আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোট গল্প, (অনেক বড় স্ট্যাটাস, সময় থাকলে ধৈর্য নিয়ে পড়বেন, সাধারন প্রেমের গল্প। আমি গল্প লেখার ব্যাপারে নবিশ। এই প্রথম একটা পুরোপুরি লিখে ফেলেছি। প্রেমের গল্পের প্লট খুঁজে পাওয়া কঠিন কাজ। সব ঘটনাই যেন ব্যাবহার হয়ে গিয়েছে। আবার বলছি, সময় এবং ধৈর্য থ

চাকরীটা হয়ে গেলো শুভর। ঠিক সে মুহূর্তে খুব সম্ভবত পৃথিবীতে ওর চেয়ে বেশী দরকার আর কারওই ছিলনা চাকরীটার। পাঁচ বছরের কন্ট্রাক্ট। ঠিক এক সপ্তাহের মাঝে জয়েন করতে হবে। হ্যা, ওরা প্রচুর টাকা দিবে।

তবে এই সময়ের মাঝে আর দেশে ফিরতে পারবেনা সে। কোম্পানি নিজেদের খরচায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে। শুভর মেধাটা প্রচুর টাকার বিনিময়ে কিনে নিতে চায় তারা। প্রথম ছয় মাসের অগ্রিম টাকাটা জয়েন করা মাত্র শুভর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে। এমনি লেখা আছে কন্ট্রাক্টে।

আর এই টাকাটাই দরকার শুভর। খুব দরকার! মা মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে। পুরো পরিবার, বাবা, ছোটভাই, বোন সবাই যে শুভর মুখাপেক্ষী হয়ে গিয়েছে! শুভ চাকরীটা নিয়ে দেশ ছাড়লেই মায়ের চিকিৎসা শুরু হবে। হয়তো বেঁচে যাবেন মা; হয়তো আরো কয়েকটা দিন পৃথিবীর আলো তাঁর চোখে পরবে। চাকরী হওয়ার খবরটা শোনা মাত্র বাবার চোখে আলোর একটা ঝিলিক দেখেছিল শুভ।

ছোটভাইটার মুখে যেই হাঁসিটা ছড়িয়ে পরেছিল সেটা শুভর বুকে বেশ কয়েকবার আঘাত করে স্থায়ী আসন গেঁড়ে নিয়েছিল। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় শুভ ছোটোর ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো হাঁসির ছটায় উদ্বেল। বুবুর চোখ দিয়ে যেই অশ্রুধারাটা গাল বেয়ে নেমে এসেছিল! শুভ কিভাবে এতগুলো অনুভূতিকে হত্যা করবে? শুভকে দুরের অজানা পথে পারি দিতেই হবে! স্বার্থপরের মত নিজের জীবনটাকেই ইচ্ছামত আনন্দ করে বেঁচে থাকার মানসিকতা নিয়ে সে বড় হয়নি! যেই মা তাকে রাতের পর রাত নির্ঘুম জেগে থেকে মানুষ করেছে, যেই বাবা শত অভাবের দিনেও তার স্কুলের বেতন ছাড়াও প্রাইভেটে পড়ার টাকাগুলো সময়মত হাতে তুলে দিয়েছে, আজ কিভাবে সে তাঁদের এই একটা ইচ্ছাপূরণ করে দিবেনা? এরাই তো খেয়ে না খেয়ে ওর ম্যাট্রিক,ইন্টারের রেজিসট্রেশন টাকাগুলো জোগাড় করে দিয়েছিল। সেই ঋণগুলো শুভকে মেটাতেই হবে! হ্যা, শুভ জানে, যা সে হারাতে যাচ্ছে তাতে যেই অবর্ণনীয় এক ক্ষতি হয়ে যাবে, সেই ক্ষতির কোনই ক্ষতিপূরণ নাই। এমন কিছু একটা তাকে বিসর্জন দিতে হবে যে,ওর নিজের জীবনটা উলটপালট হয়ে যাবে।

