আমি বাংলার...। আশূরা কি এবং কেন এই দিনটি এত গুরুত্বপূর্ণ সেই সম্পর্কে আমাদের অনেক মুসলিম ভাইদের মাঝে সঠিক এবং স্বচ্ছ কোন ধারণা নেই। আশুরা নিয়ে পত্রিকাতে বিশেষ সংখ্যা বের করা হয় আর তাতে ঘুরে ফিরে কারবালার কাহিনীটাই প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে লক্ষ্য করা
যায়। আশূরা এমন একটি দিন যেই দিনটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও গুরুত্ব দিয়েছেন কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় সেই সময় কিন্তু কারবালার ঘটনাটি ঘটে নি। অর্থাৎ, কারবালার ঘটনা আশূরার সাথে সম্পৃক্ত কোন বিষয় নয়।
তাহলে প্রকৃতপক্ষে কোন ঘটনাটি আশূরার সাথে সম্পৃক্ত? আজ আমরা এই বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করবো; ইনশা আল্লাহ।
“হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় এলেন তখন তিনি লক্ষ্য করলেন ইহুদীরাআশূরা’র দিনে রোযা পালন করতো। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জিজ্ঞেস করলেনঃ এই দিনে রোযা রাখার তাৎপর্য কি? তারা বললোঃ এই দিনটির অনেক বড় তাৎপর্য রয়েছে, আল্লাহ মূসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর অনুসারীদের বাঁচিয়ে ছিলেন এবং ফেরাউন ও তাঁর অনুসারীদের ডুবিয়ে ছিলেন এবং মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ঘটনার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রোযা রাখতেন আর তাই আমরাও রাখি। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমাদের চেয়ে আমরা মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরো বেশি নিকটবর্তী সুতরাং তোমাদের চেয়ে আমাদের রোযা রাখার অধিকার বেশি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশূরা’র রোযা রাখতেন এবং অন্যদেরকে এই রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন”
(Muslim :: Book 6 : Hadith 2520) (মুসলিম ২৫২০)
ইবনে আব্বাস কর্তৃক বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনা পৌঁছালেন তখন তিনি লক্ষ্য করলেন ইহুদীরা আশূরার দিনে রোযা রাখতো।
তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তারা এর জবাবে বলেছিলঃ “এইদিনে আল্লাহ তা'আলা মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এবং ইসরাঈলের অধিবাসীদের ফেরাউনের উপর বিজয়ী করেছিলেন, তাই এই বিজয়ের সম্মানে আমরা এই দিন রোযা রাখি”, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমাদের চেয়ে আমরা মুসার অধিক নিকটবর্তী”, এরপর তিনি এইদিনে রোযা পালন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
(Bukhari :: Book 5 :: Volume 58 :: Hadith 279)
ইবনে আব্বাস কর্তৃক বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় পৌঁছালেন, ইহুদীরা আশূরা’র (১০ মহররম) রোযা রেখেছিল, তারা বললঃ “এই দিনে ফেরাউনের বিরুদ্ধে মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিজয়ী হয়েছিলেন,” এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের বললেন, “মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিজয় উৎযাপনের অধিকার ইহুদীদের চেয়ে তোমাদের (মুসলিমদের) বেশী, তাই এই দিনে রোজা রাখ”।
(Bukhari :: Book 6 :: Volume 60 :: Hadith 202)
এই হাদীসগুলোর আলোকে আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি আর তা হলো, আশূরা’র মূল প্রতিপাদ্য বিষয় "ফেরাউনের বিরুদ্ধে মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিজয়। " এই দিন (১০ মহররম) আল্লাহ তাআলা নাস্তিক ফেরাউনের বিরুদ্ধে মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিজয় দান করেছিলেন। যে ঘটনার বিবরণ আমরা মহাগ্রন্থ আল কুরআনে পাই, অথচ আশূরার এই প্রকৃত তাৎপর্য থেকে আমরা সম্পূর্ণ (অজ্ঞ ও) বেখবর হয়ে রয়েছি।
আশূরার এই ঘটনা থেকে প্রায় তিন হাজার বছর পর কারবালার ঘটনা সংগঠিত হয়েছিল। কিন্তু না জানার কারণে আশূরা আসলেই আমরা কারবালার ঘটনা বিশ্লেষণ করতে লেগে যাই। অথচ এই দিনটি যে বিশ্বাসীদের বিজয় দিবস আর নাস্তিকদের পতন দিবস সে সম্পর্কে আমাদের কোন বোধদয়ই হয় না।
“মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ঘটনার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রোযা রাখতেন” আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তারা সাহাবীদের বললেন, “মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিজয় উৎযাপনের অধিকার ইহুদীদের চেয়ে তোমাদের (মুসলিমদের) বেশি, তাই এই দিনে রোযা রাখ”
