লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। সুপারম্যানের রুটিন
মোহাম্মদ ইসহাক খান
সকাল ৬.০০- গাত্রোত্থান
সকাল ৬.০০- ৬.১৫- প্রাতঃকৃত্য
সকাল ৬.১৫- ৬.৩০- প্রাতরাশ
সকাল ৬.৩০- দুপুর ১.০০- অধ্যয়ন
দুপুর ১.০০- ১.৩০- স্নান, মধ্যাহ্নভোজন
দুপুর ১.৩০- বিকেল ৫.৩০- অধ্যয়ন
বিকেল ৫.৩০- ৫.৪৫- সান্ধ্যকালীন আহার
সন্ধ্যা ৫.৪৫- রাত ১০.০০- অধ্যয়ন
রাত ১০.০০- ১০.৩০- নৈশভোজ, টিভি দেখা (শুধুমাত্র শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান)
রাত ১০.৩০- ২.০০- অধ্যয়ন
রাত ২.০০- শয্যাগমন
রাত ২.০০- সকাল ৬.০০- নিদ্রা
হুম, কাগজে লেখা নিজের দৈনিক কর্মকাণ্ডের রুটিনটা দেখে বেশ সন্তুষ্টচিত্তে বলল নয়ন। তাহলে আমার দাঁড়াচ্ছে দৈনিক ১৮ ঘণ্টা ১৫ মিনিট লেখাপড়া, চার ঘণ্টা ঘুম আর বাকি এক ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট অন্যান্য কাজ।
একটু কম হয়ে যাচ্ছে লেখাপড়ার দিকটা, নয়নের ইচ্ছে ছিল এটাকে বিশ ঘণ্টায় নিয়ে যাবার, কিন্তু কিছুতেই সেটা করা গেলো না, সময়ে টান পড়ে গেলো। আফসোস, দিন মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার, এটা তিরিশ কিংবা বত্রিশ ঘণ্টার হলে তার বেশ সুবিধা হতো।
স্কচটেপ দিয়ে সে দেয়ালে রুটিনটা সেঁটে দেয়। আজ থেকে সে এই রুটিন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবে। একটুও এদিক-ওদিক করা চলবে না।
আজ থেকে তার ধ্যানজ্ঞান হবে শুধু তিনটি জিনিস, লেখাপড়া, লেখাপড়া আর লেখাপড়া। রুটিনে "অধ্যয়ন" শব্দটি লাল কালি দিয়ে লেখা, বাকিগুলো সবুজ কালি দিয়ে। খানিকটা বিনোদনের বাপারও রাখা হয়েছে, রাতে পনেরো মিনিট টিভিতে "শিক্ষামূলক" অনুষ্ঠান দেখা। কাল সকাল ছ'টা থেকে এই রুটিন কার্যকরী হবে।
রাত অনেক হয়েছে।
সে মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমোতে গেলো। মা'কেও বলে দিয়েছে যেন কাঁটায় কাঁটায় ওকে সকাল ছ'টায় ডেকে দেয়া হয়।
দু'চোখ বন্ধ করেছে মাত্র, তখনই মা ডেকে তুললেন তাকে। এই নয়ন, ওঠ্। ছটা বেজে গেছে।
সে কী? আমি তো এইমাত্র ঘুমোলাম। ধড়মড় করে উঠে বসে সে, দেখে কী করে যেন পনেরো মিনিটেই পাঁচ ঘণ্টা চলে গেছে, কাল রাত একটায় ঘুমিয়েছে সে।
শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে সে এপাশ-ওপাশ করে, ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করে। যখন সে উঠে ঠিকমতো বসতে পারলো, তখন পুরো দশ মিনিট চলে গেছে।
