কিছু দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে এই জীবনে। ভ্রমণ আমার ভাল লাগে্ তাই সবার মাঝে তা জানাতে চাই। সবার উপরে ভালোবাসি বাংলাদেশ । ধন্যবাদ ইরাক থেকে কুর্দিস্থানে আসতে হলে ইরবিল শহরে আসতেই হবে। ইরবিল থেকে অন্য দুই প্রদেশ ডহুক ও সোলেমানিয়াতে যাওয়া যায়।
ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় কুর্দিস্থান বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। কারণ কুর্দিস্থানের সাথেই ছিল ইরানের সীমান্ত। প্রায় ৪ লক্ষ কুর্দি অধ্যুষিত কুর্দিস্থানে ২৫ লক্ষ মাইন ছড়ানো আছে। কুর্দিরা মুলত সুন্নি মুসলমান হলেও অন্য ধর্মের লোকজন ও এখানে আছে। খৃষ্টান কুর্দিরাও মুসলমানদের সাথে সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করে।
ইরবিলে খৃষ্টান অধ্যুষিত এলাকা এনকাওয়া, ইরবিল এয়ার ফিল্ডের কাছে শহরের এক প্রান্তে। এখানে তারা তাদের স্থায়ী আবাস নিয়ে আছে। বিধ্বস্থ কুর্দিস্থানে জাতিসংঘ ও অন্যান্য এনজিওর বহু আন্তর্জাতিক কর্তকর্তা ও কর্মচারী বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত ছিল। বেশিরভাগ বিদেশী সংস্থার লোকজন এই খৃষ্টান এলাকাকে নিরাপদ মনে করত এবং তাদের অফিস ও বাসাগুলো এখানেই ছিল। স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য এটা একটা বেশ ভাল অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
তারা তাদের বাসস্থান তুলনামুলক ভাবে বেশী দামে ভাড়া দিয়ে নিজেরা কোন ভাবে জীবন যাপন করত। কর্মসংস্থানহীন দুঃসময়ে এ ধরনের কষ্ট তারা হাসিমুখে সহ্য করত। দুর থেকেই এলাকাটাকে বেশ নিরাপদ বলে মনে হতো। এর ঢোকার পথ গুলোতে চেক পয়েন্ট ছিল। গাড়ী নিয়ে ঢুকতে হলে গাড়ীর নীচের দিকটা চেক করা হতো বোমা হামলার কথা ভেবে।
এলাকাতে ঢোকার জন্য একটা রাস্তা নির্দিষ্ট ছিল বাকী রাস্তাগুলো রোডব্লক দিয়ে বন্ধ ছিল। এতে এলাকাতে কারা ঢুকছে তা জানা যেত এবং হঠাৎ করে কেউ ঢুকতে পারত না। ইরবিল শহরে কিছুদিন থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম বলে এই জায়গাটার সম্পর্কে কিছু না লিখে থাকতে পারছিলাম না। বাসাগুলো প্রায় সবই একতলা থেকে তিনতলা। বেশীর ভাগ বাসাই দোতলা।
বাসার সাথে লাগোয়া ছোট ছোট দোকান। একসময় এগুলো হয়ত গ্যারেজ ছিল। এখন গাড়ী নেই বা চালাতে পারছেনা তাই গ্যারেজে অল্প কিছু জিনিষপত্র নিয়ে দোকান চালু করেছে। যাদের ২/৩ টা বাড়ী ছিল তারা ১ টার ভেতর এসে বাকীগুলো বিদেশীদের কাছে ভাড়া দিয়ে দিত। শোভানরা কুর্দি খৃষ্টান, আরবী ভাষা ও কুর্দি ভাষা জানে এবং তাদের নিজস্ব একটা ভাষাও আছে।
শোভান নিজে হাউজ কিপার এর কাজ করত। এতে তাদের নিজের বাড়ীটা দেখাশোনাও করা হতো এবং সাথে কিছু অর্থ উপার্জন। এই অর্থ তাদের পরিবারের জন্য বাড়তি সাহায্য হিসেবে কাজে লাগে। নব্বই এর দশকের মাঝামাঝি আন্তর্জাতিক অবরোধের কারণে কুর্দিস্থান সহ সারা ইরাকের সাধারণ জনগন অর্থনৈতিক চাপে ছিল। তাদের নিজস্ব রোজগারের পথগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
