বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুর্নীতিবাজদেরকে অপসারন করুন দ্রব্যাদি পিটিয়ে গুঁড়া করার জন্য কান-উঁচু লৌহপাত্র এবং তদসংশ্লিষ্ট লৌহদণ্ডকে বলা হয় হামানদিস্তা। আমাদের দাদা-দাদী, নানা-নানীর স্মৃতির সাথে এই হামানদিস্তার স্মৃতিটি জড়িয়ে আছে। অর্থাৎ বেয়ারা বা শক্ত কোনো কিছুকে গুঁড়া বানানোর জন্য সভ্যতার ঊষা লগ্নেই এই সরল গ্রাইন্ডিং যন্ত্রটি আবিষ্কৃত হয়। প্রথম দিকে এই আবিষ্কারটি শুধু মানবকল্যাণে ব্যবহার হয়ে থাকলেও ধীরে ধীরে তা হিংসাত্মক কাজ ও ভাবনায় ব্যবহৃত হতে থাকে। বিশেষ করে কাউকে হুমকি দিতে এই যন্ত্রটির জুড়ি নেই।
কারো প্রতি বেশি রেগে গেলে সম সাইজের একটা হামানদিস্তার কথা সর্বাগ্রে মনে পড়ে। মধ্য রাতে যারা টকশো করে সরকারের গলা কাটছেন তাদের এমন একটা হামানদিস্তায় ভরতে পারলে এই সময়ে খারাপ হতো না।
কাজেই ধাতব হামানদিস্তা ছাড়াও অধাতব অনেক হামানদিস্তা এই সমাজে সৃষ্টি হয়েছে। অত্যাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থা শত শত হামানদিস্তায় জনগণকে পিষে ফেলে। একসময় মেয়েদের চার দেয়ালে আটকে ফেলেছিল ‘পুরুষতন্ত্র’ নামক হামানদিস্তা।
এখন বিপরীত প্রান্ত থেকে লিঙ্গ সমতার হামানদিস্তা মেয়েদের আরো ভয়াবহ বিপদে ফেলে দিচ্ছে। পুরুষতন্ত্রের খারাপ প্রভাবটি সহজেই চোখে পড়ে। কিন্তু লিঙ্গসমতার এই হামানদিস্তার গোপন মাইরটি প্রায়ই লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়। প্রাকৃতিক ও সামাজিক দায়িত্বের ফেমিনিন অংশটুকু তো পালন করতেই হয়, অধিকন্তু মতলববাজ পুরুষ তাদের কিছু ‘ম্যাসকুলিন’ দায়িত্ব লিঙ্গ সমতার নামে মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
দ্বিতীয়বারের মতো মেরিন অ্যাকাডেমিতে মহিলা ক্যাডেট ভর্তি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
উদ্দেশ্যটিও অত্যন্ত মহৎ ও পরিষ্কার। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ লিঙ্গ-সমতার এই ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করে সফল হয় নাই। যেসব সমাজে ও সংস্কৃতিতে জেন্ডারগত পার্থক্য প্রায় শূন্য করে ফেলা হয়েছে তাদের মার্চেন্ট নেভিতেও হাতেগোনা কয়েকজন মেয়েও দেখতে পাওয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ও বাঙালি সংস্কৃতির এই দেশটিতে এমন কী তাগিদ সৃষ্টি হয়েছে যে মেয়েদের এই পেশাতে টেনে আনতে হবে? দেশের হাজার হাজার মেধাবী ছেলে যেখানে বেকার হয়ে পড়ে রয়েছে, সেখানে সম্পূর্ণভাবে ‘ম্যাসকুলিন’ একটা প্রফেশনে মেয়েদের ঠেলে দেয়া কতটুকু বুদ্ধিমানের কাজ? আসলে বিভিন্ন চেতনার নামে বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎটিতেও এক ধরনের লাঠিয়ালদের রাজত্ব শুরু হয়েছে। এদের সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রশাসনিক প্রভাব ও চাপে পড়ে আমরা অনেক সময় ঢেঁকি গিলতেও বাধ্য হই।
কারণ অবস্থাটা এতটুকুই সঙ্গিন যে মহিলাদের মেরিন এডুকেশনের বিরুদ্ধে অবস্থান এবং তালেবানদের নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থানকে সমান বানিয়ে ছাড়বে এ দেশের বুদ্ধিজীবীকুল।
কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতা মেয়েটির হাত-পা বেঁধে শ্বশুর বাড়িতে ঠেলে দেয়। মেয়েসন্তান নিয়ে হাঁপিয়ে পড়া বাবা-মা আর কিছু ভাবতে চান না। লিঙ্গ সমতার সর্বশেষ ক্রেডিট নিতে ব্যস্ত মেরিন প্রশাসন এই কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতার মতোই বিবেক ও মগজশূন্য হয়ে পড়েছেন। এই মহিলা ক্যাডেটটিকেও ঠেলে দিচ্ছেন এমন একটা পরিবেশে যেখানে দিনের পর দিন ২৪ ঘণ্টা কাটাতে হবে তার সব ‘ বিবাহিত ও অবিবাহিত’ ব্যাচেলর সহকর্মী পুরুষদের সাথে।
রাতের দ্বি প্রহরেও একাকী জাহাজের কাজটি চালিয়ে যেতে হবে। মধ্য রাতে শুধু সিঁধকাটা চোর ও সরকারের গলা কাটারাই বের হয় না, নারীত্বের গলা কাটারাও বের হতে পারে। কারণ মহাত্মা গান্ধীর মতো আত্ম-নিয়ন্ত্রণের ‘সার্টিফিকেট অব কমপিটেন্সি’ সব সমাজের পুরুষদের থাকে না। কাজেই কোন সমাজের পুরুষটি রুপচান্দা আর কোন সমাজেরটা মাংসখেকো পিরানহা তা বোঝার উপায় নেই। জাহাজের ব্যবসায়টি এমনিতেই মালিক পক্ষের জন্য একটা চরম হেডেক বা মাথাব্যথার কাজ।
কাজেই অতিরিক্ত এই হেডেকটুকু নেয়ার মতো রোমান্টিক জাহাজ মালিক বা ম্যানেজার পৃথিবীতে আসলেই খুব কম রয়েছেন।
জাহাজের মালিকপক্ষ তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুব যতœ নিয়ে খাইয়ে থাকেন ও চিকিৎসার দেখভাল করেন। অতিরিক্ত এই দরদটুকুর কারণ এদের গতরগুলোকে ঠিকঠাক রাখা জাহাজ ও ব্যবসায়ের নিরাপত্তার স্বার্থেই দরকার। জাহাজের প্রতিটা র্যাংকের সার্বক্ষণিক সেবা জরুরি। একজনের কাজ অন্যজনের পক্ষে করা সম্ভব নয়।
এমতাবস্থায় মহিলা অফিসারটির মাসিক চক্র বা শরীর খারাপের সাথে সাগরের এই মন খারাপ হওয়া সিংক্রোনাইজ হয়ে পড়লে বা ঐকতান সৃষ্টি করে বসলে তখন ওই নেভিগেটর বা ইঞ্জিনিয়ারটি কিংবা তার হাতে ছেড়ে দেয়া জাহাজটির অবস্থা সহজেই অনুমেয়। এই অবস্থায় মেয়েটি কিংবা মালিক পক্ষের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের জাহাজ ও কার্গো কি আসলেই নিরাপদ থাকবে? জাহাজে এই ধরনের অনেক পরিস্থিতি বা অপারেশন রয়েছে, যা মেয়েদের বাধ্যবাধক অসুস্থকালীন সময়টিতে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব ছাড়াও ‘লেডিজ কমফোর্ট’ বলে একটা কথা রয়েছে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’ এমন সংস্কৃতির একজন মেয়ের শারীরিক অবস্থাটি পুরুষ মহলে ব্রডকাস্ট করা ছাড়া উপায় থাকবে না। বিমানের বৈমানিক, এয়ারহোস্টেজ, সেনাবাহিনীর মতো চ্যালেঞ্জিং কাজগুলোতেও শিডিউল অ্যাডজাস্ট করে এই বিশেষ সময়গুলো এড়ানো সম্ভব।
কিন্তু সমুদ্রগামী জাহাজের কোনো অফিসারের পক্ষে তা আদৌ সম্ভব নয়। এই সব কিছু বিবেচনায় পেশাটিকে গণ্য করা হয় ‘ম্যাসকুলিন’ প্রফেশন হিসেবে। পুরুষদের দিয়ে সন্তান প্রসব করানো এবং মেয়েদের জাহাজে ঠেলা দেয়া প্রায় কাছাকাছি। লিঙ্গ সমতার হামানদিস্তা তাই করিয়ে ছাড়ছে।
সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে, এই উদ্যোগটি নেয়ার পেছনে যার সবচেয়ে বেশি অবদান তিনি নিজেও একজন মেরিনার।
তিনি হলেন অ্যাকাডেমির বর্তমান কমান্ডেন্ট আমাদের প্রিয় সাজিদ ভাই। জাহাজের সার্বিক পরিবেশ ও বিশ্ব মার্চেন্ট নেভির ম্যাসকুলিন চেহারার পেছনের কারণটি তার অজানা নয়। নিজেকে একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেন তিনি। ফলে তার আওয়ামী কানেকশন সরবে প্রকাশ করতে তিনি কোনো সঙ্কোচ বোধ করেন না। তিনি এই পদের অযোগ্য তা বলছি না।