বাথরুমে ছুট লাগাল সে।
কিছুতেই ঘড়ির পেছনে পড়া চলবে না, সময়ের কাজ সময়ে সারতে হবে।
রোজ আরও দেরী করে ওঠে সে, কাজেই শরীর সেটার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছিল। আজ হঠাৎ ভোরবেলায় উঠে যখন সে প্রাতঃকৃত্য সারতে গেলো তখন দেখল যে শরীর সাড়া দিচ্ছেনা। অভ্যাস বড় ভয়ংকর ব্যাপার, পরিবর্তন করে ফেলা মুখের কথা নয়। এদিকে প্রাতঃকৃত্যের নির্ধারিত সময় চলে যাচ্ছে, নয়ন কোনমতে কাজ সেরে বেরিয়ে এলো।
মা'কে আগে থেকেই হুমকি দিয়ে রেখেছিল সে, যেন সকাল সোয়া ছ'টায় তার খাবার টেবিলে রেডি থাকে, নইলে বাসায় লঙ্কাকাণ্ড হয়ে যাবে, কাজেই মা রুটি আর ডিম তৈরি করে রেখেছেন। ধোঁয়া ওঠা নাস্তা সে কোনমতে নাকেমুখে গুঁজতে লাগলো এবং প্রত্যাশিতভাবেই মুখ পুড়িয়ে ফেলল।
মুখ ধুয়ে যখন সে পড়ার টেবিলে এসে বসলো, তখন বাজে পৌনে সাতটা, অর্থাৎ পনেরো মিনিট দেরী হয়েছে। সে তাড়াতাড়ি বই খুলে বসে পড়ে। সময়টাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে, একটা মুহূর্তও ফেলনা নয়।
সে এক ঘণ্টা পড়তে না পড়তেই হাই ওঠে, দুচোখ আবার ঘুমে জড়িয়ে আসে, মাথা ঠেকে যায় টেবিলে, শরীর ভারী হয়ে যায়, কিন্তু সে নিজের সাথে লড়াই করে আবার সোজা হয়ে বসে। মনে মনে নিজেকে বলে, তোমাকে পারতেই হবে নয়ন, তোমাকে পারতেই হবে।
দুপুর একটা পর্যন্ত সে বই নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে রইলো, অনেক কিছু শেষ করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তার সিকিভাগও হল না। মাথাটা কেমন যেন ঠিকমতো কাজ করছে না, কিছু মনে থাকছে না, অংকগুলো মিলছে না, মাথার বাঁ পাশটা প্রচণ্ড ব্যথা করছে, মনে হচ্ছে এখুনি খুলিটা ফেটে চৌচির হয়ে গিয়ে ঘিলু বেরিয়ে আসবে।
নয়ন তবুও ক্ষান্ত দিলো না।
তার শরীর বিট্রে করছে, কিন্তু সে নিজেকে পড়ার টেবিলে প্রায় বেঁধে রাখল, একটা বাজার পর এমন একটা আরাম পেলো যে বলার মতো নয়। বাথরুমে গিয়ে "স্নান" করলো সে, মাথা ব্যথা কমাবার জন্য মাথায় অনেক মগ পানি ঢেলে ফেললো। গোসলের জন্য বরাদ্দ সময় মাত্র পনেরো মিনিট, কাজেই গায়ে ভালোমতো সাবান লাগানো হল না, গা ঠিকমতো মোছা হল না, সে সোয়া একটায় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। মা খাবার দিয়ে রেখেছিলেন টেবিলে, সে গোগ্রাসে গিলতে থাকে। পড়া ঠিকমতো হয়নি, বলা যায় প্রথম সেশনে খুব ধরা খেয়েছে সে, পরের খেপে সব পুষিয়ে নিতে হবে।