সাদ্দাম হোসেন বা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে ক্ষতির প্রভাব তেমন অনুভব করা না গেলেও সাধারণ ইরাকী জনগন এবং কুর্দিরা দুঃসহ জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছিল।
আমাদের পাশের বাড়ীতেই শোভান এর বাবা মা ভাই এর পরিবার ও বোনরা থাকত। মন্দার কারনে মেয়েদের উপযুক্ত পাত্র না পাওয়ায় বয়স পেরিয়ে গেলেও মেয়েরা বাপের বাড়ীতে অপেক্ষা করত উপযুক্ত পাত্রের জন্য। সামনের গ্যারেজে তারা মুদি দোকান চালাত মাঝে মাঝে ভাই কিংবা বাবা বসে বেচাকেনা দেখাশোনা করত। আশেপাশের বাড়ীগুলোর লোকজন এসব দোকান থেকেই কেনাকাটা করত।
দাম একটু বেশী হলেও হাতের নাগালের মধ্যে বলে কেউ দুরে যেত না ছোটখাট জিনিষের জন্য। বাসাটা ডুপ্লেক্স অন্যান্য বাড়ীগুলোর মতই। তবে সামনে খোলা জায়গা ও বাগান ছিল না। রুম গুলো বেশ আলোবাতাসে ভরা তবে টয়লেট অত্যধিক ছোট। বেশ কষ্ট হতো নাড়াচাড়া করতে।
বাড়ী বানানোর পর নাকি এরা জায়গা থাকলে কোনমতে টয়লেট বানায়। তবে গোসলখানা বেশ বড় ও আরামদায়ক ব্যবস্থা আছে। অনেক গোসলখানায় সনা বাথেরও ব্যবস্থা আছে। যুদ্ধের আগে শোভান পড়াশোনা করত। চাকুরীও পেয়ে যেত, দেশের অবস্থা স্বাভাবিক থাকলে।
দুর্ভাগ্য এখন সে বেকার। মাঝে মাঝে ওর মা বাড়ীতে কোন কাজের প্রয়োজন হলে তাকে ডেকে নিত।
সালারদের বাড়ী এর চেয়ে বেশ সুন্দর। উত্তর দিকে গেইট। সুন্দর বাউন্ডারী ওয়াল দিয়ে ঘেরা।
গেইট থেকে সোজা রাস্তা গ্যারেজে এসেছে। ডুপ্লেক্স বাড়ী। সামনে টানা বারান্দা। সামনের দরজা ব্যবহার কম হতো। কিচেন এর দরজা দিয়ে সবাই বাড়ীর ভেতরে যেত।
বাসার সামনে সবুজ লন ও বাগান। দেয়াল বরাবর অনেক গুলো নাসপাতি গাছ। সুন্দর সুন্দর ফল গুলো গাছে ধরে আছে। পাকার পর সাদা রং এর নাসপাতি গুলো অপূর্ব লাগে দেখতে। প্রথম দিকে নাসপাতি গুলো পেকে গেলে গাছ থেকে ঝরে পড়ত।
খাওয়ার লোকজন তেমন ছিল না। পরের দিকে অভাব বেড়ে যাওয়াতে ভোরবেলা আশে পাশের গরীব ছেলেমেয়েরা এসে বাসার ভেতর থেকে নিয়ে যেত।
দীর্ঘ প্রবাস জীবনের একঘেয়েমী কাটানোর জন্য আমরা সময় পেলেই নিজের বাসা ছেড়ে অন্য সেক্টরে বেড়াতে যেতাম। সবাই মজা পেত আড্ডা জমত ভালই। খৃষ্টান এনক্লেভের অনেক গুলো রাস্তাই নিরাপত্তার কারনে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
তবুও জীবন থেমে থাকেনি। ছোট ছোট শিশুর জন্ম বিয়ে সবই চলছিল তবে মনমরা ভাব ছিল সর্বত্র। হাসিমাখা মুখ গুলো ছিল অনেক ম্লান। বাচ্চাদের খেলার জন্য সুন্দর পার্ক ও আছে। পার্কে খেলার নানা জিনিষ।
তবে ঝলমলে ভাবটা দেখা যেত না। এক সময় সরকার থেকে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো। বর্তমানে তার অভাবে কেমন যেন ম্লান ভাব চলে এসেছে। এই এলাকা ছাড়িয়ে উত্তরে ইরবিল এয়ার ষ্ট্রিপ, পূর্বে একটু দুরে পাহাড়ী উপত্যকা। সেখানে কিছু গরীব কুর্দি বাস করে।
