আজ সুনীলের সেই বিক্ষ্যাত কবিতাটা আমার জন্য একেবারে প্রযোয্য হয়ে গেল। “তেত্রিশ বছর কাটল …”।
বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে কোন এক বরুনাও হয়ত দূর কোন এক কালে দিয়েছিল সুবাসিত আতরের প্রতিশ্রুতি। কবিতার মতই আজ তেত্রিশ বছর আমার কাটল ঠিকই, আর সুগন্ধি রুমাল নিয়ে কোন এক রাজকন্যাও রাখেনী প্রতিশ্রুতি।
আজ সেই সব রাজকন্যাদের বড় মনে পড়ছে।
সেই সব কিশোরীদের, যাদের রুপের আগুনে পুড়ে এক কিশোর হয়েছিল যুবক। সেই সব রাজকন্যাদের, যাদের কেউই রাখেনী প্রতিশ্রুতি।
রাজকন্যা সুনয়িনী… কোন এক কলেজ পালানো ঝুম বৃষ্টির দুপুরে, এক দেবদারু গাছের নিচে শিখিয়েছিল রমনীর ওষ্ঠের রহস্য।
রাজকন্যা অমরাবতী… দুহাত ভর্তি যুগল চন্দ্র নিয়ে যার কাছে জানা হল এ সৌরজগত কেন ঘোরে বৃত্তাকার পথে, আর কেন এর কেন্দ্রে আছে এক জলন্ত সূর্য।
আমার সমবয়সী সহপাঠীরা যখন নতুন জানা তরল ও বায়বীয় নেশার স্বাদ চেখে দেখবার ঘোরে ব্যস্ত, তখন আমার সর্বনাশ হল এক সম্পুর্ন অন্য এক নেশায়।
আমি কোনদিন স্পর্শ করিনী সহপাঠীদের সোনালী তরল। কারন ততদিনে জেনে গেছি এক মুঠো চাদেঁর তুলনায় সে শুধুই নর্দমার জল।
ভালই চলছিল আমার মত এক রাখাল বালকের এই সব রাজকন্যাদের দয়া ও করুনায়। কিন্তু দিন কখোনই এক রকম যায়না। সময় সবকিছু বদলায়।
ইউনিভার্সিটির শেষের দিকে চেনা জানা হল বরুনার সাথে। বলাই বাহুল্য বরুনা দেখতে অসাধারন। বরুনা ঘোমটা পরে। বরুনা পড়াশুনায় ভাল। বরুনা হাতে কাচের চুড়ি পরে।
আজ বরুনার মন খারাপ। তবে আমার কেন মন খারাপ লাগে...? আমার কি আসে যায়? বরুনা জানেনা যে তার মন খারপ হলে আমারো মন খারাপ হয়।
এ আমার কাছে নতুন এক ঘোরের মত। বরুনার সাথে দীর্ঘক্ষন কথা বলতে তাললাগে। সে যখন হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথাবলে তার চুড়ির শব্দ ভাললাগে।
কিন্তু এরচেয়ে বেশী কিছু চিন্তায় আসেনা। রমনীর সঙ্গ আমার কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু বরুনা অন্যরকম। রফিক আজাদের কবিতার মত বরুনার সামনে নিজেকে মনে হয় নুলো ভিখেরির মতন। শত রাজ কন্যাদেরও তার সামনে মনে হয় ঘুটে কুড়োনী।
এ এক নতুন অজানা অনুভুতি। মানবীয় শরীরের রক্তমাংস, শিরা উপশিরার টানে এর জন্ম নয়। প্রথম বারের মত বুঝলাম এবার আমি ডুবতে বসেছি।
কিন্তু আমার মতন হতচ্ছাড়া বাউন্ডুলেদের জন্য বরুনা নয়। তবুও কোন এক অনিয়ন্ত্রিত আবেগের ঘুর্নিপাকে আমি ডুবলাম বরুনা নামক এক অথই সমুদ্রে।
খুব আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, বরুনাই আমাকে এই ঘুর্নিপাক থেকে টেনে তুলল, তবে এক প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে।
আমাদের ইউনিভার্সিটির একটি রাস্তায় কিছু কদম গাছ ছিল। এক দিন এই কদম গাছের নিচে দাড়িয়ে বরুনা বলল, “প্রতিগা কর, তুমি শুধু আমার, তুমি কখোনই আর কারো হবে না”। আমি বরুনাকে পেলাম। পেলাম নাকি?
ইউনিভার্সিটি থেকে বের হওয়ার কিছুদিন পরেই বরুনার বিয়ে হয়ে গেল।
আমাদের নিজস্ব আশা, আকাক্ষা অনেক সময়ই আমাদের পরিবার ও সমাজের চাওয়া পাওয়াকে অতিক্রম করতে পারে না। আমি কাউকে দোষ দেই না, নিজেকে ছাড়া। ভাল কিছু পেতে হলে নিজেকে ভাল হতে হয়। আমি তা কখোনই ছিলাম না। অনেক প্রায়সচিত্ত বাকি আছে।
সুনীলের কবিতার শেষ লাইন “তেত্রিশ বছর কাটল কেউ কথা রাখে না”। তবে আমি কথা রেখিছি। আমার সমবয়সী বন্ধু বান্ধব যখন ঘর সঙসার ছেলে মেয়ে নিয়ে ব্যাস্ত আমি তখন এই দূর প্রবাশে নি:সঙ্গ, কথা রেখে চলেছি। হয়ত এই আমার প্রায়সচিত্ত কৈশরের পাপের। এক একটি দিন যায় আর ভাবি কবে শেষ হবে এই শীতল নি:সঙ্গ প্রায়সচিত্তের।
শুধু আশা, এক দিন সে হয়ত জানবে, আমি কথা রেখেছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।