আশূরার এই প্রকৃত ঘটনা মুসলমানদেরকে আরো শক্তিশালী করবে, তাদের বিশ্বাসকে আরো বাড়িয়ে দিবে আর আল্লাহকে অবিশ্বাসকারীরা নিদর্শন থেকে শিক্ষা নিবে। তবে আশূরাকে কারবালার ঘটনা দিয়ে যেভাবে শোক পালন করা হয় আর কিছু গোষ্ঠী যেভাবে মাতম করে যা সুস্পষ্ট বিদ'আত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর সাহাবীরা এভাবে আশূরা পালন করেন নি। আর যে কোন শোক তিনদিনের বেশি পালনের অনুমতি ইসলামী শরীয়া দেয় নি। অর্থাৎ যেদিন মারা যাবে সেদিন থেকে নিয়ে তিনদিন শোক পালন করা কিন্তু এই তিনদিনের মধ্যেও শোকে মাতম করে জামা-কাপড় ছিড়ে ফেলা, রক্ত বের করা ইসলাম শিক্ষা দেয় নি।
উম্মে আতিয়া কর্তৃক বর্ণিত, মৃত ব্যক্তির জন্য আমাদেরকে তিনদিনের বেশি শোক করতে নিষেধ করা হয়েছে শুধুমাত্র স্বামী মারা গেলে স্ত্রীদের জন্য চার মাস দশদিন শোক পালন করতে হয়।
(Bukhari :: Book 7 :: Volume 63 :: Hadith 254)
আয়েশা (রা) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহ’র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে নারী আল্লাহ এবং শেষবিচারের দিনের উপর বিশ্বাস রাখে সে যেন মৃত ব্যক্তিদের জন্য তিনদিনের বেশি শোক পালন না করে তবে তাঁর স্বামীর মৃত্যুর শোক ব্যতীত
(Muslim :: Book 9 : Hadith 3549)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত বর্ণিতঃ “যে ব্যক্তি গালের উপর চপেটাঘাত করল এবং পকেট ছিঁড়ে ফেললো এবং জাহিলিয়াতের ডাক ডাকল সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়”।
(বুখারী, ফতহুল বারী ৩/১৬৩)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “বিলাপকারিণী যদি মৃত্যুর পূর্বে তওবা না করে তাহলে কিয়ামতের দিন যখন তাকে উঠান হবে তখন তার গায়ে আলকাতরার পাজামা এবং পিচের জামা পরান থাকবে। ”
(মুসলিম, হাদীস নং ৯৩৪)
মৃত ব্যক্তির জন্য তিনদিনের বেশি শোক পালন করা নিষেধ আর বিলাপকারীদের প্রতি এই বলে সতর্ক করা হয়েছে যে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের অন্তর্ভূক্ত নয়। হযরত উমর (রা) শহীদ হয়েছিলেন আর তাঁর মর্যাদা অনেক বেশি কিন্তু আমরা কোন শোক পালন করি না কারণ এটা সুন্নাহতে নেই। উসমান (রা), আলী (রা) শহীদ হয়েছিলেন তাদের জন্যও আমরা শোক পালন করি না অথচ তাঁদের মর্যাদাও অনেক বেশি। ইসলামী শরীয়াতে মৃত ব্যক্তির মারা যাওয়ার দিন থেকে নিয়ে তিন দিন পর্যন্তই শোক এরপরে কোন শোক নেই।
মুসলিম জাতি শোকের জাতি নয়, এরা সাহসী জাতি, বিশ্বাসী জাতি।
শোক পালন করার জন্য আমাদের দেশে যতপ্রকার পন্থা চালু আছে সবই বিদ'আত। আর কারবালার ঘটনাটিকে আশূরা’র সাথে সম্পৃক্ত করে যা করা হয় তা মোটেই ঠিক নয়। কারবালার ঘটনার সাথে আশূরা’র কোনই সম্পর্ক নেই। কাজেই এই বিষয়ে যদি কেউ ভুল ধারণায় নিমজ্জিত হয় তার ভুল ভেঙ্গে দেওয়া আমাদের অবশ্য কর্তব্য।
আশূরা’র দিন বিশ্বাসীদের বিজয় দিবস আর নাস্তিকদের পতন দিবস। এই বিজয় দিবস উৎযাপনের সুন্নাহ হলো দুইটি রোযা রাখা। নয় মহররম এবং দশই মহররম দুইটি রোযা রাখাই হচ্ছে সুন্নাহ। তবে এই রোযা দুইটি বাধ্যতামূলক নয়, কেউ ইচ্ছা করলে রাখতে পারে আবার কেউ ইচ্ছা করলে নাও রাখতে পারে। আর রাখলে তাতে অনেক তাৎপর্য নিহিত রয়েছে।
“আয়শা (রা) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের রোযা ফরজ হওয়ার পূর্বে আশূরার রোযা রাখার নির্দেশ দিতেন। কিন্তু যখন রমযানের রোযা ফরজ হয়ে গেল তখন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বলেছেন যদি কেউ রাখতে চায় রাখতে পারে আবার কেউ যদি রাখতে নাও চায় নাও রাখতে পারে। ”
(Muslim :: Book 6 : Hadith 2502)
আশূরা’র রোযাটি যেহেতু ইহুদীরাও রাখতো তাই তাদের সাথে ব্যতিক্রম করার জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নয় এবং দশ মহররম রোযা রাখার নিয়ত করেছিলেন,
“আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যদি আমি পরবর্তী বছর জীবিত থাকি তবে আমি অবশ্যই নয় তারিখের(মহররম) রোযাটিও রাখব। ”
(Muslim :: Book 6 : Hadith 2529)
আবু কাতাদা (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত; রাসূল (সাঃ) কে আশূরার রোযা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো; তখন রাসূল (সাঃ) জবাব দিলেন, এই রোযা বিগত বছরের পাপের কাফ্ফারাহ। অন্য বর্ণনায় এসেছে; আশূরার রোযা আল্লাহর নিকট বিগত এক বছরের গুনা মাফ করে দেয়।
(মুসলিম)
মহান আল্লাহ তা'আলা আমাদের অজ্ঞ ও বেখবর হওয়া থেকে রক্ষা করুন। আমরা যেন প্রকৃত সত্য অনুধাবন করে সেই মোতাবেক জীবনকে গড়ে তুলতে পারি সেই তৌফিক, মহান আল্লাহ আমাদের দান করুন। আমীন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।