পশ্চিম দিকে ইরবিল শহর থেকে আসার রাস্তা টু ওয়ে মেটাল রোড। দক্ষিণে ফাঁকা এলাকা উচু নীচু এবং দুরে ইরবিল শহর। ইরবিল শহর ও বেশ পুরাতন। অবরোধ এর প্রভাবে এখানেও ম্লান ভাব। রাস্তা গুলো চওড়া।
ভক্স ওয়াগন পাসাত ট্যাক্সিতে ভরা। ট্যাক্সির রং সাদা কমলা। জোড়াতালি দিয়ে চলছে। ড্রাইভাররা অবাধ স্বাধীন, ট্রাফিক নিয়মের তোয়াক্কা বেশ কম তবুও অনেক ভাল। মাঝে মাঝে ওয়েলট্যাংকার, ট্রাক নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ নিয়ে যাচ্ছে।
যাত্রী পরিবহনের জন্য বাস এর সংখ্যা খুব কম। যাও আছে তা লক্কর ঝক্কর। বেশ চাপাচাপি ও ভীড় ঠেলে মানুষ চলাচল করে যদিও জনসংখ্যা খুবই কম। দুরপাল্লার বাস গুলো মার্সিডিজ ও ভলভো। তবে যাত্রী খুবই কম।
হাজার নিয়মনীতি ও পারমিট যোগাড় করে ইরাকে কিংবা অন্য প্রদেশে যেতে হয়। মানুষের জীবন আসলেই থেমে থেমে চলছিল। মনটা খারাপ হয়ে যেত এই ভেবে যে একসময় প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ দেশ কিভাবে তিলে তিলে দুঃখের যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল।
ইরবিলের নৈসর্গিক দৃশ্য
কুর্দিস্তানের ইরবিল প্রদেশে বহু পর্যটন কেন্দ্র আছে। পর্যটকের অভাবে এগুলো এখন কোন রকমে টিকে আছে অতীতের সাক্ষী হিসেবে।
তবে প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থান গুলো আবহমান কাল ধরে একই নিয়মে সবাইকে আনন্দ দিয়ে যাচ্ছে। ইরবিল থেকে ৩২ কিঃমিঃ দুরে সালাউদ্দিন এলাকার নয়নাভিরাম দৃশ্যকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল টুরিষ্ট ক্যাম্প। সালাউদ্দিনে এলে একদিকে পাহাড় ও অন্যদিকে বিশাল বিস্তৃত সমতল দেখা যায়। সাইপ্রেস ও ওক গাছে ভরা এই জায়গার আশেপাশের দৃশ্য অপূর্ব। এখানে টুরিষ্ট ভিলেজ, টুরিষ্ট এপার্টমেন্ট বানানো আছে।
আমরা সেদিকে না গিয়ে সাকলাওয়ার দিকে জীপে করে রওয়ানা হলাম। জনবসতিহীন ঘরবাড়ি দেখতে কারইবা ভাল লাগে। সালাউদ্দিন থেকে ১৮ কিঃমিঃ দুরে সাগর সমতল থেকে ৯৬৬ মিটার উচুতে মাউন্ট সাফিন এর ঢালে এক মনোরম রিসোর্ট আছে। এখানে প্রকৃতি অকৃপন হাতে ফলের বাগান ও অন্যান্য সৌন্দর্য দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে। এর থেকে একটু দুরে গেলেই গালি আলি বেগ প্রপাত।
গালি আলি বেগ প্রপাত
এটা মাউন্ট কোরাক ও মাউন্ট নওয়াথনিন এর মাঝের উপত্যকায় অবস্থিত এবং সাকলাওয়া থেকে ষাট কিলোমিটার দুরে। এসফল্টের সুন্দর রাস্তা ধরে আমরা সেখানে পৌছে গেলাম। বহু বছর মেরামতের অভাবে রাস্তা কিছুটা নষ্ট হলেও এখন ও চলার উপযোগী। মাঝে মাঝে কিছু বিপজ্জনক বাঁক থাকলেও তা তেমন মারাত্মক না। পাহাড় গুলো পাত্থরে এবং খাড়া তবে সবুজের ছেয়া আছে এই পাথরের মধ্যেও।
