুমি প্রেশারের ওষুধ ঠিকমতো খেও। আমাদের সোনার বাংলা যেদিন স্বাধীন হবে সেদিন তুমি প্রেসার নিয়ে বাসায় শুয়ে থাকবে তা আমি চাইনা” ১৬ ডিসেম্বর,১৯৭১ ছোটনের কিশোরগঞ্জ আজ শত্রমুক্ত। তার প্রিয় স্কুলে উড়ছে লাল সবুজের পতাকা। মুক্তিযুদ্ধারা ঘরে ফিরছে।

ব্রিজের উপর ছোটনের মা তবজির ছড়াটা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। মিনিটে মিনিটে ছোটন ছোটন বলে ডেকে যাচ্ছে। কিন্তু ছোটন আর আসেনা। তানভীর মাহমুদুল হাসান ৪.১২.২০১২ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।