নিশ্চিন্তপুর ট্র্যাজেডি : যেসব সমস্যার সমাধান জরুরি
ফকির ইলিয়াস
=======================================
চারদিকে কথার ফুলঝুরি। টেলিভিশনে টকশো। জাতীয় শোক। পত্রপত্রিকায় কড়া ভাষার কলাম। আমিও লিখছি।
আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের ভয়াবহ অগ্নিকা-ে একশত বারোজনের প্রাণহানি ঘটেছে। এ সংখ্যা বাড়তে পারে। কী মর্মান্তিক দৃশ্যাবলি। যারা প্রাণ দিয়েছে, এরা নিতান্তই দরিদ্র মানুষ। সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষ।
বাংলাদেশে গার্মেন্টস পুড়ে যাবার ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও হয়েছে। এবার মৃত্যু সংখ্যা অতীতকে ছাড়িয়ে গেছে। কেন এমনটি হয়েছে, তার কোনো জবাব নেই। অথচ জবাব থাকা দরকার।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সঞ্চালক মূলত তিনটি শক্তি। প্রবাসী কিংবা অভিবাসী শ্রমশক্তি, গার্মেন্টস শ্রমিক এবং শিল্প আর কৃষক বা কৃষিশক্তি। এই অগ্রহায়ণ মাসে বাম্পার ফলন হয়েছে, খবর আসছে মিডিয়ায়। এ বছর বিদেশ থেকে দেশে যাবে ১৪০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। আর গার্মেন্টস শিল্পের চাকার কথা তো সর্বজনস্বীকৃত।
ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় দেশগুলোতে এখন বাংলাদেশের গার্মেন্টস প্রোডাক্টস শোভা পাচ্ছে তাকে তাকে। এটা দেশের জন্য শুভ সংবাদ। কিন্তু কী এক অশনি সংকেত যে গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে! গেলো কয়েক বছরে বিভিন্ন গার্মেন্টসে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। হতাহত হয়েছে। তারপরও এই বিষয়ে জোরালো কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি।
শিল্প পুলিশ গঠন করে গার্মেন্টস শিল্পের ভেতরের নৈরাজ্য বন্ধের চেষ্টা করা হলেও গার্মেন্টস শিল্পকে চিরতরে ধ্বংসের দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক কোনো ষড়যন্ত্র হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে বিভিন্ন সময়ের সরকার থেকেছে নির্বিকার।
নিশ্চিন্তপুর ট্র্যাজেডির পর জাতীয় সংসদে বক্তব্য রেখেছেন শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি বলেছেন, পুলিশের ওপর দেশের বিভিন্ন স্থানে আক্রমণের পর ষড়যন্ত্রমূলকভাবে গার্মেন্টসে আগুন দেয়া হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখবে সরকার। এর পরপরই একটি গার্মেন্টসে দেশলাই জ্বালিয়ে আগুন দেয়ার প্রচেষ্টাকালে ধরা পড়েছে সুমি বেগম নামের এক শ্রমিক। সে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে মাত্র বিশ হাজার টাকা লাভের আশায় সে আগুন লাগাতে চেয়েছিল।
তাহলে দেখা যাচ্ছে একটি চক্র এভাবে সুমি বেগমদের দিয়ে দেশের গার্মেন্টসগুলো ধ্বংসের কাজে সরাসরি লিপ্ত রয়েছে। এরা কারা? কী তাদের পরিচয়? এরা কী কোনো রাজনীতিকের ভাইপো-বোনঝি? এরা কী কোনো মন্ত্রীর শ্যালক? এরা কী কোনো এমপির দুলাভাই? এরা কী কোনো কোনো শীর্ষ ক্ষমতাবানের আত্মীয়স্বজন? না কী এরা রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতিপক্ষ? বিষয়টি বিবেচনায় আনা দরকার। স্পষ্ট করা দরকার কিছু ব্যক্তির হীনস্বার্থের কাছে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং ষোল কোটি মানুষ এভাবে জিম্মি থাকতে পারে কিনা! থাকা উচিত কিনা! নিশ্চিন্তপুরের এই ট্র্যাজেডির জন্য দায়ী কে বা কারা, তা খোঁজা খুবই জরুরি দরকার। ঐ গার্মেন্টসে ফায়ার এলার্ম বেজে ওঠার পরও শ্রমিকদের বের হতে দেয়া হয়নি কেন? কারা বাইরে তালাবদ্ধ করে রেখেছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর দরকার।
নয়তলার যে ভবনটিতে আগুন লেগেছিল, তাতে জরুরি ফায়ার এক্সিট ছিল কিনা, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খুঁজে দেখা দরকার।
