আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হিনার সফর ও পাকিস্তানের ক্ষমা না চাওয়া...............

বাঙালি জাতির এক দুঃসহ স্মৃতি একাত্তর। এ বছরটি ঘিরে কত লোক যে নিহত হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান ইতিহাসের পাতায় কোনোদিনই পরিপূর্ণভাবে উঠে আসবে না। খুব স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি জাতি পাকিস্তানিদের ক্ষমা করবে না কোনোদিন। পাকিস্তানিরা দাবি করে- তারা মুসলিম। কথায় কথায় ‘মুসলিম ব্রাদার’ এই এক শব্দে আমাদের কান ঝালাপালা এই ব্রিটেনে।

এ যেন মিথ্যেকে জায়েজ করার দুটো জাতীয় শব্দ পাকিস্তানিদের। মুসলিম ব্রাদার। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় এরাই মুসলিম ব্রাদার নিধন করেছে। লাখ লাখ মুসলিম বোনের সম্ভ্রম নিয়েছে তারা। কিন্তু ইসলামী বিধান অনুযায়ী এই পাপ থেকে মুক্তির কোনো পথই অবলম্বন করেনি তারা।

আজ বিয়াল্লিশ বছরের প্রান্তে এসেও তাদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসা মানুষগুলো মনে করে এ সিদ্ধান্তে তাদের কোনো দোষ ছিলো না। তাদের যেন কোন অনুশোচনাও নেই এতে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানী খার এসেছিলেন বাংলাদেশে। আপাতদৃষ্টে মনে হয় হিনা এক চৌকষ নারী । তার মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর তিনি ভারত সফর করেও আলোচনায় উঠে এসেছিলেন।

কেউ বলেছিলেন তার সৌন্দর্য আর পাশাপাশি তার তারুণ্য তাকে দিয়েছিলো বাড়তি পরিচিতি দক্ষিণ এশিয়ায়, এমনকি বিশ্বে। সম্প্রতি তিনি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলের সঙ্গে লুকিয়ে প্রেম করার মুখরোচক আলোচনা উঠে এসেছিল বিশ্বমিডিয়ায়। সব মিলে হিনা পাকিস্তানের রাজনীতির মধ্য দিয়ে বিশ্ব তারুণ্যের এক উজ্জ্বল উদাহরণও বটে। এই হিনা এসেছিলেন বাংলাদেশে গত সপ্তাহে। পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় ডি -৮ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দিতে তার এই আসা বাংলাদেশে।

সে সময় তিনি দেখা করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সাথে। দীপু মনি পাকিস্তানিদের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। নিঃসন্দেহে এই বিষয়গুলো ছিলো রাজনৈতিক। এর মাঝে প্রধান হলো একাত্তরের নৃশংস হত্যাকান্ডের জন্যে পাকিস্তানিদের ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গ। হিনা এড়িয়ে গেছেন।

বলতেই হয় হিনা এড়িয়ে গেছেন মানে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি এড়িয়ে গেছে এই প্রসঙ্গটি। তারা তাদের সিদ্ধান্তকে কোনোভাবেই পাল্টায় নি। খুন-ধর্ষণকে হিনা রাব্বানি খার প্রকারান্তরে ইতিহাসের অনিবার্যতা হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন। ভাবতে অবাক লাগে, একজন তরুণী হয়েও একাত্তরের হত্যা-ধর্ষণের জন্যে হিনা তার দেশের পক্ষে ক্ষমা চাইতে পারলেন না (অবশ্য তার কর্তাব্যক্তিরা চান না বলে তিনি তা চাইতে পারেনও না। )।

উল্টো তিনি অতীত ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করেছেন। ২০০২ সালে পারভেজ মোশাররফের সরকার বাংলাদেশের গণহত্যার জন্যে তাদের ভুল স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছিলো। কিন্তু লাখো-কোটি মানুষের খুনের দায় নিয়ে বাঙালি জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার মতো উদাহরণ তো দেখাতে পারে নি মোশাররফের সরকার। কি এমন ক্ষতি হতো! ক্ষমা চাওয়াতো মহত্বেরই লক্ষণ। লাখ লাখ মানুষ হত্যা করে অন্তত ক্ষমা শব্দটিও যদি এরা ব্যবহার করতে না পারে, তাহলে এদের মানবিক বোধ নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।

কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, হিনা কিংবা তার সরকারের এই বোধটুকু না থাকলেও রাষ্ট্রের বুদ্ধিদীপ্ত আর মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ কিংবা প্রতিষ্ঠানের এই মানবিক বোধটুকু হারিয়ে যায় নি। তাইতো এর আগেও রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায় থেকে ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে। এবারে হিনার সফরকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় ডন পত্রিকাটি তাদের সম্পাদকীয় পর্যন্ত করেছে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গটি নিয়ে। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা ভুলে যেতে পারি নি আমাদের দেশবাসী ও স্বজনদের সেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা, আমরা ভুলে যেতে পারি নি আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রমহানির কথা। এটা ভুলে যাবার মতো নয়।

আমরা রাজাকারদের ক্ষমা করতে পারিনি। আমরা পারিনি সে সময়ের পাকিস্থানিদের বাংলাদেশি দোসরদের ক্ষমার চোখে দেখতে। সেজন্যেই যেখানে পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত ডন পত্রিকাটি তার মানবিক দায়টুকুরই প্রকাশ ঘটিয়েছে তার গত ১১ নভেম্বরের সম্পাদকীয়তে। পত্রিকাটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেখিয়ে বলেছে ভ্যাটিকান, কনস্টান্টিনোপল-এর কথা। এমনকি কোরিয়ার ওপর জাপানের আক্রমণ, জাপানি সেনাদের নৃশংসতা ও কোরীয় নারীদের যৌনদাসী বানাবার প্রসঙ্গ টেনে কোরিয়ার কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গটিও তারা সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেছে।

পাকিস্তান যদি সত্যিকার অর্থেই ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্ক চায়, মুসলিম ব্রাদারসুলভ সম্পর্ক চায়, মানবিক বোধের প্রকাশ ঘটাতে চায়, তাহলে হিনার এবং তার সরকারের তরফে এ ব্যাপারে একটা ইতিবাচক সাড়া দেয়ার প্রয়োজন ছিলো। অন্তত আশার কথা শুনিয়ে যেতে পারতেন তিনি। হয়ত সে কারণেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও ডি-৮ সম্মেলনে তার অনুপস্থিত থাকার কথাই জানিয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানকে। দুই) ঐতিহাসিক কারণেই পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক গড়ে উঠছে না। হিনার সফরের পর এ সম্ভাবনাটুকু যেন আরও মিলিয়ে গেলো।

এই যখন দুদেশের সম্পর্ক, সে সময়েই প্রতিবেশী দেশ ভারতও রাখছে একটা অন্য নজর বাংলাদেশের ওপর। ভারত নিয়েও আছে নানা কথা। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কিছু কিছু ব্যাপার এখনও অমীমাংসিত। তাইতো সীমান্ত মাঝে মাঝেই অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। সীমান্তে প্রতি বছরেই ফেলানীরা নিহত হয়।

আছে টিপাইমুখ-ট্রানজিট-তিস্তার পানি বন্টন প্রভৃতি ইস্যু। বর্তমান সরকারের বন্ধু বলে পরিচিত আওয়ামী লীগ যেন খুঁজে পাচ্ছে না এই ইস্যুগুলো সমাধানের পথ। এই যখন দুদেশের রাজনৈতিক ছোটখাটো দ্বন্দ্ব, সে সময়ে কিন্তু ভারত ঠিকই তাকে একটা নিজস্ব জাযগায় দাঁড় করিয়ে নিয়েছে। এক সময় একচেটিয়া ভারত-ঘেঁষা হিসেবে পরিচিত ছিলো আওয়ামী লীগ বিরোধীদের কাছে। বিএনপি-জামায়াত কিংবা অতি ইসলামী অর্থাৎ মুসলিম ব্রাদারদের প্রধান টার্গেটই ছিলো এই হিন্দুদের (!) দেশটি।

এমনকি জাতীয় পার্টির প্রধানও এইতো ক‘মাস আগে সিলেটের জকিগঞ্জ পর্যন্ত গিয়ে ভারতের বিরোধিতা করে এসেছেন। বলেছেন, সিলেট শুকিয়ে যাচ্ছে। ভারতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। কিন্তু সময় বড় দ্রুত পাল্টে গেলো। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভারত ঘুরে এসেছেন গত আগস্ট মাসে।

ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সংবর্ধিত হয়েছেন। কি আশ্চর্য এসেই তিনি বলেছেন, ভারতের পক্ষ থেকে আছে তার গ্রিন সিগন্যাল। ভারত সরকার তার সঙ্গে কাজ করতে চায়। বিএনপি যখন নির্বাচন বিমুখ, সে সময় হয়ত একটা নির্বাচনের জন্যে একটি দলের প্রয়োজন থাকতেই পারে। নির্বাচন-পরবর্তী একটা বিরোধী দলের প্রয়োজন তো আছেই।

এরশাদের জাতীয় পার্টি সে প্রক্সিটি দিতেও পারবে হয়ত। তাইতো এরশাদের এই বগল বাজানো তখন দেশে একটা আলোচনার বিষয়ই হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তা-ও এখন অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে খালেদা জিয়ার ভারত সফরের পর। অথচ এই বিএনপির নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতা শেষ হতো না অন্তত এক পশলা ভারতের একটা বিরোধিতা ছাড়া। সেই বিএনপি‘র নেত্রী গত সপ্তাহে দেখা করে এলেন ভারতের নেতাদের সঙ্গে।

এখন সারাদেশে চাউড় করা হচ্ছে এক সফল দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়েছে তাদের মাঝে। সহসা এখন বিএনপি’র মুখ থেকে ভারতবিরোধিতা উবে গেছে। এতে খানিকটা বিব্রত সরকার। তারা মনে করছে, তাদের একক মৌরসী জায়গায় এবার অন্যরা ভাগ বসাচ্ছে। শেষ ভরসার জায়গাটা বুঝি শেষ পর্যন্ত খোয়া যায়! এই ভয় যেন তাড়া করছে তাদের।

অন্তত খালেদা জিয়ার ভারত সফর শেষে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী কিংবা নেতাদের প্রতিক্রিয়ায় কিন্তু তাদের হতাশাই স্পষ্ট হচ্ছে। তিন) ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা আমাদের দেশের রাজনীতিতে কলকাঠি নাড়েন। সে কথাটা আর কাউকে বলে দিতে হয় না। ব্রিটেনে তো বিএনপি নেতা-কর্মীদের একটাই কাজ: আওয়ামী লীগ ক্রসফায়ার করছে, বিচার বহির্ভূতভাবে মানুষ মরছে, মানবতার বিরুদ্ধেই এদের অবস্থান, মানুষ নিরাপদ নয় বাংলাদেশে---- প্রভৃতি কথাগুলো নিয়ে তারা প্রতি মাসেই কোনো না কোনো এমপি’র সঙ্গে বৈঠক করছেন। আর আওয়ামী লীগও কম কিসে! জঙ্গিবাদ নির্মুল করতে বিরোধী দল মৌলবাদী জামায়াতীদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে বিএনপি।

এই জানা গল্পগুলো নিয়ে এরা ব্রিটেনের ডাউনিং কিংবা স্ট্রিট পার্লামেন্ট ভবন গরম রাখেন। এখন এই গরমের পাশাপাশি ভারতের ক্ষমতাসীন মানুষগুলোও উষ্ণ হচ্ছে। দুদিন পর পর বাংলাদেশের নেতা-নেত্রীরা যাচ্ছেন। ভারতের উষ্ণ সংবর্ধনায় মোমের মতো গলে যাচ্ছেন তারা। আর ভারত এতে করে টিপাইমুখ বাঁধ, তিস্তার পানিচুক্তি, ট্রানজিট কিংবা এমনকি সীমান্তের মতো ইস্যুকেও শীতল করে দিয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতি যেন হঠাৎ করেই একটা টার্ন নিচ্ছে। কর্মী-দল এমনকি জনগণের ওপর থেকে রাজনীতির প্রধান মানুষগুলো তাদের নির্ভরতা যেন অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে। এরা ক্রমেই নির্ভরশীল হয়ে উঠছে বিদেশিদের উপর। ইউরোপ থেকে এরা এখন যেন তাদের লক্ষ্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টায়। রাজনীতির কিবলা এখন পাশের বাড়ীর আঙ্গিনায়।

তাই ভারতে এদের ছুটোছুটি---ঘটা করে বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলে বেড়ানো ‘এ আমাদের ‘ঐতিহাসিক বিজয়’। দলের বিজয় দেখার জন্যে আমরা হয়ত অপেক্ষা করবো আরো বছর দেড়েক। কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা কি ক্রমেই জড়িয়ে পড়ছি না নতুন নতুন শৃঙ্খলে ? এখানে লিঙ্ক ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।