কিন্তু আজ ও নিরুপায়। একমুখী রাস্তায় নেমে গিয়েছে শুভ। এখন শুধু সামনের দিকে এগিয়ে চলা। শুভর চাকরীর সংবাদটা প্রচণ্ড বজ্রপাতের মত ভেঙ্গে পড়ল তানহার উপর। সমস্ত দুনিয়া যেন মহাপ্রলয়ের আঘাতে আঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে তুলার মত ভেসে বেড়াচ্ছে তানহার চারপাশ দিয়ে।

কবরের নিস্তব্ধতার মত শুনশান নীরব কয়েকটা মুহূর্ত; তারপরই চোখ দিয়ে অঝর শ্রাবন নেমে এলো তানহার। কত বর্ষের বসন্ত আর বর্ষা অথবা শীতের দিনগুলোতে তিল তিল করে গহীন স্বপ্নের যেই পৃথিবীটা ওরা দুজনে মিলে গড়ে তুলেছিল, এই একটা সংবাদ নিমেষের মাঝে তা ভস্মীভূত করে দিল। ওর জীবনটা যেই শুভকে ঘিরে আবর্তিত হত, সেই শুভ নিজের বলয় ছেড়ে চলে যাবে অন্য এক জগতে। শুভ যেই পরিস্থিতিতে রয়েছে, তানহা ওর বিদেশ যাওয়াটা আটকে রাখার মত স্বার্থপরতা দেখানোর ক্ষমতা রাখেনা। এই শুভ, এই সেই শুভ, যাকে নষ্টের শেষ সীমা থেকে বের করে এনে নতুন এক জীবন দিয়েছিল তানহা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ের কথা। শুভ তখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সে সময় একটা মেয়ে ওকে এক সম্পর্কের বেড়াজালে বেঁধেছিল। তারপর একদিন নিজেই সেই বেড়াজাল ছিন্ন করে শুভর জীবনে আগুন ধরিয়ে দিয়ে মেয়েটা চলে গিয়েছিল। সেই আগুন নেভাতে শুভ মুখাপেক্ষী হয়ে গিয়েছিল এমন এক জীবনযাত্রার যেখানে ঘুমের ঘোরে, কল্পনার জগতে মানুষ কাটিয়ে দেয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময়।

ঘোর কেটে গেলে তীব্র মানসিক যন্ত্রণা শুরু হয়। তাই আবার ঘোরের দেশে ফিরে যেতে হত ওকে। অল্প সময়েই শরীরের উপর অনেক অত্যাচার করে ফেলেছিল সে। হতাশার অতল গহ্বরে যখন শুভ হাবুডুবু খাচ্ছিল, সেই অন্তিম সময়ে মর্ত্যের ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানুষটার পাশে স্বর্গের দেবীর মত এসে দাঁড়িয়েছিল তানহা। সেই সময় শুভর পরিবার-বন্ধুবান্ধব বলতে কোন কিছু অবশিষ্ট ছিলনা।

পাশে ছিল শুধু তানহা। শুধুই তানহা! অসীম ধৈর্য এই মেয়ের। শুভর এক সমুদ্র কষ্টের পুরোটুকু নিজের বুকের কিভাবে কিভাবে জানি সে ধারন করেছিল। বিনিময়ে সে আবার দাঁড় করিয়েছিল ছেলেটাকে। মাথা উঁচু করে সমাজের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ছেলেটা।

আবার সে ফিরে এসেছিল বন্ধুদের কাছে, পরিবারের কাছে। কেউই জানতোনা, সেই সাগরসম কষ্ট গুলো কোথায় গেলো। শুধুই শুভ জানতো। দুজনে ভাগাভাগি করে নিয়েছিল জীবনের ভারটুকু। তানহার নিজস্ব জীবন বলতে তখন কিছু ছিলনা, শুভর সাথে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল ওর দিনগুলো।

