আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

৭১ এবং উত্তর প্রজন্ম তথা তরুণ শিক্ষিত-সমাজ ও আলেম-সমাজ

লেখার চেয়ে পড়ায় আগ্রহী। ধার্মিক, পরমতসহিষ্ণু। কখনো আলোয়-আলোয়, কখনো মেঘে-মেঘে পেরিয়ে গেল চার দশকেরও অধিক সময়। আর মাত্র কয়টি বছর পরেই পালিত হবে বিজয়ের/ স্বাধীনতার সুবর্র্ণজয়ন্তী। ততদিনে আরো ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ এ বিশ্বে আমাদের অবস্থান কোথায় দাঁড়াবে, কেমন হবে? এখনই মাঝে মাঝে তা ভাবনায় হানা দেয়! এ প্রশ্নের উত্তর হয়ত নানা ভাবে হতে পারে এবং অবশ্যই নানা তথ্য-উপাত্তযুক্ত হয়ে, বিশ্লেষণঋদ্ধ হয়ে।

কিন্তু যেহেতু বিচারের নিরিখটা হবে স্বাধীনতা বা বিজয়-অর্জনকেন্দ্রিক, তাই স্বাধীনতাযুদ্ধ বিষয়ে যে-সব নেতিবাচক প্রবণতা আছে, তা থেকেও উত্তরণ ঘটাতে হবে, ঘটানোর প্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে। আর তখনই সফল হতে পারে এবং হবে বিজয়ের/ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। প্রথমে নিজেদের দোষের কথাই বলে নিই। আমরা যারা ‘একাত্তরের সপক্ষ শক্তি’ বলে দাবি করি, তাদের সকল কাজ-কর্ম-আচরণ সব-সময় যে দাবির সঙ্গে খাপ খায় নি বা খায় না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বরং সময়-সময় এমনসব র্কমকাণ্ডরে উদ্ভব ঘটেছে আমাদের এই পাকা হাতে, যা কাঁচা হাতকেও হার মানায়।

তাই চল্লিশ বছর পরে এদেশে এখনো শুভ্রকেশ কোনো আম মানুষের সাক্ষাৎ মিলতে পারে, স্বাধীনতার পূর্বাপর কোনো পার্থক্য খুঁজে পান নি বলে বেফাঁস (?) মন্তব্য যার মুখ থেকে অবলীলায় বেরিয়ে পড়ে। তারপরও মনে-প্রাণে যারা দেশের জন্য লড়েছেন, মনের গভীর থেকে এর জন্য তাড়না অনুভব করেছেন এবং করেন, তারাই আজ পর্যন্ত দেশকে ধরে রেখেছেন এবং এ পর্যন্ত টেনে এনেছেন। তাদের ধন্যবাদ দিতে হয় শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা রক্ষার চেয়েও যদি দেশকে উজ্জ্বল করার জন্য দূরদর্শী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন ও বাস্তবায়ন করতেন, তাহলে হয়ত আজ তারা ‘দেশনায়ক’ হিসাবে বন্দিত হতেন। তা হয় নি বলে কোনো দুঃখ নেই।

কারণ, তৃতীয়বিশ্ব নামের প্রান্তিক আয়ের দেশগুলো টিকে থাকে আম-জনতার শ্রমে ও সেবায়। এখানে এরাই ‘নায়ক’। কিন্তু দুঃখ হয় স্বাধীনতার চার দশক পরেও যখন তবে দুঃখ হয়, যখন দেখি, কেউ এ নিয়ে ব্যবসা করেন, আবার কেউ অর্জিত স্বাধীনতার ফল ভোগ করেও একে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন! স্বাধীনতা নিয়ে ব্যবসা করা অনৈতিক। কারণ, তা কারো বাপের তালুক নয়, বরং তা সাধারণ জনতার প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত অমূল্য সম্পদ। স্বাধীন দেশে সবার সুযোগ-সুবিধা হবে অভিন্ন, তা-ই তো স্বাভাবিক।

কেউ যদি নিজের সুবিধা বা প্রাপ্যটুকু নিতে সরকারের দরোজায় না আসে, তাহলে অধিকার ও স্বাভাবিকতার বলেই তা তার দরোজায় পৌঁছে যাবে, এ-ই হবার কথা ছিল। হয় নি। তবে যারা ব্যবসা করেন, তারা কিন্তু স্বাধীনতাটাকে মেনে এবং অন্তত মৌখিকভাবে হলেও এর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই করেন। মূল স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার যুদ্ধ নিয়ে এদের কোনো প্রশ্ন নেই। এর বিপরীতে যারা সুফলটুকু অবশ্যই ভোগ করেন, অথচ এ ব্যাপারে এখনো হীনমন্যতায় (?) ভোগেন, তাদের নৈতিক অবস্থানকে মূল্যায়ন করা যায় কীভাবে? হ্যাঁ, ‘তথাকথিত’ ধর্মীয় মানসিকতা ও ধর্মীয় রাজনৈতিক ঘরানার লোকদের কথা-ই বলছি, যারা একাত্তর-পর্বে বৃহত্তর বাঙালি মানুষের স্বার্থকে এড়িয়ে গেছেন, বিনাশ করেছেন বায়বীয় ধর্মাচ্ছন্নতায়।