যখন দুপুর দেড়টায় গিয়ে সে আবার পড়ার টেবিলে বসলো, তখন দুপুরের খাওয়ার দরুণ শরীরটা খুব ভারী ঠেকল তার, ভাবল, দশ মিনিটের "পাওয়ার ন্যাপ" নিয়ে নিলে কেমন হয়? বোধহয় শরীরটা ঝরঝরে হবে আর নতুন উদ্যমে পড়ালেখা করা যাবে। সে বিছানায় গিয়ে গড়িয়ে পড়লো, অবশ্যই দশ মিনিট পর অ্যালার্ম দিয়ে।
অ্যালার্ম সময়মতই বাজলো, কিন্তু নয়ন মড়ার মতো তখন ঘুমোচ্ছে, তীক্ষ্ণ আওয়াজ তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করলেও তাকে জাগাতে সক্ষম হল না।
যখন সে চমকে জেগে উঠলো তখন আধঘণ্টা কেটে গেছে, চোখে তখনো রাজ্যের ঘুম। মূল্যবান সময়ের নিদারুণ অপচয় হয়েছে বলে সে নিজেকেই গাল দিলো, শরীরটা টেনে নিয়ে গিয়ে ফেললো টেবিলে, আবার পড়া শুরু করলো।
বাইরে থেকে তাকে দেখে যে কেউ বলবে যে সে ঠিক জেগে নেই, একটা ঘোরের মধ্যে আছে।
পড়তে বসে সে খুব হতাশ হয়ে লক্ষ করলো, সকালের মতোই হচ্ছে তার, কিছুই মাথায় ঢুকছে না, আবোলতাবোল ঠেকছে সব। নতুন উপসর্গ যোগ হয়েছে, বইয়ের ছাপা লেখাগুলো কেমন ঝাপসা ঠেকছে। শ্রান্ত নয়নের চোয়াল ভেঙে হাই উঠতে থাকে একটার পর একটা, কিন্তু নয়ন জোর করে পড়াগুলো মাথায় ঢোকানোর চেষ্টা করে। বলা বাহুল্য, মস্তিষ্ক স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না, ছিল ভীষণ ক্লান্ত, কাজেই নয়নকে সে কোনরকম সাহায্য করলো না।
পড়ার মাঝখানে একবার ওর ফোনটা বেজে ওঠে। নয়নের বন্ধু ফেরদৌস। আজ বিকেলে ক্রিকেট ম্যাচ ছিল ওদের, নয়নের যাবার কথা। কিন্তু নয়নের খেলতে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না, সে তার রুটিনের সাথে তাল মিলিয়ে চলার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কাজেই সে ফোনটা কেটে দিলো আর সাইলেন্ট করে রাখল, যাতে আর কেউ ডিস্টার্ব করতে না পারে।
ফেরদৌস বেশি একটা বিরক্ত করে না, সে একটা মেসেজ পাঠিয়েই ক্ষান্ত দেয়। মেসেজ পড়ারও প্রয়োজন বোধ করলো না নয়ন, খামোকা সময় নষ্ট।
নয়ন একবার দেয়ালে সাঁটা রুটিনটার দিকে তাকায়, আবার তাকায় ঘড়ির দিকে। এত ধীরে চলছে কেন ঘড়ি? পড়ার সময়টা ফুরোলে যেন নয়ন বেঁচে যায়। ঘড়ির কাঁটাটা যেন নড়ছে না, থেমে আছে।
এক-একবার চোখে ধান্দা দেখতে লাগলো নয়ন, যেন ঘড়ির মিনিটের কাঁটাটা উল্টো দিকে চলেছে!