তানহাও সময়ের সাথে সাথে নিজের অনেক না বলা কষ্ট গুলো কোন ফাঁকে যে শুভর ঘাড়ে চাপিয়েছিল নিজেই বলতে পারবেনা। তানহার বাসায় কেউ ওকে বুঝতে চাইতনা। বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথের প্রফেসর। রাগী মানুষ। তিনি যা বলবেন তার বিন্দুমাত্র নড়চড় করার সাহস বাসায় কারও ছিলনা।

কিন্তু মেয়ে তাঁর বড়ই আদরের ছিল। মেয়ের সব আবদার তিনি বিনা বাক্যব্যায়ে রক্ষা করতেন। সেই আদরের তানহা ক্লাস নাইনে থাকতে গণিতে খুব খারাপ করে বসলো। তারপর থেকে প্রফেসর সাহেব আর মেয়েকে সেই আদরের স্থানে জায়গা দেননি। যেই মেয়ে বাবা বাড়ি ফিরলে ঝাপিয়ে পরতো কোলে, সেই মেয়ের সাথে মাসের পর মাস কথা হতোনা বাবার।

কিন্তু বাবার নির্দেশ তাঁকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হতো। জীবনটা অনেক সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল ওই সময়টায়। বড় বোন মেধাবী ছাত্রী ছিল, তানহার সাথে কখনোই তাঁর খুব একটা মেলামেশা ছিলনা, উনার বিয়ে হয়ে গেলো যখন তানহা ইন্টারে পড়ে। যোগাযোগ একদমই রইলনা বোনের সাথে। মায়ের সাথে তানহার কথা হতো।

তাও আবার বাবা যা বলে দিতেন মা সেগুলোই তানহাকে জানিয়ে দিতেন; প্রাইভেট, পড়ালেখা ইত্যাদি যাবতীয় ব্যাপার-স্যাপারে। তানহার নিজস্ব জীবন বলতে কিছু ছিলইনা। বাসায় কারও সাথে নিজের মনের কথা, তার নিজের ইচ্ছার কথা বলার মত উপায়ও পায়নি সে। তানহার পড়ালেখা করতে অসহ্য লাগত। তবুও মুখ বুজে বাবা মায়ের কথা মেনে নিত ও।

ইন্টার পাস করেছিল মোটামোটি ভাবে। বাবার সামনে সেই ফলাফল নিয়ে দাঁড়ানোর সাহস হয়নি। ইন্টারের পর বাবা তাকে বেসরকারি একটা ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। একটু স্বাধীনতা এসেছিল জীবনে। কিন্তু বাবার কড়া অনুশাসনের বাইরে যাওয়ার মত সাহস ওর নেই, কখনো ছিলনা।

সেই সময়ে ওর জীবনে শুভ এল। তানহা নিজেওতো ডুবন্ত একজন মানুষ ছিল! হয়তো শুভকে গভীর জল থেকে তুলে আনার চেষ্টা করতে করতে আসলে শুভকে আশ্রয় করেই সে আবার বেঁচেছিল! এরপর কতগুলো বছর কেটে গেলো। শুধু শুভ আর তানহা! শুধুই শুভ আর তানহা! শুভ পাস করে বের হয়ে দেশেই একটা চাকরী শুরু করেছিল, মোটামোটি স্যালারি। ভালই চলে যাচ্ছিল সব কিছু। কিন্তু তানহা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডী পেরোনো মাত্রই বাবা-মা চাপ দেওয়া শুরু করলেন, বিয়ে দিয়ে দিবেন।

একের পর এক প্রপোসাল আসছে। তানহা শুভ কে প্রতিদিন বলে, কবে যাবে আমার বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে, আমি আর ওদেরকে আটকে রাখতে পারছিনা। শুভ সাহস সঞ্চয় করে, নিজের বাসায় সব কিছু জানায়, বাবা-মা কে সহ তানহার বাসায় যাওয়ার পরিকল্পনাও করে ফেলে। নিয়তির কি এক অসহায় করা খেলা! মা হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে গেলেন। শুভ বিয়ে নিয়ে আর কথা বলবে কি! মায়ের চিকিৎসার জন্যে টাকা দরকার! শুভর অনেক অনেক টাকার দরকার।