তাদের মুখে-লেখায় এখনো মুসলিম উম্মাহ, মুসলিম মিল্লাত, ইসলাম, ইসলামী শরিয়া-সংবিধান ইত্যাদি শব্দাবলি শোনা যায়, পাওয়া যায়। কিন্তু তারা একাত্তর বিষয়ে প্রকাশ্যে সুষ্পষ্ট কোনো কিছু বলেন নি, বলেন না। এ-বিষয়ে একান্ত বন্ধু মহলে যারা নেতিবাচক মন্তব্য করেন, এমন অনেকই নিজেদের সন্তানের প্রশ্নের মুখে কোনো সদুত্তর দিতে পারেন নি। তাদের সেই-সব সন্তানদের মুখ থেকেই তা শোনা। তাই ধর্ম এবং নৈতিকতা- দুটোর দাবিই হল নিজের অবস্থানকে স্বচ্ছ ও সুষ্পষ্ট করা।

সে না হয় বোঝা যায় যে, এ সব প্রবীণরা ধর্মাচ্ছন্ন হয়ে একাত্তরে নৈতিক কোনো অবস্থান নিতে পারেন নি। তাই নিজের দোষকে চাপিয়ে রাখার জন্যই তাদের এই অসহিষ্ণুতা, কখনো অযৌক্তিক-অযাচিত কথাবার্তা, মন্তব্য ও আচরণ। কিন্তু যারা একাত্তর পরবর্তী বা উত্তর প্রজন্ম, তারা একাত্তর বিষয়ে পূর্বসূরীদেরকে অন্ধভাবে অনুসরণ করছেন কেন? পূর্বসূরী যদি জেনে-বুঝে হোক বা অসচেতনভাবেই হোক, কোনো অপরাধ করেন, সময়ের ডাকে সাড়া না দেন, এর দায়ভার কি পরবর্তী প্রজন্ম বহন করবে? হ্যাঁ, কেউ কেউ করতে পারেন এবং করছেনও। কিন্তু পিতার অপরাধকে যে-সন্তান অবলীলায় গর্বভরে প্রকাশ করে, মেনে নেয়, সে আর যাই হোক, বিবেকবান ও নীতিবান নয়, ধার্মিক তো নয়ই। কারণ, পৃথিবীর কোনো ধর্মে, কোনো নৈতিক শাস্ত্রে অপরাধের ওপর স্থির থাকার, অপরাধ করেও বাহাদুরি করার কথা বলা হয় নি।

তাই ধর্মপিতা (ধর্মীয় চর্চার নিরিখে যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ বা মান্য) বা ধর্মগুরুর কৃত অপরাধকে যারা এখনো নির্দ্বিধায় গ্রহণ করছেন, তারা নিজেদের মুখোমুখিই একবার দাঁড়াক। তখন নিতান্ত পামর না হলে অবশ্যই লজ্জিত হবে। ইতিহাসকে বড়জোর পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত চাপিয়ে রাখা যায়। তাই একাত্তর বিষয়ে আর গুটিকয় বছর পর থেকেই নিরপেক্ষ কথাগুলো বেরিয়ে আসতে থাকবে। তবে এত দূরে যাওয়ার বা এতদিন অপেক্ষা করারই বা দরকার কি? ১৬ ডিসেম্বর বা ২৬ মার্চ-এ প্রকাশিত পাকিস্তানের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও ব্লগে নজর দিলেই তা স্পষ্ট হয়ে পড়ে।

