আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুন্দরবনের দিকে যাত্রা।

"বিশ্ব কবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ জীবনানন্দের রূপসি বাংলা, রুপের যে তার নাইকো শেষ " বিশাল এ ধরণীতে বিচিত্র ধরনের পরিবেশ দৃশ্যমান , কোথাও শ্যমল-সবুজ ক্ষেত, কোথাও নিবিড় অরণ্য ,কোথাও বৃক্ষশন্য প্রান্তর। বাংলাদেশ এক বিস্ময়। কবির ভাষায় তাই বলা হয় আমাদের দেশটা ছবির মত। বাংলাদেশের বনজ নিদর্শন সমূহের মধ্য সুন্দরবন অন্যতম। এটা দেশের সবছেড়ে বড় বনভূমি।

তাই সুন্দরবন দেখার সাধ কার না জাগে? আমি অধির আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম কখন সুন্দরবন যাওয়ার সুযোগ পাব। কিন্তু সুযোগতো হঠাৎ করে আসেনা । একদিন দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নোটিশ বোর্ডে এবারে শিক্ষা সফর সুন্দরবন। আমার অপেক্ষার বাঁধ আজ নিমিষে ভাঙল আনন্দের বন্যায়। সময়টা ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস।

আমরা চট্টগ্রাম থেকে সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। দুপুর একটায় অশান্ত আনন্দমুখোর কোলাহলের মধ্যদিয়ে আমাদের বাস দুরন্ত গতিতে ছুটে চলল । দুই পাশে ফলের বাগান, ফুলের সুশোভিত গ্রান, আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে । পশ্চিম আকাশে সূয্য ডুবে যাচ্ছে আর আমাদের অভিনন্দিত করছে । এভাবে আমাদের পথ অতিক্রান্ত হতে লাগলো সুন্দরবনের দিকে।

রাত ১১ টায় আমরা মাওয়া ফেরিঘাটে এসে ফেরিতে উঠলাম । যখনি ফেরি ছাড়ল তখন রাত বারটা। শুরু হল একুশে ফেব্রুয়ারির প্রহর। সবাই আমাদের শ্রদ্দেয় রিয়াজ স্যারের সাথে সুর মিলিয়ে গান গেঁয়ে শ্রদ্দা জানালাম আমাদের ভাষা শহিদদের- “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমিকি ভুলিতে পারি?” আমাদের বহনকারী ফেরি পদ্মা নদি আতিক্রম করছে । আর অমবস্যার ঘোর অন্ধকারে তারকারাজির মিটমিট আলোর মধ্য দিয়ে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম নীলিমার সৌন্দ্রয্য ।

আমাদের দির্ঘ যাত্রা অতিক্রান্ত করার পর আমরা সকালের বিশ্রাম নেওয়ার জন্য অবস্থান করলাম “হোটেল পশুর” এ । সকালে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা সবাই রওয়ানা করলাম সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে. আমাদের যাত্রাক্ষনটা ছিল উজ্জল সুয্যের প্রতিপলিত একটি দিন , বোট যাত্রা করল হাড়বাড়িয়া ইকো টুরিজমের দিকে। সকালের মৃদু বাতাস আমাদেরকে তার কোমল হওয়া দিয়ে আপ্যায়িত করছে। সূয্য তার রঙ্গিন হাসি দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে। আর ডানে বামে যে দিকে তাকাই নানা প্রকার গাছ -পালা , লতা- পাতা,নানা শস্য সারিবদ্দ ভাবে আছে মনে হচ্ছে আমাদেরকে অভিনন্দন করতে তারা কাতারবদ্দ হয়ে আছে ।

বিশাল সমুদ্রের মাঝে কতগুলো ভাসমান দ্বীপ নিয়ে সুন্দরবন। এ দ্বীপ গুলোর সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে । আমরা দুপুরে ১ ৩০ মিঃ “হাড়বাড়িয়া ইকো টুরিজম সেন্টারে”পৌঁছলাম । এখানে এসে আমার মনে হচ্ছে আমি অরন্যর নৈসর্গিক শোভা খুঁজে পেয়েছি। আমার চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু গাছের সারি আর সারি।