শুভ অনেকটা ঘোরের মাঝেই বিদেশী ওই অফারটার জন্যে অ্যাপ্লাই করে দিল। আর বাসার সেই অনুশাসনে থাকা তানহাও তার বাবা মা কে আর আটকে রাখতে পারলনা, ঘোরের বসেই যেন সে সম্মতি দিয়ে দিল। শুভকে সে সব খুলে বলল। তানহার বিয়ে ঠিক চারদিন পর শুক্রবার রাতের বেলায়। শুভকে তানহা বলেছিল, 'তুমি শুক্রবার সন্ধ্যায় এসে আমাকে নিয়ে যাবা, আমি এই বিয়ে করতে পারবনা, তুমি তোমার বাসায় আমাকে নিয়ে যাবা।

' শুভ মাথা নাড়লো, না তা হয়না। সে তানহাকে এভাবে নিয়ে যাবেনা। তানহার বাবা মায়ের সম্মতিতে সম্পূর্ণ পারিবারিক ভাবে যদি সম্ভব হয় তাহলেই সে বিয়ে করবে। তানহা ওর হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল, 'তাহলে তুমি তোমার বাবাকে নিয়ে আসবা আমার বাসায় কাল-ই। কথা দাও'।

ঠিক আছে, শুভ তাই করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। সেদিন তানহা ওর বুকে মাথা গুঁজে দিয়ে অনেকটা সময় ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল; যেন কিছুতেই হারিয়ে না যায়। তারপর উঠে দাঁড়াল, অনেক সময় গিয়েছে, বাসায় যেতে হবে। যাওয়ার সময় তানহার চোখে পানি চিক চিক করছে, সে বলল, তুমি না এলে, আমি কিন্তু বিষ খাবো। ' শুভ ওর দিকে তাকিয়েই বুঝে গেলো কথাটা মজা করে বলেনি তানহা।

কিন্তু টাকার জন্যে যে বিদেশের ওই অফারে অ্যাপ্লাই করেছে একথাটা সে জানাতে পারেনি তখন তানহাকে। সেদিন বাসায় ফিরেই শুভ আয়পয়েন্টমেন্ট লেটারটা পেল। সাতদিনের মাঝে তার দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে, বিনিময়ে মা বাঁচবেন, আর চারদিন বাদে তার তানহার বিয়ে হবে! আরেকটা মানুষ নিয়ে যাবে তানহা কে! কি এক পরিস্থিতিতে ওকে ফেলেছেন বিধাতা! শুভ নাস্তানাবুদ হয়ে গেলো; কি করবে কিচ্ছু ভেবে পাচ্ছেনা সে। অবশেষে সেই নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেই বাধ্য হতে হল ওকে। ও তানহাকে ফোন করে জানালো ব্যাপারটা।

কানে ফোন ধরে তানহা বজ্রাহতের মত শুনল, কিছুই বলতে পারলনা, শুভকে বাঁধা দেওয়ার মত স্বার্থপর যে সে ছিলনা তাতো আগেই বলেছি। যেই শুভ তার পৃথিবী ছিল, সেই শুভ তাকে ছেড়ে দুরের দেশে পারি জমাবে। তানহা সাথে সাথেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে কি করবে। এই সিদ্ধান্তের কথাও আগেই সে শুভকে একবার বলেছে! হাতব্যাগে রাখা ছোট্ট শিশিটার দিকে একবার তাকালো ও। শুভ চলে গেলে, যেহেতু সত্যিকার অর্থে জীবন বলতে ওর কিছু থাকবেনা, সেহেতু শুধু শুধু শরীরে প্রান বয়ে বেড়ানোর কোনই মানে থাকতে পারেনা।

