দেবলোকে বাস করেন কিন্তু দেবতা নন এমন সুদর্শন আটজনের একটা দল ছিল, তাদের বলা হত অস্টবসু। পুরোনোরা অনেকে ছেলেবেলায় পড়েছেন 'আটে অস্টবসু' ন'য়ে নবগ্রহ..। তা বসুগন একবার তাদের স্ত্রীসহ মর্ত্তলোকে ভ্রমন করার সময় বশিস্ঠ মুনির আশ্রমে উপস্হিত হলেন।
সেখানে বাঁধা ছিল কামধেনুর কন্যা নন্দিনী নামক এক ইচ্ছা-গাভী। সে ছির এক লোভনীয় প্রানী, তার কাছে যা প্রার্থনা করা হত তাই পাওয়া যেত।
ব্যাস ঐ নন্দিনীকে দেখে বসুগনের স্ত্রীদের হলো লোভ, ঐ গাভী নন্দিনীকে চুরি করে এনে দাও। স্ত্রীদের কথামত তারা ঐ গাভী চুরি করতে গিয়ে পড়ল ধরা। এদের চুরির নেতা ছিল এদের মধ্যে প্রভাস নামে সর্বকনিষ্ঠ এক বসু। বশিষ্ঠ মুনির অন্তর্দৃস্টিকে ফাকি দেয়া অত সোজা নয়। ফেসে গেল প্রভাস।
মুনিবর রেগেমেগে দিলেন অভিশাপ, তারা সবাই আগামীতে মর্ত্তলোকে জন্মগ্রহন করবেন। সে এক মহা যন্ত্রনার অভিশাপ, মর্ত্তে বাস মানেই অভিশাপ। সবাই মুনির কাছে ক্ষমা চাইলেন। মুনি দয়াপরবশ হয়ে তাদের সাতজনকে বললেন তারা জন্ম নিয়েই শাপমুক্ত হবেন তারপর স্বর্গে ফেরৎ আসবেন তবে 'প্রভাস'কে আমরণ মর্ত্তলোকের যন্ত্রনা ভোগ করতেই হবে।
তখন তারা ভাবতে লাগলেন মর্ত্তে কার গর্ভে জন্মালে ভাল হয়।
অবশেষে তারা খুজে পেলেন মা গঙ্গাকে। তাদের অনুরোধে মা গঙ্গা তাদের গর্ভে ধারণ করতে রাজি হলেন। তারা পরবর্তিতে কুরু বংশে মা গঙ্গার সন্তান হিসাবে জন্ম নেন। অবশ্য সাতজন জন্মের পর রপই শাপমুক্ত হয়ে স্বর্গে ফেরৎ চলে আসেন, প্রভাস বাদে।
সেকালে হস্তিনাপুরের রাজা ছিলেন বিখ্যাত কুরুবংশীয় রাজা শান্তনু।
তিনি মহাবীর ছিলেন, যাকে স্পর্শ করতেন সে'ই তারুন্য আর সৌন্দর্য লাভ করত। তিনি হরিণ শিকার করতে বড় ভালবাসতেন।
তিনি একবার নদীর তীরে বেড়াতে গিয়ে এক অপুর্ব সুন্দরী কন্যার দেখা পেলেন। দেখেই তিনি তার প্রেমে পড়লেন আর তাকে বিয়ে করতে প্রস্তাব দিলেন। সেই কন্যা আর কেউ ছিলেন না, ছিলেন স্বয়ং মা গঙ্গাদেবী।
তা রাজা শান্তনুর প্রস্তাব পেয়ে ঐ কন্যাটি বললেন, আমি রাজি তবে একটা শর্ত আছে। রাজা বললেন, আমি যে কোন শর্তেই তোমাকে বিয়ে করব। কন্যাটি বললেন, বিয়ের পর আমার যে কোন কাজেই তুমি কোন প্রশ্ন করতে পারবেনা বা মানা করবেনা। রাজা শান্তনু তাতেই রাজি হলেন।
বিয়ের পর ঐ রানীর গর্ভে একে একে সাতটি পুত্র সন্তান জন্ম নিল আর ঐ রানী তাদের জন্মের পর পরই নদীতে ভাসিয়ে দিতে লাগলেন।
তারা ছিল আসলে আগে উল্লেখিত শাপগ্রস্হ বসুগন যারা জন্মের পরই নদীতে নিক্ষিপ্ত হয়ে শাপমুক্ত হয়ে স্বর্গে চলে যাচ্ছিল, যা শান্তনু রাজার জানা ছিলনা। তিনি নিরবে সব সহ্য করছিলেন।
অবশেষে অস্টম সন্তান (প্রভাস) জন্মের পর যখন রানী (গঙ্গা) তাকে নদীতে নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলেন তখন রাজা শান্তনু আর থাকতে না পেরে বললেন
একজনকে তো অন্তত রাখ। কে তুমি, কেন এরকম সন্তানদের নদীতে নিক্ষেপ করছ। রানী তখন সব খুলে বললেন, বললেন আমি গঙ্গা, বললেন বসুগনের জন্ম আর শাপমুক্ত হওয়ার কাহিনী।
শেষে বললেন এখন আর আমার পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয়, তবে যেহেতু অস্টম সন্তানটি ছোট, একে পালন করা বাবার পক্ষে সম্ভব নয় আমিই একে পালব তারপর বড় হলে তোমার কাছে দিয়ে যাব। এর নাম হবে দেবব্রত। এক সময় এই সন্তানের খ্যাতি ত্রিভুবন ছড়িয়ে যাবে।
আর তাই গিয়েছিল, তিনিই ছিলেন মহাবীর ভীষ্ম।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভীষ্মের বীরত্বে রেগে তাকে সুদর্শন চক্র নিয়ে মারতে গিয়েছিলেন যা ছিল তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের সমান।