নয়ন আবার নিজের পড়ায় মন বসানোর চেষ্টা করে।
বিকেল হয়েছে, তার ছোটভাই স্কুল থেকে ফিরে এসে কার্টুন দেখছে টিভিতে। টম জেরিকে ধাওয়া করছে, সেই ধাওয়ার শব্দ যাতে কানে না আসে, সেজন্য সে ঘরের দরজাটা টেনে দেয়।
মা একবার এই ঘরে এসেছিলেন, সে বেশ কড়া স্বরে মা'কে জানিয়ে দিয়েছে যে তাকে একদম বিরক্ত করা চলবে না। কাজেই কেউ আর এই ঘরে আসছে না।
বিকেল সাড়ে পাঁচটা যখন বাজলো, তখন ইচ্ছে হল খুশিতে লাফাতে। পরের পনেরো মিনিটে নয়নের মনে হল, কেউ যেন একটা গরম কড়াই থেকে তাকে তুলে নিয়ে খুব আরামদায়ক ঠাণ্ডা একটা জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে।
বিকেল পৌনে ছ'টায় যখন নয়ন আবার পড়ার টেবিলে "অধ্যয়নের" জন্য ফিরে গেলো, তখন তার চেহারার দিকে তাকালে নির্ঘাত সবার মায়া লাগতো।
নয়নের খুব মাথা ব্যথা করছে, সকালে বাঁ পাশে ছিল, এখন পুরো মাথা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ব্যথাটা। কাঁহাতক আর এভাবে পড়া যায়, শরীর আর মগজের সহ্যের তো একটা সীমা আছে।
নয়ন দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে যেতে থাকে, নিজেকেই ধমক দেয়, মাত্র আঠারো ঘণ্টা পড়াতেই এই অবস্থা? একজন ছাত্রের মনোভাব এমন হবে কেন? সে তো খুশি হয়ে আরও কয়েক ঘণ্টা বাড়তি পড়ে ফেলবে। তবে কি সে ভাল ছাত্র নয়?
মনে যে একটু আক্ষেপ আসেনি তা নয়। বিকেলে নিশ্চয়ই ওরা সবাই চুটিয়ে খেলেছে, যাওয়া হল না, খেলাও হল না। যাক গে। ভাল ছাত্র হতে হলে সব বিসর্জন দিতে হয়, প্রয়োজনে নাওয়াখাওয়া, ঘুম- এসবও।
সামান্য ক্রিকেট খেলার জন্য এত মন খারাপ করার কিছু নেই। ক্রিকেট হচ্ছে ফাঁকিবাজ ছেলেদের খেলা, এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় সে। সে ভাল ছেলে, বিকেলটা তাই পড়াশোনা করে কাটিয়েছে।
সময় চলেই যায়, ধীরে হোক আর দ্রুত হোক। কাজেই একসময় রাত আটটা বাজলো।
নয়ন তখনো পড়া মুখস্ত করে যাচ্ছে। বোঝার কোন বালাই নেই, এখন মাথায় আর কিছু ঢুকছে না, কাজেই সে শুধু শব্দগুলো মনে রাখার চেষ্টা করছে। এ কী বিপদ হল?
নয়নের চোখ রাত আটটার সময়েই ঢুলুঢুলু, রাত দুটো বাজতে তো তখনো অনেক বাকি। ঘুম তাড়াতে বড় মগের দুই মগ চা খেয়েছে সে, কোন কাজ হয়নি। উল্টো জিভ দ্বিতীয়বারের মতো পুড়েছে।
পড়ার ঘরের দরজাটা ঠেলে কেউ একজন ঢুকল। এক নজর চেয়ে দেখল নয়ন, তপন ভাই। দিব্যি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে ব্যাটা, তুই নাকি খুব পড়ুয়া হয়ে গেছিস? একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারী করেছিস?