শুভ যেন তানহার চিন্তাগুলো পরিষ্কার পড়তে পারছিল। সে অসহায়ের মত ভেবে যাচ্ছে কি করা যায়। সে নিজেইবা কিভাবে সহ্য করবে, তানহা আরেকজনের হয়ে গেলে! নাহ! তাকে ওই দিনই চলে যেতে হবে। শুক্রবারই শুভ চলে যাবে দেশ ছেড়ে। শুভ তানহাকে শুক্রবার দুপুরে দেখা করতে বলল।

যে করেই হোক, তানহা ম্যানেজ করে যেন তার সাথে দেখা করে। সেটাই যে ওদের শেষ দেখা হবে দুজনেরই তা জানা আছে। খুব শক্ত থাকবে এমন প্রস্তুতি নিয়ে এলেও, যখন শুভ ওর সামনে এসে দাঁড়ালো, অঝোর ধারায় অশ্রু বিন্দু নেমে এলো তানহার চোখ থেকে। শুভ ওকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। কেঁপে কেঁপে উঠছে শুভর বুকে তানহার শরীরটা।

সে কেঁদেই যাচ্ছে, নিজেকে সামলাতে আজ আর পারছেনা সেই শক্ত মেয়েটা! এতোটা অসহায় দুটো মানব-মানবী! এদের কিছুই যে করার নাই, ভাগ্যের কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়া ছাড়া। তানহাকে বুক থেকে তুলল শুভ, খুব আলতো করে দুহাত দিয়ে ওর দুই বাহুতে ধরে, চোখে চোখে রাখল শুভ, তারপর বলল, আমাকে একটা কথা দাও। তানহার চোখে তখন প্রশ্ন। শুভ আবার বলল, 'কথা দাও তুমি বেঁচে থাকবা। ' এই কথা শুনে আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো তানহা।

এই কথা সে কিভাবে দিবে শুভকে? নাহ, এটা তো সম্ভব না ওর জন্যে। কোনভাবেই সম্ভব না। শুভ কতটা নিষ্ঠুর হলে এই কথা চায় ওর কাছে! সে পাগলের মত শুভ কে মারা শুরু করল হাত দিয়ে, খামচি-আঁচড়। চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে আর তানহা উন্মাদের মত শুভকে আঘাত করছিল, অসহায়ত্বের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছানো শুভর চোখেও তখন অশ্রু বিন্দু। সে নীরবে সেই মানবীটাকে আবার জড়িয়ে ধরে বলল, 'কথা দাও।

' অনেকক্ষণ মুখ গুঁজে থেকে শান্ত হয়ে এলো তানহা। 'ঠিক আছে, কথা দিলাম... আমি বেঁচে থাকব। ' তখন শুভ জানালো, আজ রাতেই তার ফ্লাইট। পাঁচ বছরের জন্যে সে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে আজ রাতেই। প্রায় বিকাল হয়ে এসেছে তখন, তানহাকে বাসায় যেতে হবে।

অনেক কষ্টে সে মায়ের কাছ থেকে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে এসেছিল। বাসায় পৌঁছেই হালকা সাজুগুজুর আসর বসবে, খুব জমকাল বউ সাজানোর দিন আজকাল আর নেই। তানহা খুব শক্ত মনে উঠে দাঁড়ালো। শুভকে কথা দিলেও সে তো জানে সে আসলে কি করবে। এটা ভাবতেই প্রচণ্ড আনন্দ লাগছে ওর, একটু পরেই এইসব কষ্টের কোন অবশিষ্টাংশই থাকবেনা।

