পৃথিবীর বাধা-এই দেহের ব্যাঘাতে/ হৃদয়ে বেদনা জমে;-স্বপনের হাতে/ আমি তাই/ আমারে তুলিয়া দিতে চাই। এ বছরের শুরুর দিকে এক বন্ধুর বিয়েতে ট্রেনে দিনাজপুর গিয়েছিলাম। যাওয়ার প্রাক্কালে হুমায়ূন আহমেদের একটি বই কিনে নিলাম কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে। ট্রেন জার্নিতে বই পড়তে মন্দ লাগে না। যাইহোক, ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথে বইটি পড়ার জন্য মন আকুপাকু করতে লাগল।
দ্রুত ব্যাগ থেকে কাগজে মোড়ানো বইটি খুলে পড়তে শুরু করলাম। হুমায়ূন আহমেদের বই এমনই। তাঁর বই হাতে আসামাত্র নিজেকে নেশাগ্রস্থের মত লাগে। না পড়া পর্যন্ত ভেতরে কেমন জানি এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করে। পড়া শেষ হওয়ামাত্রই এক পশলা বৃষ্টির মত শান্তির বাতাস ছুঁয়ে যায় হৃদয়ে।
বইটির নাম রঙপেন্সিল । গত বছর নিজের সর্বশেষ পালিত ৬৩তম জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশ হয় রঙপেন্সিল । সাদা ক্যানভাসে রঙপেন্সিল দিয়ে আকঁতে আকঁতে একসময় রঙপেন্সিল যেমন শেষ হয়ে যায়; বহুবর্ণিল জীবনের ক্যানভাসের অন্তিম পরিণতিও ঠিক রঙপেন্সিলের মতই হয়।
কাঁচামরিচ দিয়ে চা খাওয়ার পাগলামী তাঁর দেখাদেখি কত তরুণই না করেছে। আহ! কী যে স্বাদ।
কত অদ্ভুত কান্ডই না করেছেন তিনি। মৃত্যুর পূর্বেই নিজেকে কফিনবন্দি করে নিতে চেয়েছেন মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অমোঘ স্বাদ।
একটা প্রশ্ন বারবার মাথায় খুব ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুতেই কোন উত্তর মিলছে না। হুমায়ূন আহমেদ কী আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর সময় ফুরিয়ে আসছে?
জীবিতকালে হুমায়ূন আহমেদ নিজের শেষ গ্রন্থেরর নাম রেখেছিলেন রঙপেন্সিল।
শেষ জীবনে জীবনের-রঙপেন্সিলের অবিনশ্বরতার প্রতি তীব্র আগ্রহ জন্মেছিল তাঁর। অমরত্ব ছিল তাঁর শেষ আকাংক্ষা। এর অনুসন্ধানেও নেমেছিলেন তিনি।
রঙপেন্সিল-এর প্রথম পৃষ্ঠাতেই তাই মানুষের অমরত্ব নিয়ে কথা বলেছেন। নশ্বর জীবনের আক্ষেপ তাঁকে প্রচন্ড যন্ত্রণাবিদ্ধ করেছে।
রঙপেন্সিল-এ তিনি পিতার ফুফু সাফিয়া বিবির আড়ালে নিজের তীব্র জীবন-তৃষ্ণার কথাই বলে গেছেন। ।
-মরতে চাও না?
-কী বলেন? কেন মরব? অনেক কাইজ কাম বাকি আছে।
‘চোখে দেখেন না, নড়তে চড়তে পারেন না। দিন রাত বিছানায় শুয়ে থাকার কারণে পিঠে ‘বেডসোর’
(শয্যাক্ষত) হয়ে গেল।
পচা মাংসের গন্ধে কাছে যাওয়া যায় না। ’ গ্রামে প্রচলিত বিশ্বাস, তওবা পড়ানো হলে রোগীর মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। কিন্তু সাফিয়া বিবি পচনধরা শইল্যে পানি ছোঁয়ানো যাবে না এই অজুহাতে তওবা পড়তে রাজি হয় না। প্রিয় হুমায়ূন আরো কিছু মুহূর্ত জীবন চেয়েছিলেন-
‘গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে। ’ (জীবনানন্দ দাশ থেকে নিজেই উদ্ধৃত করেছিলেন)
আত্মমগ্ন হুমায়ূন ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন দিন দিন।
অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে এড়ানো সম্ভব নয় জেনেও তিনি ঘাটাঘাটি করেছেন অজস্র পুরাণ-মিথ-ইতিহাস ও জার্নাল। আশাবাদী হতে চেয়েছিলেন বারবার। বিজ্ঞানী হুমায়ূন শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানেই আস্থা রাখেন। আর একটু সময় পাওয়া জন্য তাঁর কী ভীষণ আক্ষেপ-
‘তারপর এ-কী! সত্যি কি মৃত্যুকে ঠেকানো যাচ্ছে? আমার হাতে টাইম পত্রিকার একটি সংখ্যা (ফেব্রুয়ারি ২১,২০১১); প্রচ্ছদ কাহিনীঃ 2045, The year Man Becomes Immortal. প্রচ্ছদ কাহিনী পড়ে জানলাম ২০৪৫ সালে মানুষ অমর হয়ে যাচ্ছে। ২০৪৫-এর কাছাকাছি মানুষ Singularity-তে পৌঁছাবে।
এর অর্থ এমন এক বিন্দু, যেখানে পদার্থবিদ্যার সাধারণ সূত্র কাজ করবে না। এর মানেই অমরত্ব। ইচ্ছামৃত্যু ছাড়া মৃত্যু নেই। ’
এই কথাগুলো বলার পরই জ্যোৎস্নাভুক হুমায়ূন স্বল্পায়ুর জন্য হাহাকার করে উঠেন-
২০৪৫ সাল পর্যন্ত আমি এমনিতেই টিকছি না। অমরত্ব পাওয়া এই জীবনে আর হলো না।
পৃথিবীতে ফিনিক ফোটা জোছনা আসবে। শ্রাবণ মাসে টিনের চালে বৃষ্টির সেতার বাজবে। সেই অপূর্ব অলৌকিক সংগীত শোনার জন্যে আমি থাকব না। কোন মানে হয়!!!’
প্রিয় হুমায়ূন,
তুমি ছিলে এ যুগের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। কৈশোরক সুপ্ত উন্মাদ-পনাকে উসকে দিয়ে তুমি-জেনে রেখো, হে উন্মাদকান্ডারী--
যে শহরে তুমি নেই, তুমি থাকবে না
সেখানে জীবন শূন্য চোরাবালি
অলি-গলি খুঁজে বেড়ায় তোমার মিসির আলী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।