নয়ন অনেক কষ্টে নিজের মুখের গম্ভীর ভাব ধরে রেখে বলল, তপন ভাইয়া, আমি পড়ছি, ডিস্টার্ব কোরো না তো। এই ঘর থেকে কিছু নেয়ার থাকলে নিয়ে অন্য ঘরে যাও।
ওরে বাপ রে, ছোকরার তেজ দেখো, বলে তপন ভাই ঘরে ঢুকে বেশ আরাম করে একটা চেয়ারে বসে পড়লো।
তপন ভাই নয়নের খালাতো ভাই, নয়নের চেয়ে দুই বছরের বড়, খুব হাসিখুশি মানুষ। এমনিতে তপন ভাইয়া এলে নয়নের খুশির সীমা থাকে না, কারণ কাছাকাছি বয়স হওয়াতে সবকিছু তার সাথে শেয়ার করা যায়, কিছু মনে করে না সে। কিন্তু আজ কেস ভিন্ন। আজ সকাল থেকে ভাল ছাত্র হবার জন্য নয়ন পণ করেছে।
দেয়ালে সবুজ আর লাল কালি দিয়ে এসব কী লিখে রেখেছিস? দেখি তো! তপন ভাই এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকার পাত্র নয়, সে সবকিছু চেখে দেখতে চায়।
উফ, ধরবে না তো, ওটা আমার রুটিন। কাল রাতে বানিয়েছি। জ্বালাতন কোরো না তপন ভাই, যাও তো। পরে কথা বলবো তোমার সাথে।
তপন নিষেধ অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেলো রুটিনের দিকে, উচ্চস্বরে পড়া শুরু করলো।
সকাল ছয়টা, গাত্রোত্থান, হা হা। সকাল ছয়টা থেকে সোয়া ছয়টা, প্রাতঃকৃত্য। সকাল সোয়া ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টা, প্রাতরাশ। এসব দাঁতভাঙা শব্দ কোথায় পেলি রে, হি হি।
নয়নের খুব রাগ লাগে, কিন্তু সে কিছু বলল না।
রুটিনের নিচে চোখ বোলায় তপন। আবার এখানে একটা সারকথাও লিখে রেখেছিস দেখছি। আঠারো ঘণ্টা পনেরো মিনিট অধ্যয়ন ("অধ্যয়ন" শব্দটা খুব জোর দিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলো তপন, বলার মধ্যেই বিদ্রূপটা টের পাওয়া যায়), চার ঘণ্টা ঘুম, আর বাকীটা অন্যান্য। বাহ, তোর রুটিনের তো তারিফ না করে পারা যায় না। দুর্বলচিত্ত কোন লোক এই রুটিন দেখলে তো হার্টফেল করবে।
নয়ন এবার দাঁতে দাঁত চাপল। কোথায় একটু উৎসাহ দেবে তপন ভাই, তা না, মজা করতে শুরু করেছে!
তপন বোধহয় এবার আসল কথায় আসতে চাইলো, সে বলল, তুই যে একটা গাধা সেটা জানিস?
নয়ন বেশ রাগী স্বরে বলে, কেন? আমি কী করেছি? রুটিন করে পড়াশোনা করা তো দোষের কিছু না। হয়তো পড়া একটু কম হয়ে গেছে, কিন্তু কী করবো? এর চেয়ে বেশি সময় তো বরাদ্দ দিতে পারলাম না।
তপন ঘর কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে, কম হয়ে গেছে? এই তোর কম? একবারও তোর মনে হয়নি যে তুই একটা অমানুষিক রুটিন বানিয়েছিস?
নয়নের চেহারা আকাশ থেকে পড়ার মতো হয়। আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেছে তার, মাথায় কিছু ঢুকছে না।
তপন বলে, ওরে গাধা, এই বয়সে তুই আঠারো ঘণ্টা লেখাপড়া করবি? তুই একটা পুঁচকে ছেলে, নাক টিপলে দুধ বের হয়, তুই কীনা আঠারো ঘণ্টা পড়বি? কী এমন পড়া তোর?
নয়ন ফুঁসে ওঠে, কেন? আমার পড়া কি কম?