আহ! কি শান্তি! শেষবারের মত ভালবাসার মানুষটাকে প্রানভরে দেখে নিল তানহা। তারপর আবদারের ভঙ্গীতে বলল, আমাকে একটা চুমু খাবা?? এই দীর্ঘদিনের প্রেমে এই আবদারটা তানহা কখনো করেনি। এটা পরের জন্যে তোলা ছিল। সেই তানহা আজ শুভকে বলল, একটা চুমু খেয়ে দিতে! এই জীবনেতো দুজনের কারোই আর চুমু খাওয়া হবেনা। তানহা জানে, সে একটু পরেই না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে।

ওদিকে শুভ বেঁচে থাকতে তানহা ছাড়া কাউকে নিয়ে কল্পনা করার মত ক্ষমতা রাখেনা। তাই এই আবদারটা আজ শুভ ফেলতে পারলনা। বিয়ের পর অনেক চুমু খাবে ঠিক করে রেখেছিল, সেই বিয়েটাই তো আর হচ্ছেনা ওদের। একবার চুমুতো খাওয়া যায়। একগাদা আবেগ আর অসীম ভালবাসা নিয়ে শুভ তার ঠোঁট তানহার বন্ধ দুই চোখে ছুঁয়ে দিল।

তারপর বলল, 'যাও...'। তানহা হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো, বলল, 'শুভ, তোমাকে ভালবাসি। আর তো দেখা হবেনা, নিজের যত্ন নিবা। সুন্দর দেখে একটা বউ নিয়ে আসবা দেশে ফিরে। তবে আমি কিন্তু অপেক্ষা করব তোমার জন্যে, মৃত্যুর ওপারে যদি কিছু থেকে থাকে, সেখানে।

ঠিক আছে?' শুভর মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জোরে হাঁটা দিল, তারও তো গোছগাছ করতে হবে, বাসায় ফেরা দরকার। নাকি চোখের পানি যাতে মেয়েটা দেখতে না পায় সেই ব্যবস্থা করলো সে?? সন্ধ্যার দিকে, তানহার বাসা লোকে-লোকারন্য। নটার সময় বিয়ে হবে। তানহা বিকেলে বাড়ি ফেরার পর তাকে সাজগোজ করানো হয়েছে। বিয়ের কনে চুপচাপ বসে আছে।

হাতে সেই ছোট্ট শিশিটা। খুব আড়াল করে রেখেছে। তানহার ভার্সিটির কিছু বান্ধবী খুব হুল্লোড় করছে আশেপাশে। রাত আটটায় শুভর ফ্লাইট। শিশিটা তখনই গলায় ঢালবে তানহা।

ঠিক আটটায়। মুহূর্তের মাঝে বাসার পটভূমি পরিবর্তিত করে দিবে চুপচাপ বসে থাকা এই মেয়েটা। বিয়েবাড়ি কে বানিয়ে দিবে শ্মশান বাড়ি। সাতটা বেজে তিরিশ। তানহা উঠে দাঁড়ালো।

সে জানে তার বাবা হই-হুল্লোড় অপছন্দ করেন। এইসব বিয়েবাড়ির ঝামেলায় তিনি থাকবেন না। নিজের রুমে চুপচাপ বসে থাকবেন। বাবার সাথে তানহার কথা ছিল। বাবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো সে।

আজ তার তেমন ভয় লাগছেনা। হাতে সেই প্রবল শক্তি-শালী অস্ত্র। যেই অস্ত্র সে ব্যবহার করবেনা এই কথা দিয়ে এসেছে শুভকে। শুভর কথা রাখতে হলে বাবার সাথে এখনই কথা বলতে হবে। প্রফেসর সাহেব ভেতরেই ছিলেন, তানহা ঘরে ঢুকল।

প্রফেসর সাহেব কিছুটা অবাক হলেন ওকে দেখে। কি অপরূপ লাগছে তার মেয়েকে। সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ কত বড় হয়ে গিয়েছে। প্রচণ্ড মমতা জেগে উঠলো তাঁর মনে। সেটা গোপন করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, 'কি হয়েছে? কিছু বলবি?' একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে তানহা বলতে শুরু করল... শুভর কথা... তার ভালবাসার কথা।