তবে তার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উৎসারিত অনেক কাজকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যার অবকাশ নিজেই সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগে যে যত ওপরের দিকে উঠতে থাকেন তিনি তত যুক্তি ও বাস্তবতাকে ‘থোরাই কেয়ার’ করেন। তার এই উদ্যোগ দেখে অনেকের মাঝে সেই ধারণাটি আরো শক্ত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসের মতো করে মেরিন অ্যাকাডেমির ইতিহাসকে নতুন করে লেখা হচ্ছে। মেরিটাইম ঐতিহ্য সংবলিত টার্ম ও ট্র্যাডিশনগুলো বাদ দিয়ে দেশীয় স্টাইলে মেরিন অ্যাকাডেমিতে নামকরণ শুরু হয়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই নামকরণে প্রস্তাবকের কিছুটা বৈষয়িক উন্নতি হলেও স্বয়ং বঙ্গবন্ধু কিংবা এই ঐতিহ্যবাহী অ্যাকাডেমির কোনো কল্যাণ চোখে পড়ছে না।
মেরিন অ্যাকাডেমিকে সব ধরনের রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখাই সবার কাম্য। তবে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির অবদানকে স্মরণ করতে হলে পাকিস্তানের সাবেক স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীকেই প্রথমে স্মরণ করতে হয়। পাকিস্তানের একমাত্র মার্কেন্টাইল মেরিন অ্যাকাডেমিটি হওয়ার কথা ছিল করাচিতে।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের অনুপস্থিতিতে কয়েক দিনের জন্য প্রেসিডেন্টের ভারপ্রাপ্ত হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো দুই-একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে এই মেরিন অ্যাকাডেমিও চিটাগাংয়ের জুলদিয়াতে নিয়ে এসেছিলেন এই ‘সান অব চিটাগাং’। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান নাকি চৌধুরী সাহেবের এই মনোভাব টের পেয়ে তাড়াহুড়ো করে দেশে ফিরে এসেছিলেন। এই গল্পটি চাটগাঁয়ের সবার মুখে মুখে ঘুরলেও সাজিদ ভাইদের নান্দনিক প্রচেষ্টায় ইতিহাসের এই অনান্দনিক উপাদানগুলো সঙ্গত কারণেই স্থান পায় নাই।
’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালি শহীদদের মধ্যে খুঁজতে গিয়ে মেরিনার পাওয়া গেছে মাত্র একজন। তিনি মেরিন অ্যাকাডেমির নবম ব্যাচের শহীদ লিয়াকত হোসেন।
শহীদ লিয়াকত হোসেনের আপন বোনের ছেলে আমাদের ২১তম ব্যাচের মোতাহার হোসেন। তার জন্য একটা অপূর্ব সুযোগ ছিল ‘বালক’ মুক্তিযোদ্ধা দাবি করার। কিন্তু সেই সুবর্ণ সুযোগটি বেচারা হেলায় হারিয়েছেন কিছুটা উল্টো পথে চলতে গিয়ে। তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট। লিয়াকত সাহেব বিয়ে করার আগেই যেহেতু শহীদ হয়েছেন, কাজেই তার পক্ষ থেকে কোনো পুরস্কার গ্রহণের সবচেয়ে ন্যায্য দাবিদার, রক্তের ও পেশার উত্তরাধিকারী মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মোতাহার হোসেন।
কাজেই মেরিন অ্যাকাডেমিকে পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সাজাতে হলে এই ধরনের অনেক জটিল প্যাঁচ ছুটাতে হবে ’৭১-এর কিশোর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক ক্যাডেট ও বর্তমান কমান্ডেন্ট সাজিদ ভাইকে।
সারা দেশের মতোই অবস্থা এই মেরিন সেক্টরটির। যে কাজগুলো করা দরকার তা করা হচ্ছে না। যে কাজগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ বা অ-কাজ তা নিয়েই বেশি মেতে রয়েছে। আমার আগের এক লেখায় জানিয়েছিলাম, এই সেক্টরটির সম্ভাবনা সম্যক উপলব্ধি করলে দাতাদের কাছে ব্রিফকেস নিয়ে ঘোরাঘুরি না করে দেশের কর্তাব্যক্তিরা জুলদিয়ার পাহাড়ে এসে বসে থাকতেন।
কথাটি খুব বেশি বাড়িয়ে বলি নাই।