যে প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার লোক কাজ করবে, তাদের নিরাপত্তা অবশ্যই প্রথম প্রায়োরিটি থাকা দরকার। কারণ ভয় মনে নিয়ে কোনো শ্রমিক সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারে না। একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট, গার্মেন্টস শিল্পে বাংলাদেশ যখন বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশই সে কাজটি করতে পারছে না। তাই হিংসা-বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে কেউ এমন নাশকতা করাচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা খুবই দরকারি বিষয়।
বাংলাদেশে শ্রমের মর্যাদা যথাযথভাবে দেয়া হচ্ছে না।
এই অভিযোগ নতুন নয়। নিশ্চিন্তপুরের আগুনযজ্ঞের পরই ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মি. ড্যান মজিনা বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস আমদানি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
মনে রাখা দরকার বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একটি বড় ক্রেতা। যদি যুক্তরাষ্ট্র ক্রমশ মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে মার্কিনি মিত্র বন্ধুরাও পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়বে।
এতে বাংলাদেশ, বিশ্বে হারাবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্টসের বাজার।
তাই বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পকে বাঁচাতে কিছু জরুরি উদ্যোগ নেয়া দরকার। এ বিষয়ে আমি কিছু প্রস্তাবনা রাখতে চাই।
এক. প্রতিটি গার্মেন্টস স্থাপনায় কর্মীদের কাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। ফায়ার এলার্ম, ফায়ার এক্সিট, নিয়মিত চেক করা হোক।
সরু কিংবা গলির মাঝে যারা ব্যবসা ফেঁদে বসেছে, তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হোক অথবা অন্য বড় স্থানে স্থানান্তরের তাগিদ দেয়া হোক।
দুই. কেউ ব্যাংকের লোন, বায়ারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ আত্মসাতের মতলবে ব্যবসা ফাঁদছে কিনা তা নিয়মিত মনিটর করা হোক। বস্ত্র মন্ত্রণালয় এবং রপ্তানি ব্যুরোর সমন্বয়ে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করে দুর্নীতিবাজদের শায়েস্তার ব্যবস্থা করা হোক। ঋণখেলাপিদের ব্যবসা সরকারি হেফাজতে নিয়ে নিলাম অথবা জব্দ করা হোক।
তিন. গার্মেন্টস শ্রমিকের ন্যায্য বেতন সময়মতো পরিশোধ করা হোক।
বোনাস, ভাতা এমনকি পোশাক আইটেম নির্মাণের কোয়ান্টিটির ওপর নির্ভর করে ‘অনুপ্রেরণা কমিশন’ দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক। যা বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রয়েছে। যেমন- চায়নার একজন গার্মেন্টস শ্রমিক তার দৈনিক মজুরির বাইরেও পিস প্রতি সামান্য হারে হলেও কমিশন পেয়ে থাকেন। যা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রোডাকশন প্রতিষ্ঠানও চালু করেছে। বাংলাদেশে গার্মেন্টস সেক্টরের সত্যিকার উন্নয়ন চাইলে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নেয়া দরকার।
চার. দেশী-বিদেশী যে কোনো চক্রই এই সেক্টরকে ধ্বংস করার চেষ্টা করুক না কেন, তা দমন করতে হবে কঠোর হাতে। শুধু শিল্প পুলিশই নয়, প্রয়োজনে অভ্যন্তরীণ সিকিউরিটি নিয়োগ করতে হবে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, শ্রমিকরা যদি তাদের ন্যায্য পাওনা পায় তবে অনেকাংশেই কমে যাবে সকল প্রকার অনিশ্চয়তা। কেউ বিলিয়ন ডলার কামাবে, আর কেউ তার ন্যায্য কানাকড়িও পাবে না- তা হতে পারে না। যে শোক বহন করেছে জাতি, তার অবসান দরকার।
তাজরীন ফ্যাশনের এই মর্মান্তিক ঘটনা থেকে সবার শিক্ষা নেয়া দরকার। জাতির অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে ঐক্যের বিকল্প নেই। নাশকতা যারা করতে চাইবে এরা জাতির শত্রু। আর যদি কোনো রাজনৈতিক দল এদের পৃষ্ঠপোষক হয় তবে এরা জাতীয় শত্রু। অন্যদিকে যারা ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে দুর্নীতিবাজদের সহচর হবে, নজর রাখতে হবে তাদের প্রতিও।
২৮ নভেম্বর, ২০১২
-----------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ/ ঢাকা / ১ ডিসেম্বর ২০১২ শনিবার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।