কম হবে কেন? কিন্তু তার তো একটা সীমা আছে। তোর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সারাদিন মাটি কেটেছিস, কেউ তোকে দশদিন খেতে দেয়নি। তুই তো একটা মানুষ, সুপারম্যান তো আর না।
নয়ন এবার চুপ করে যায়। খুব ক্লান্ত লাগছে তার, এটা তো আর অস্বীকার করা যাবে না।
নিশ্চয়ই আজ বিকেলে খেলতে যাসনি? জিজ্ঞেস করে তপন।
নয়ন এপাশ-ওপাশ মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয় যে সে খেলতে যায়নি।
যা ভেবেছিলাম। তপন এবার নয়নের কাঁধে হাত রাখে, শোন নয়ন, কোন কিছুই বাড়াবাড়ি ভাল না। পাগলের মতো শুধু লেখাপড়া করাও ঠিক না, আবার সব ছেড়েছুড়ে শুধু ফুর্তি করাও ঠিক না।
সবকিছুর দরকার আছে, যদি ভালমত বেঁচে থাকতে চাস, তাহলে তোকে খাওয়া, ঘুম, বিনোদন, লেখাপড়া, সবকিছুই করতে হবে, কোনটা বাদ দেয়া চলবে না।
নয়ন এবার বইটা বন্ধ করে। খামোকাই খোলা ছিল, পড়া হচ্ছিল না।
তপন বলে চলে, তুই যা শুরু করেছিস, এটা তুই কন্টিনিউ করতে পারবি না, কয়েকদিনেই বিরক্ত হয়ে যাবি, কিচ্ছু ভাল লাগবে না। দিনে আঠারো ঘণ্টা এক নাগাড়ে পড়ার মতো করে মানুষের মগজ তৈরি হয় নি।
আজ সারাদিনে কত খানি পড়তে পেরেছিস?
নয়ন হাতের ইংগিতে দেখায়, এতটুকু, অর্থাৎ চায়ের চামচের দুই চামচ লেখাপড়াও হয়নি। এক হাত বাড়িয়ে সে খাতাটাও বন্ধ করে দেয়।
এটাই তো স্বাভাবিক। লেখাপড়া প্রসেস করতে মগজের খানিকটা সময় আর বিশ্রাম লাগে। তোর বয়সে চার ঘণ্টা ঘুম মোটেই যথেষ্ট নয়।
যদি কষ্ট করে এভাবেই চালাতে থাকিস, তাহলে এক মাসের মধ্যেই তোর সাথে একটা ছাগলের আর কোন পার্থক্য থাকবে না। ছাগল কাঁঠালপাতা চিবোয়, তুই চিবোবি বইয়ের পৃষ্ঠা।
নয়ন হেসে ফেলে।
শোন্, এই রুটিন বাদ দে। একটা স্বাভাবিক মানুষের রুটিন কর্।
সেখানে সবকিছু পরিমাণ মতো থাকবে। পড়াশোনা তো অবশ্যই থাকবে, তুই একটা ছাত্র, পড়াশোনাই তো তোর কাজ, কিন্তু দরকার অনুযায়ী, অমানুষের মতো না। এভাবে পড়াশোনা করলে কিছু বলদ তৈরি হবে, মানুষ তৈরি হবে না। পড়াশোনা করবি মনের সুখে, তাহলে দেখবি মগজ তোকে সাহায্য করছে। জোর করে মগজকে দিয়ে কাজ করানো যায় না।
নয়নের হঠাৎ খুব খুশি লাগে। সে এক টানে দেয়াল থেকে ছিঁড়ে নিয়ে আসে তার "সুপারম্যানের রুটিন। " সারাদিন এটা তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে, অনেক ভুগিয়েছে। রাত দুটো পর্যন্ত পড়লে হয়তো সে আজই পটল তুলে বসতো।
খানিকটা গল্প করে তপন ভাই বিদায় নিলো।
যাওয়ার আগে অবশ্যি নয়নের কান মলে দিয়ে গেলো।
সে রাতে একটা তোফা ঘুম দিলো নয়ন। পরদিন থেকে সে আবার স্বাভাবিক রুটিনে ফিরে গেলো। কি আশ্চর্য, তার মাথা আর ব্যথা করলো না, পড়া সময়মত শেষ হতে লাগলো, সব কিছু সে বুঝে বুঝে পড়তে পারলো।
সে বছর বেশ ভাল রেজাল্ট করল সে।
এখনো সে "সাধারণ" রুটিনেই আছে, বদলানোর ইচ্ছে নেই তার। মাঝে মাঝে অবশ্য দুঃস্বপ্নে সে সবুজ কালিতে লেখা একটা রুটিন দেখতে পায়, যেখানে আঠারো ঘণ্টা "অধ্যয়নের" কথা আছে, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। সেই দুঃসহ দিনটির কথা আজও তার খুব মনে পড়ে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।