তার জন্য যে সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের তাগিদ দরকার ছিল তার কিছুই চোখে পড়ছে না। ক্যাডেটদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করেই অপরিকল্পিতভাবে ক্যাডেট ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। ক্যাডেটদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে একশ্রেণীর এজেন্টদের মর্জি ও দয়ার ওপর। এভাবে এজেন্টদের দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দেয়া ক্যাডেটরা কখনই মার্চেন্ট নেভির কাক্সিক্ষত আত্মমর্যাদা, মনোবল ও দক্ষতা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারবেন না।
বিজ্ঞাপনের ভাষায় কিছুটা চমক যোগ হলেও শত ভাগ প্রফেশনাল স্পিরিট নিয়ে এ যাবৎ পরিচালিত মেরিন অ্যাকাডেমিকে আগের জায়গা থেকে বিচ্যুত করা হয়েছে। অনেকের অভিযোগ ছিল, মেরিন অ্যাকাডেমিটিকে মাদরাসা বানিয়ে ফেলা হয়েছে। বিষয়টিকে ঠিকভাবে অ্যাড্রেস না করে উল্টো থেরাপি দিয়ে এটিকে এখন শান্তি-নিকেতন বানানোর প্রয়াস চলছে। মাঝখান থেকে যা উধাও হয়ে গেছে তা হলো মেরিন অ্যাকাডেমি ও তার প্রডাক্টের কোয়ালিটি। ক্যাডেটদের পেশাগত দক্ষতা, ডিসিপ্লিন ও মেন্টাল ম্যাচুরিটি নিয়েও অনেক প্রশ্ন উত্থিত হচ্ছে।
কয়েক দিন আগে দু’জন ক্যাডেট আমাদেরই একটা জাহাজে যোগ দিতে সিঙ্গাপুরে এসেছিলেন। চুল আর দাড়িতে অনেক দিন চিরুনি না পড়ার চিহ্ন স্পষ্ট। পায়জামা-পাঞ্জাবিটি ইস্ত্রি করলেও আকাশ ভ্রমণে তা মলিন ও করুণ হয়ে পড়েছে। পায়ে স্রেফ দু’টি চপ্পল। আমি আর আমার দু’জন সিনিয়র ৩৩ হাজার ভোল্টের একটা শক খেলাম।
আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণ ছাড়াও দাড়ি পুরুষের পৌরুষ বাড়িয়ে দেয়। শিখদের ব্যাপারটি আমরা সবাই জানি। আমি যতজন শ্রীলঙ্কান অমুসলিম মেরিনারের সাথে সেইল করেছি তার মধ্যে শতকরা ৯০ জনের মুখেই দাড়ি দেখেছি। তবে তাদের বেশভূষা ও আচরণ কখনই মার্চেন্ট নেভির কসমেটিক এপিয়ারেন্স কিংবা জাহাজের নিরাপত্তাকে বিঘিœত করে নাই। অসহায়ভাবে দেখলাম জীবনমুখী একটা ধর্মকে জীবনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফেলা হয়েছে।
ধর্মীয় স্পর্শকাতরতার মুখোমুখি করা হয়েছে প্রফেশনের ডিগনিটি এবং সব সেইফটি রিকয়ারমেন্টকে।
আলসেমি আর অলসতাকে বুজুর্গীপনার আবরণে ঢেকে ফেলা হয়েছে। অথচ এই ধর্মেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে ঈমানের অঙ্গ ঘোষণা করা হয়েছে। স্পেনে মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন লোক দেখলেই সবাই ধরে নিতেন যে লোকটি মুসলমান। সৈনিকের কাজ করার সময় নবীজী সৈনিকের আঁটসাট পোশাকও পড়েছেন।
জমি-ফ্ল্যাট কেনা, গাড়ি কেনা, পকেট-পদবির সাইজ মেপে ‘ইন-লজ’ ঠিক করা এই ধরনের সব হালাল কাজগুলো অন্যদের মতোই আনজাম দিয়ে শুধু নিজের বেশভূষায় এই ‘বৈরাগ্য’ সত্যিই বেদনাদায়ক। সেই ড্রেস ও চপ্পল পায়ে ওই দুই ক্যাডেট জাহাজের পাইলট লেডার বেয়ে জাহাজে উঠছেনÑ এমন একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য অ্যাকাডেমির এক সাবেক ক্যাডেটের ধর্মীয় ঈমানটি বর্তমানে থাকা অবস্থাতেও করুণ চোখে অবলোকন করতে হলো। আরো ধাক্কা খেলাম যখন ইঞ্জিন রুমে গিয়ে দেখি সেই ক্যাডেট একই বেশে ইঞ্জিন রুমে ঘুরছেন। কানে বাজছে জুলদিয়ার পাহাড়গুলোতে কাঁপন ধরানো সেই গর্জনগুলো, ‘ব্লাডিহেল, হোয়ার ইজ ইউর সুজ?’
