আমি একজন ভাল ছেলে । সুন্দরবন ঘেঁষা রামপালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ মালিকানায় প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার প্রস্তাব গত পরশু রবিবার অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন করেছে। ফলে এবার ওই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। তবে কেন্দ্রটি নির্মিত হলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতার ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র বাগেরহাটের রামপালে সুন্দরবনের পাশে নির্মিত হবে।
এটি নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেড (বিআইএফপিসি) নামের কোম্পানিটি গঠিত হয়েছে। কোম্পানিটি গত সপ্তাহে যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন পেয়েছে। এ কেন্দ্র থেকে ২০১৫ সালে বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা থাকলেও স্থানীয় জনগণের আন্দোলন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের চূড়ান্ত অনুমোদন না পাওয়ায় বিদ্যুৎ পেতে ২০১৬-১৭ পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।
বলাবাহুল্য, এই অনুমোদন দুঃখজনক। এর মধ্য দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে বুঝিয়ে দেয়া হলো যে পরিবেশের ছাড়পত্রটি যেন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পক্ষেই দেয়া হয়।
সরকারই যদি আইন না মানে তাহলে আইন মানবে কে? রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, কোন সংরক্ষিত বনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যায় না। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার করা হচ্ছে রামপালে যেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হতে যাচ্ছে, তা সুন্দরবনের ১৪ কিলোমিটারের বাইরে।
কিন্তু বৈশ্বিক অবস্থান নির্ণয় পদ্ধতি বা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) পরিমাপ করলে সরকারের দেয়া তথ্যের মধ্যে গরমিল পাওয়া যায়। সরকার যেখানে বলছে সুন্দরবনের ১৪ কিলোমিটারের বাইরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, সেখানে বিজ্ঞানীরা বলছে এ দূরত্ব বন থেকে মাত্র দুই কিলোমিটারের মধ্যে।
জিপিএস ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা দেখেছে, প্রস্তাবিত প্রকল্প সুন্দরবনের প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকার মধ্যে পড়েছে। জিপিএস কো অর্ডিনেট, এক্স : ৮৯.৬৯১৬০ এবং ওয়াই : ২২.৪২৭৭৫ নেয়া হয়েছে পশুর নদের প্রান্ত থেকে, যেখানে রামপালের এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সীমানা শুরু। এই পয়েন্ট থেকে সুন্দরবনের দূরত্ব মাত্র ১.৩ মাইল বা ২.০৯ কিলোমিটার। বিদ্যুৎকেন্দ্রের আরও ভেতর থেকে নেয়া আরেকটি হিসাব বলছে, বনের দূরত্ব সেখান থেকে মাত্র ১.৯ মাইল বা তিন কিলোমিটার।
পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১১ সালের ২৩ মে রামপালের কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অবস্থানগত ছাড়পত্র দেয়।
এতে বলা হয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের পূর্ণ সম্মতি অর্থাৎ এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) না হওয়া পর্যন্ত কোন যন্ত্রাংশ আমদানির জন্য ব্যাংক ঋণপত্র (এলসি) খোলা যাবে না। পানিভূমিও ভরাট করা যাবে না। এসব শর্ত ভাঙলে অবস্থানগত ছাড়পত্র বাতিলের পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেয়া হবে। অবশ্য বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে। পিডিবি’র মাটি কাটার আটটি যন্ত্র দিয়ে সমানে সীমানা নির্ধারণের জন্য মাটি ভরাট চলছে।
শ্রমিকদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্পও বসানো হয়েছে। জোর করে ঘরবাড়ি উচ্ছেদ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে ধীরে ধীরে সুন্দরবন ও আশপাশের নদীগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। ২০১১ সালের ৫ মে মোমেনশাহী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে পরিবেশবিদদের একটি দল প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জায়গা পরিদর্শন করে। তারা নিবিড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ২৩ ধরনের ক্ষতির হিসাব তুলে ধরে।
তাদের মতে, সুন্দরবনের স্বাভাবিক চরিত্র বিনষ্ট হবে, তৈরি হবে অসংখ্য কয়লাডিপো, শুরু হবে গাছ কাটা, বনে আগুন লাগানো এবং বাঘ, হরিণ ও কুমির ধরা। কয়লা পোড়া সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন প্রভৃতি সুন্দরবনের জীবম-ল ও বায়ুম-লকে দূষিত করবে। সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন যৌগসমূহ থেকে সৃষ্ট গ্রিন হাউস গ্যাস বনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এসিড বৃষ্টি ঘটাবে।
ওই গবেষণা শেষে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সতর্ক করে বলা হয়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের প্রকৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ুর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পুরো কার্যক্রম শিগগিরই বন্ধ করা উচিত।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সচল হলে হারিয়ে যাবে বিরল প্রজাতির গাঙ্গেয় ও ইরাবতী ডলফিন। এসব ডলফিন শুধু বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকার পশুর নদেই দেখা যায়। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বাগেরহাটের মংলা, চাঁদপাই ও শরণখোলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পশুর নদ ও শ্যাওলা নদীকে গাঙ্গেয় ও ইরাবতী ডলফিনের সংরক্ষণ এবং বংশবৃদ্ধির স্বার্থে গত ২৯ জানুয়ারি বন্য প্রাণী ‘অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
পিডিবি সূত্র জানায়, প্রতি ঘণ্টায় রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য ১৪৪ কিউসেক পানির প্রয়োজন হবে। এক হাজার ফুট গভীর থেকে এই বিপুল পরিমাণ পানি তুললে এ অঞ্চলের ভূ-অভ্যন্তরে লবণ পানি ঢুকবে, যা মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ডেকে আনতে পারে।
ভারতের গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, এনটিপিসি’র একই ধরনের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল হয়ে গেছে পরিবেশ অধিদপ্তরের বাধার মুখে। এনটিপিসি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করতে চেয়েছিল মধ্য প্রদেশের নরসিংহপুর জেলায়। প্রস্তাবিত ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে একটি সংরক্ষিত বন থাকায় দেশটির পরিবেশ অধিদপ্তর সেটি নির্মাণের অনুমতি দেয়নি। প্রসঙ্গত প্রশ্ন হলো ভারতে যদি পরিবেশ দূষণের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন না পায় তাহলে বাংলাদেশে পায় কী করে? সরকারের উচিত এ বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের পাশে না করে অন্য কোন সুবিধাজনক স্থানে করা। পাশপাশি এটি বিদ্যুৎ দানের নামে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সম্পদ সুন্দরবন ধ্বংসের ভারতীয় ষড়যন্ত্র কিনা তাও গভীরভাবে খতিয়ে দেখা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।