সেখানে পাকিস্তানি শাসকদের অবস্থান এবং আমাদের ধর্মপিতাদের যে বিশেষণে (?) গুণগান করা হয়, তাতেই সত্য প্রকাশ হয়ে পড়ে। পাকিস্তানের ভেতরে, বিশেষত তরুণ সমাজের মাঝে একাত্তর বিষয়ে সুষ্পষ্ট অবস্থান ও বক্তব্য রয়েছে। তারা সে সময়কার পাকিস্তানি অবস্থানকে সম্পূর্ণ অন্যায় ও অন্যায্য বলে স্বীকার করেন। তাহলে আমাদের দেশের একাত্তর পরবর্তী প্রজন্ম এ ব্যাপারে স্বচ্ছতার পরিচয় দিচ্ছেন না কেন? পরাজিত (বাস্তবতা, ধর্ম, বিবেক ও নৈতিকতার নিরিখে ) ধর্মপিতার অন্ধ অনুকরণ করে ধর্মপুত্র উপাধি লাভ করা যেতে পারে। কিন্তু আখেরে তাতে নিজের ধর্ম, ধার্মিকতা ও নৈতিকতার মানই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়।

একাত্তর পরবর্তী এদেশের তরুণ মুসলিম-সমাজ, তা মাদরাসা-পড়ুয়া হোক বা স্কুল-পড়ুয়া, তাদের সামনে রয়েছে মুক্তবিশ্বের অবারিত তথ্যাভাণ্ডার। অযৌক্তিক-অশাস্ত্রীয়ভাবে কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নয়, আচ্ছন্ন হয়েও নয়, নিজেরাই পড়ুন নিজেদের ইতিহাস। আর প্রশ্ন করুন, মূল্যায়ন করুন। নিজেদের পূর্বসূরীদের অবস্থান ও ব্যাখ্যাকে বিশ্লেষণ করুন: পূর্বাপর ইতিহাসের নিরিখে, ধর্মের আলোকে, বিবেকের নির্দেশনায়। নিজ দেশে, নিজ সমাজে এবং বিপুলা এ ধরণীতে নিজের অবস্থানটুকু খুঁজে নিন।

কারো মুখস্থ ও গৎবাঁধা ইতিহাস নয়, কোনো কান কথাও নয়; বরং সত্য-উদ্ঘাটনের দুর্মর দুঃসাহস নিয়ে এগিয়ে আসুন। এটা আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য। হ্যাঁ, সত্য অনেক কঠিন। এ সত্য মেনে নিলে নিজের পিতার অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে, এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়। যাকে বিবেকের প্রতিনিধি মনে হয়, নিষ্কলুষ ধর্মের অনুসারী মনে হয়, তিনি তখন বিবেককে দলিত করেছেন, স্বচ্ছ-সুন্দর ধর্মের ঠিকাদারি কোনো কুলাঙ্গারকে দিয়েছেন, তা মানতে আবেগে সায় দেয় না।

তা হতেই পারে। কারণ, দীর্ঘদিনের শ্রদ্ধার আবরণে মেশা এই আবেগ, সাথে রয়েছে ধর্মের মিশেল। তাই জটলিতা। কিন্তু আবেগের দ্বারা তো বাস্তবতাকে ঢেকে রাখা যায় না। যারা সেই সময় সত্যকে দলন করেছেন, আজ তারা প্রশ্নের মুখোমুখি, ইতিহাসের বাস্তবতার মুখোমুখি।

অনুসারী হিসাবে উত্তর প্রজন্মও যদি এখন সত্যকে এড়িয়ে যান, তাহলে তারাও ক্ষমা পাবেন না। কারণ, সত্য স্বয়ংপ্রকাশ। সুতরাং বিবেচনার পথ খোলা। আর যে-সব তরুণ একাত্তর-নিবেদিত, একাত্তরের সত্যে আস্থাবান-নিষ্ঠাবান, তাদের আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। আরো কর্মদক্ষ ও কৌশলী হতে হবে।

দেশকে সেই অভিষ্ট লক্ষ্যে কীভাবে পৌঁছুনো যায়, যার জন্য বয়ে গেল বিপুল এক রক্তবন্যা, সে নিরিখে কাজ করতে হবে। দেশের প্রতি আস্থাবান সে-সব তরুণদেরকে আরো নৈতিক হতে হবে। নিজের এবং অন্যের অধিকার সম্পর্কে আরো সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে। তখনই দেশের স্বাধীনতা অর্থবহ হওয়ার আবহ তৈরি হবে, দেশ এগিয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, যে-সব তরুণ-বৃদ্ধ এখনো একাত্তরের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবাপন্ন, তাদের নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।

সকল কলহ,বিবাদ-বিসম্বাদ এড়িয়ে প্রয়োজন শুধু দেশগড়ায় মনোনিবেশ করা। একাত্তরে যারা পতিত-পরাজিত হয়েছে, সামনে যদি দেশটা আরো সফল হয়, আরো এগিয়ে যায়, তাহলে এরা আবারও পতিত ও পরাজিত হবে। সে-সময়টা যেন সুবর্ণজয়ন্তীর আগে-আগেই হয়, এই প্রতাশায়... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।