এখানের জলপ্রপাতটি প্রায় সাগর সমতল থেকে ৮০০ মিটার উচু। উচু থেকে পানির স্রোত ভূমিতে পড়ে আছে পাশের পাত্থরে এলাকায় ছড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ঠিক প্রপাতের নীচেই দর্শকদের জন্য ব্রিজের মত বানানো আছে। প্রপাতের অপূর্ব দৃশ্য এখান থেকে দেখা যায়।
এখানে রেষ্টুরেন্ট ও ক্যাসিনো আছে।
রেষ্টুরেন্টটা খোলা, চা বিস্কিট ও ক্যামেরার ফিল্ম বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনই এখন এখানে আসে কাসিনো পুরোপুরি বন্ধ। ইরাকের এই দুঃখের দিনে ক্যাসিনোতে কেউ কি আসবে ? স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা হলো, তারা টুরিষ্টদের থাকার জন্য ছোট ছোট কটেজ দেখিয়ে দিল। সুন্দর ব্যবস্থা। প্রপাতের কাছে বসার ব্যবস্থা আছে।
গাছের ছায়ায় বসে পারিবারিক পিকনিক চলছে। ক্যাসেট বাজছে পিকনিক পার্টির। শত দুঃখের মাঝেও আনন্দ করছে বেড়াতে আসা কুর্দি পরিবারগুলো। কিছু ছবি তুলে আমরা বৈকাল প্রপাত দেখতে রওয়ানা হলাম। বৈকাল প্রপাত রায়ানদুজ থেকে ১০ কিঃমিঃ দুরে।
মাউন্ট কোরাক থেকে রাস্তা দিয়ে এখানে আসা যায়। রাস্তাটা বেশ নতুন। এখানে জলপ্রপাতের দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। পাহাড়ের চূড়া থেকে ধাপ ভেঙ্গে ভেঙ্গে পানির প্রপাত পাহাড়ের তলদেশে এসেছে। পাত্থরে পাথার এবং এর চাতাল গুলোও পাথরের বড় বড় স্লাব আকৃতির।
পাহাড়ের গায়ে দেখার জন্য অবজারভেশন ডেক বানানো আছে ও তা লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। এখানে অনেক গাছপালার ছায়াঘেরা স্পট আছে। বৈকাল প্রপাতে পৌছাতে দুপুর হয়ে গেল। আমাদের সাথে খাবার ছিল। এখানেই লাঞ্চ খাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এখানেও ছোট রেষ্টুরেন্ট আছে। কোমল পানীয় নিলাম রেষ্টুরেন্ট থেকে। গাছের ছায়ায় প্রপাতের শব্দ ও সৌন্দর্যসুধা পান করতে করতে লাঞ্চ সারলাম। এই প্রপাতের পাশে ও ক্যাসিনো আছে এবং যথারীতি তা বন্ধ। দুপুরের খাবার পর ইরবিলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
যাওয়ার সময় দুটো খাড়া পাহাড়ের মাঝের সরু পথের দিকে দৃষ্টি আটকে গিয়ে ছিল। দুর থেকে মনে হচ্ছিল আকাশ ছোঁয়া একদম নব্বুই ডিগ্রী পাহাড়ের দেয়াল ভেদ করে কিভাবে যাব। কাছে এসে দেখলাম দু পাহাড়ের মাঝে সরু ফাঁক এবং এই ফাঁক দিয়েই রাস্তা চলে গেছে। ক্যামেরাতে পুরো পাহাড়টা আসে না তাই বেশ দুর থেকে খাড়া পাত্থরে পাহাড়ের মাঝদিয়ে বানানো রাস্তায় বসে ছবি তুললাম। পাহাড়ের গা ভেজা।
পাত্থরে শরীরে কোন আগাছা বা ঘাস জন্মানোর অবস্থা নেই। হালকা পানি পাত্থরে শরীর ভিজিয়ে রেখেছে। প্রকৃতি যেন নিখুত ভাবে এই পাত্থর কেটে বসিয়ে দিয়েছে ভূমির উপর। ছবি তোলা শেষ করে আবার যাত্রা শুরু। ইরবিলে পৌছাতে পৌছাতে বিকেল হয়ে গেল।
পেছনে ফেলে এলাম মনোরম সাজানো প্রকৃতির ছোয়া।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।