ফাতিহ তুর্কি শব্দ, এর অর্থ ইংরেজিতে ‘কনকোয়েস্ট’। তবে তুর্কির সুলতান মাহমুদের নামের সাথেই ‘ফাতিহ’ শব্দটি জড়িয়ে আছে, তার নাম উচ্চারন করা হয় – সুলতান মাহমুদ ফাতিহ। ১৪৫৩ সালে টানা ৫৭ দিন অবরোধের পর তুর্কি এই বীরের কনস্টানটিনোপোল (আজকের ইস্তাম্বুল) জয়ের কহিনী নিয়ে তুর্কিরা তৈরী করেছে তাদের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এপিক সিনেমা – ফাতিহ ১৪৫৩।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) ৬২৭ খ্রীস্টাব্দে ওফাতের পূর্বে বলেছিলেন – “Constantinople will surely be conquered. What a blessed commander is its and what a blessed army is its army” এবং এই উক্তিকেই অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করে বাইজেন্টাইন রাজ্যের রাজধানী কনস্টানটিনোপোল জয়ের জন্য এগিয়ে গিয়েছে সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ (Mehmed II)। প্রথমবার সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন মাত্র বারো বছর বয়সে, কিন্তু তার অল্প বয়স রাজ্য পরিচালনায় সমস্যা সৃষ্টি করবে আশংকায় তাকে অল্পদিন পরেই সরিয়ে দেয়া হয়, পরবর্তীতে মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি বিশাল সেনাবাহিনী অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা আর যোগ্যতার সাথে পরিচালনা করে কনস্টানটিনোপোল জয় করেন।
ফাতিহ ১৪৫৩ সিনেমার কাহিনী এটাই, এর পাশাপাশি তরকারীকে উপাদেয় করতে ইরা নামের এক তরুনীর প্রেমে মগ্ন একজন মুসলমান ও খ্রীষ্টান তরুনের ত্রিভুজ প্রেম কাহিনীও ফাঁদা হয়েছে।
মুসলমানদের শৌর্য বীর্যের একটি দারুন চিত্র ফুটে উঠেছে এই সিনেমায়। মুসলমানদের রণকৌশল, প্রযুক্তিজ্ঞান, সামরিক বাহিনীর দক্ষতা, ঐক্য ইত্যাদির মাধ্যমে ৫০০ বছর আগে মুসলমানদের গৌরবময় এক অধ্যায়ের সাথে পরিচিত করে দেয়ার এই চেষ্টা প্রশংসনীয়। বলা হচ্ছে, তুর্কিসহ বিশ্বের মুসলমানদেরকে অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্যেই এই ধরনের সিনেমা নির্মান (সূত্র: গার্ডিয়ান)। তুরস্কের সবচে’ ব্যয়বহুল এই সিনেমার ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে খুব বেশী প্রশ্ন উঠেনি, ইতিহাসকে অনুসরণ করা হয়েছে।
তবে, প্রতিপক্ষ খ্রীষ্টান সম্রাজ্যকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয় নি এবং ক্ষেত্রবিশেষে হীনভাবে উপস্থাপন করার অভিযোগ পাওয়া যায়। এই অভিযোগে লেবাননে ‘ফাতিহ ১৪৫৮’ সিনেমাটির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছে (সূত্র: ডেইলি স্টার, লেবানন)। মুসলমানদের মহৎ করে দেখানোর উদ্দেশ্যে খ্রীষ্টানদের আয়োজনকে ছোট করে দেখানোর অভিযোগও পাওয়া যায়।
যেহেতু ইতিহাস নির্ভর সিনেমা, তাই কাহিনীতে তেমন গোলমাল পাওয়া যায় না, সেই চেষ্টা করাও ঠিক হবে না। হলিউডের সিনেমা দেখে অভিজ্ঞ যে চোখ তার কাছে এপিক এই সিনেমার সিজি অনেক ক্ষেত্রে অপরিপক্কতার চিহ্ন বহন করে।
৮০ হাজার থেকে ২ লক্ষ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে সুলতান মাহমুদ অগ্রসর হয়েছিলেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়, কিন্তু সেই তুলনায় সিনেমা সম্মুখ যুদ্ধের নৈপুন্য খুব বিকশিত নয়। কিন্তু সৈন্যবাহিনীর কস্টিউম সত্যিই বেশ চোখে পড়ার মত। বিশেষ করে, সুলতান মাহমুদের লেবাশ তাকে উপযুক্ত হিসেবে উপস্থাপন করেছে। মুসলমানদের বাকানো আর খ্রীষ্টানদের ক্রসাকৃতির তরোয়ালের মাধ্যমে দুপক্ষকে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াটা অভিনব, এছাড়া পোষাকের নির্বাচনও ভালো হয়েছে। বিরক্ত লেগেছে, অপ্রয়োজনীয় ভাবে বিভিন্ন নারী চরিত্রের উপস্থিতি।
ইরা, হাসান এবংঅন্য খ্রীষ্টান বীরের উপস্থাপন অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে হাস্যকর। হাসান ও প্রতিপক্ষের প্রেমিক অন্য বীর এই ৫৭ দিন ব্যাপী যুদ্ধের ময়দানে কেন কোনরকম বর্ম ছাড়াই চলাচল করতো তা বোধগম্য নয়।
ফাতিহ ১৪৫৩ এর সাথে নাম উল্লেখ করা যেতে পারে রিডলি স্কট পরিচালিত সিনেমা ‘কিংডম অব হ্যাভেন’ এর, যেখানে মুসলিম বীর সালাহউদ্দীন এর বীরোচিত উপস্থাপন লক্ষ্যনীয়। কারিগরী প্রযুক্তির ব্যবহার আর কাহিনী-চরিত্রের বিশ্লেষনে ‘কিংডম অব হ্যাভেন‘ এ সব থেকেই এগিয়ে থাকলেও তুর্কি পরিচালক ফারুক আসকি’র এই উদ্যোগ নি:সন্দেহে প্রশংসনীয়। প্রায় ‘আনটাচড’ মুসলিম ইতিহাসের অন্যান্য গৌরবময় বিষয় তুলে আনার ব্যাপারে অন্যান্য ফিল্মমেকাররা উদ্বুদ্ধ হবেন ‘ফাতিহ ১৪৫৩’ দেখে – সেই শুভকামনা থাকল।
পরবর্তী রিভিউ:
হেমলক সোসাইটি
স্বাগতম দারাশিকো'র ব্লগের ফেসবুক পেইজে ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।