উঁচু উঁচু গাছগুলো যেন দুরাকাশের কোল ছোঁড়ায় প্রতিযোগিতায় ব্যাস্ত। হাড়বাড়িয়া ইকোটুরিজম সেন্টারে একটু প্রবেশ করতেই কিছু হনুমানকে দেখলাম গাছের ডালে ঝুলে পড়ছে। আরেকটু যেতেই দেখলাম একটা সাপ একটি ব্যাঙকে শিকারের জন্য তাড়াচ্ছে আর ব্যাঙ তার জীবন বাজি নিয়ে দৌড়াচ্ছে। একটু ভিতরে প্রেবেশ করতে দেখলাম অনেকগুলো ছোট ছোট খাড়া গাছের মূল। পায়ে বুট ছাড়া হাঁটা খুবেই কষ্টকর।

এভাবেই আমরা হাড়বাড়িয়া ইকো সেন্টার ঘুরে দেখলাম। বাহির হওয়ার সময় চোখে পড়ল বিচিত্র রঙের পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে। তারপর আমরা রওয়ানা দিলাম করমোজল ট্যুরিজম সেন্টারের দিকে। বুটে আসার সময় তখন ক্ষণিকটা বিকাল ছুঁই ছুঁই । রবির আলোর প্রতিপলন রংধনুর প্রতিচ্ছবি আঁকছে ।

এই মনোরম আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের যাত্রা চলছে স্থির নদীর উপর দিয়ে। করমোজল সেন্টারে পা রাখতেই চোখে পড়ল গাছের মাথায় মাথায় লাফাচ্ছে কতগুলো বানর। একটু ভিতরে যেতেই নজর কাড়ল একটি কুমির প্রজনন কেন্দ্র। আমরা একটা মোরগ দিলাম খেতে, চোখের পলকের মাঝেই জ্যান্ত মোরগটি খেয়ে ফেলল কুমির। একটু পূরব দিকে আস্তেই দেখি অনেকগুলো হরিন একটি মিনি চিড়িয়াখানার মধ্য।

সব মিলিয়ে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় করমোজল সেন্টার দেখতে খুবি মনরোচক। মোট কথা এখানে প্রবেশ করলে সাপ, হরি, কুমির এবং বিভিন্ন পশুপাখি এবং প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য মায়ায় আবদ্দ করে রাখে। পরেরদিন আমরা হিরো পয়েন্টে গেলাম। মনে একটা অজস্র সপ্ন ছিল নিজের চোখে বাঘ দেখা। আজ সেই আশা পূর্ণ হলো।

বোটে করে আশার সময় অনেকগুলো বাঘ চোখে পড়ছিল। এখন অবশ্য ভিতরে একটু দূর থেকে বাঘের গর্জন এবং চেহারাতা দেখতে পাচ্ছি। আমিতো প্রথমে ভয়ে শেষ না জানি তেড়ে আসে। পরক্ষনে বুঝলাম না এটা আমার থেকে অনেক দূরে। এভাবে হিরো পয়েন্টের বিচিত্র দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসল।

আর তখনি রবি ঠাকুরের একটি চরণ মনে পড়ল- “ অন্ধকার গর্ভ হতে শুনেছিলাম সুরযের আহবান প্রানের প্রথম জাগরণে তুমি বৃক্ষ আদি প্রান” এভাবে সুন্দরবনের অপরূপ বিচিত্র শোভা আমাকে মুগ্ব করেছে। আমি সত্যিই অভিভূত হয়েছিলাম। মহান আল্লাহ যেন তার শিল্প- নৈপুণ্য প্রয়োগ করে এ অপরূপ অরণ্য সৃষ্টি করেছেন। এভাবে আমাদের তিনদিনের সুন্দরবন সফর শেষ করলাম। ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন “ Travel in the younger sort , is a part of education, in the elder a part of experience” যুবকদের জন্য ভ্রমন হচ্ছে একটি শিক্ষা আর বৃদ্বদের জন্য ভ্রমন হচ্ছে একটি অভিজ্ঞতা।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।