মায়ের কাছে থাকবার সময় ঐ অস্টম সন্তান দেবব্রত দেবগুরু বৃহস্পতির কাছে রাস্ট্রবিজ্ঞান, বশিশ্ঠ মুনির কাছে বেদ ও বেদান্ত আর পরশুরামের নিকট ধনুর্বিদ্য আর অস্ত্র শিক্ষা লাভ করেন। হয়ে উঠেন এক আদর্শ রাস্ট্রনায়ক এক মহাবীর-- এক মহান মানুষ। বড় হয়ে তিনি বাবার কাছে চলে আসেন। মা গঙ্গা আর আসেননি।
পরশুরাম ও তার কুঠার।
তিনি ভীষ্মের অস্ত্রগুরু হলেও ভীষ্ম তাকে যুদ্ধে হারিয়েছিলেন যে যুদ্ধ ১৩ দিন চলেছিল।
এদিকে একদিন রাজা শান্তনু নদীর তীরে বেড়াতে গিয়ে ধীবররাজা (জেলেদের রাজা) দশরাজার অপুর্ব সুন্দরী কন্যা সত্যবতীর দেখা পান। তার রূপ দেখে রাজা মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করার জন্য ধীবর রাজার নিকট প্রস্তাব দেন।
সত্যবতীকে রাজা শান্তনুর প্রেম নিবেদন
প্রস্তাব শুনে ধীবর রাজা বললেন, তোমার ঘরে দেবব্রতের মত অসাধারণ গুনবান রাজপুত্র থাকার পর তো আমার মেয়ের গর্ভের সন্তান কখনোই রাজা হতে পারবেনা। তাকে দুইনম্বর রানী হয়েই থাকতে হবে, সুতরাং এ বিয়ে হবেনা।
এই কথা শুনে রাজা বিমর্ষ চিত্তে প্রাসাদে ফেরৎ আসলেন। দেবব্রতের মত পুত্রকে সিংহাসন বন্চিত করা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়।
ধীবর রাজার কাছে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা
এদিকে এই সংবাদ পেয়ে দেবব্রত প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি কখনোই সিংহাসন দাবী করবেননা, পিতার সন্তুস্টিই তার কাম্য। ধীবর রাজা শুনে দেবব্রতকে বললেন তুমি সিংহাসন না চাইতে পারো তোমার সন্তানরা তো চাইবে।
দেবব্রত বললেন আমি জীবনে বিয়েই করবনা।
কি ভীষন প্রতিজ্ঞা! চারিদিকে ধন্য ধন্য পড়ে গেল, দেবতারা পুষ্প বর্ষন করতে লাগল। তার পিতা শান্তনু তাকে ইচ্ছামৃত্যুর বর দিলেন, অর্থাৎ তার নিজের ইচ্ছা না হলে তিনি মৃত্যু বরণ করবেননা।
তখন থেকে তার নাম হল ভীষ্ম।
ভীষ্মের শরশয্যা
এই ভীষ্ম তার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের বিয়ে দেয়ার জন্য তিনটি সুন্দরী রাজকন্যাকে অপহরণ করেণ। তাদের নাম ছিল অম্বা, অম্বিকা আর অম্বালিকা।
পরে ভীষ্ম জানতে পারেন এদের মধ্যে অম্বা নামক কন্যাটি রাজা শল্যকে ভালবাসত। ন্যায়পরায়ণ ভীষ্ম অম্বাকে শল্যের নিকট ফেরত পাঠাতে মনস্হ করলেন।
কিন্তু যেহেতু অম্বা কয়েকদিন হস্তিনাপুরে ভীষ্মের আশ্রয়ে ছিলেন সেহেতু শল্য তাকে গ্রহন করতে অস্বীকার করলেন, লাগল ফ্যাসাদ। তখন অম্বা ভীষ্মকে বললেন যেহেতু তুমি আমাকে অপহরণ করেছ তাই তুমিই আমাকে গ্রহন কর। কিন্তু ভীষ্ম বললেন আমি আজীবন অবিবাহিত থাকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, আমার পক্ষে তোমাকে বিয়ে করা সম্ভব হবেনা।
এতে অম্বা চরম অপমানিত হলেন। তিনি বললেন আগামী জনমে আমি তোমার মৃত্যুর কারণ হব।
এই অম্বা পরের জনমে পুরুষ হয়ে শীখন্ডী হিসেবে জন্ম গ্রহন করেন আর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্মের বিরুদ্ধে পান্ডবদের পক্ষে অবস্হান নেন। ভীষ্ম তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে চিনতে পারেন যে শিখন্ডীই অম্বা। যেহেতু শীখন্ডী আগের জনমে নারী (অম্বা) ছিলেন তাই তার প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করা ভীষ্মের নীতি বিরুদ্ধ ছিল।
আর এটাকে অবলম্বন করে অর্জুন ভীষ্মকে তীর বিদ্ধ হয়ে রথ থেকে পড়ে যেতে বাধ্য করেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরে ভীষ্ম নিজ ইচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।