বাবার সাথে দীর্ঘকাল পর আজ সে কথা বলছিল, অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে বাবার কাছে সে প্রত্যেকটি ঘটনা বলে ফেলল। সে কিন্তু আজ একটুও থমকালো না, একটুও ভয় পেলনা বাবাকে। সেই ছোট্ট মেয়েটি যেমন তার রাগী বাবাকে একটুও ভয় না পেয়ে আবদার জানাতো, সেই ছোট্ট মেয়েটিতে পরিণত হয়ে গেল তানহা তার বাবার কাছে আজ, আবারো আরেকবার। বাবা অবাক চোখে তাঁর ছোট্ট খুকির দিকে তাকিয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। আগের সেই বাবা, আগের সেই আহ্লাদি মেয়ে! প্রফেসর সাহেব মুখ খুললেন, -'মামণি' -'হু' -'তোর এই বিয়ে করতে হবেনা!' -'হু' -'তোর যা মন চাবে, তুই তাই করবি...' -'হু' -'হু! হু! করছিস কেন? খুশী এখন?' -'হু' -'হাত মুঠি করে আছিস কেন? দেখি হাতে কি?' তানহা তার হাতের শিশিটা বাবার হাতে দিল।

ব্যাপারটা প্রফেসর সাহেব বুঝতে পারলেন। -'এটা আজ তুই খেয়ে ফেলতি?' -'হু' প্রফেসর হেসে ফেললেন, 'হায়রে আমার সর্বনাশী মেয়ে রে! এত সাহস তোর! এটা খাওয়া লাগবেনা তোর মামনি...' ছোট্ট মেয়েটি যেভাবে বাবার বুকে ঝাপিয়ে পরতো বহুবর্ষ আগে, আজ আবার, ঠিক সেইভাবে ঝাঁপিয়ে পরলো। প্রফেসর সাহেব মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে, কপালে আলতো করে একটা চুমু খেলেন। ম্যাথ পারেনা তো কি হয়েছে? সবাই সব কিছু পারেনা। বাবার কাছে এত্ত আহ্লাদী করতে আর এত্ত আদর নিতে সবাই তো পারেনা।

তাঁর মেয়ে ম্যাথ পারেনা, কিন্তু ভালবাসতে পারে!... সেই ছোট্ট তানহা মামনিকে ফিরে পেয়েই আজ প্রফেসর সাহেবের মন ভরে গেলো। সেই বিয়ে ভেঙ্গে দিলেন তিনি। বরপক্ষ যখন ঠিক রওনা দিচ্ছে নিজেদের বাসা থেকে তখন তাঁদের কাছে প্রফেসর সাহেবের ফোন গেল। অনেক অপমানজনক কথা বলা হল তাঁকে, তিনি সহাস্য-বদনে সব মেনে নিলেন। তাঁর ছোট্ট খুকির জন্যে একটু নাহয় সহ্যই করতে হল তাঁকে।

শুভকে সাতটা পঞ্চাশে ফোন দিয়েছিল তানহা, প্লেনে বসা শুভ ঠিক সেই মুহূর্তে ফোনটা বন্ধ করে দিচ্ছিল। হড়বড় করে সব বলে ফেলল তানহা। ঠিক সে মুহূর্তে এদের দুজনের চেয়ে সুখী পৃথিবীতে কেউই ছিলনা মনে হয়। যাই হোক, পৌঁছেই শুভ চাকরীতে জয়েন করে ফেলেছিল। অনেক টাকা ওর হাতে; মায়ের চিকিৎসা শুরু হয়ে গিয়েছে।

মা ভাল হয়ে উঠছেন ধীরেধীরে। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে তানহা হালকা করে ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে, চুলটা একটু আঁচড়িয়ে নিল। পাসপোর্ট সাইজ ছবি তুলতে হবে তাকে... ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।