সনদপ্রাপ্ত মেরিনারদের চাকরির বাজারটি অত্যধিক ভালো হওয়ায় তা কমিউনিটির জন্য আশীর্বাদ না হয়ে কেন যেন অভিশাপ হয়ে পড়ছে। অনেকের মাঝেই গাছাড়া ভাব চলে এসেছে।
পেশাগত দক্ষতা, যোগ্যতা ও সার্বিক কোয়ালিটি বাড়ানোর তাগিদটি অনেকের কাছ থেকেই উধাও হয়ে গেছে। সিনেমার অনেক নায়িকার খামখেয়ালিপনার ওপর পরিচালকরা যেমন করে অসহায় হয়ে পড়েন, জাহাজের মালিকপক্ষ অনেক অফিসারের অপেশাদার মনোভাবের হাতে তেমনিভাবে জিম্মি হয়ে পড়েন। এগুলো দেখে অনেকেই জাহাজের ব্যবসায় বন্ধ করে দিতে চাচ্ছেন। আমরা ভুলে যাচ্ছি যে কিছুু অফিসারের অপেশাদার মনোভাব বা আচরণ পুরো দেশের মেরিনারদের কমন অ্যাকাউন্টে জমা পড়ছে। বাংলাদেশী অফিসারদের দক্ষতা, সততা ও আচরণÑ এই তিনটিই যেখানে ওয়ার্ল্ড স্ট্যান্ডার্ডে প্রথম দিকে ছিল তা আজ শেষের দিকে সরে আসছে।
এখনো চাকরির বাজারটি ভালো বলে ‘চালটি কাঁড়া না আকাঁড়া’ তা দেখা হচ্ছে না। চাকরির বাজারটিতে একটু টান পড়লে এবং কাঁড়া-আকাঁড়া বাছাই শুরু হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়বেন এই ‘হাইব্রিড’ যুগের বাংলাদেশের অফিসাররা। এ ব্যাপারে সাবধান ও সতর্ক না হলে সামনে ভয়ঙ্কর খারাপ সময় অপেক্ষা করছে।
যারা আজ এই দেশটির কাণ্ডারি কিংবা শিপিং সেক্টরের কাণ্ডারি তাদের প্রজ্ঞা ও দক্ষতার দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় খুব বেশি লাভ হবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মেরিনাররা এবং বর্তমানে জাহাজে সেইলিংরত ক্যাপটেন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এবং অন্যান্য সিনিয়র অফিসারদের আরো একটু দায়িত্বশীল অভিভাবকের ভূমিকা নিতে হবে।
মোরাল অথরিটি নিয়ে ধার্মিক ও সিনিয়র মেরিনারদের এগিয়ে আসতে হবে এই পেশাটির ডিগনিটি এবং আমাদের ধর্মের মূল শিক্ষাটি ছড়িয়ে দিতে। আধ্যাত্মিক এই আসক্তি (!) মোকাবেলার জন্য মহিলা ক্যাডেট ভর্তিকে একটা যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্ট হতে পারে। কিন্তু লিঙ্গ সমতার এই হামানদিস্তা আধ্যাত্মিক এই হতাশাটিকে বাড়াবে বৈ কমাবে না। জিরো এলকোহল পলিসিতে ফিরে আসতে মরিয়া মেরিটাইম বিশ্বে আমাদের ধর্মীয় বোধটি একটি এসেট হতে পারেÑ কখনো লায়াবিলিটিজ নয়। এ জন্য ধর্ম, রাজনীতি ও প্রশাসন সব জায়গায় দরকার চৌকস, প্রজ্ঞাবান ও সাহসী লোকদের।
মিনার রশীদ
তারিখ: ২৫ অক্টোবর, ২০১২
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।