আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হিজড়া: এক অমীমাংসিত লিঙ্গ

আজ ৮ই মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। এ দিনে আমরা নারীদের বিভিন্ন অধিকার ইস্যু নিয়ে আলোচনা করে আসছি কিন্তু আমাদের চোখের সামনেই নারী কি পুরুষ রয়েছে এমন এক অমিমাংশিত সম্প্রদায়। জীবন যাপন করে অবহেলিত ও অমানবিক অবস্থায়। এই হিজড়া সম্প্রদায় নিয়ে আজকের লেখা। মানুষ হিজরা হয়ে জন্মায় না, আমরাই তাদের ধীরে ধীরে হিজরা করে তুলি।

পথ পথিক সৃষ্টি করে না পথিকই পথ সৃষ্টি করে। পাশ্চাত্যের হিজড়ারা জনসাধারনের মুল ধারার অর্ন্তভূক্ত হলেও আমাদের দেশে তা নয়। সেখানে চিকিৎসার সহজলভ্যতার কারনে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্থ হয় এই যৌন প্রতিবন্ধীরা কিন্তু আমাদের দেশের হিজড়ারা সমাজে অপাংক্তেয় শ্রেণী হিসাবে গন্য। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়- ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের জন্মপরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয় মূলত তারাই হিজড়া। বিশ্বে প্রতি ১৫ হাজার নবজাতকের মধ্যে অন্তত একজন (ইন্টারসেক্স ডিস্অর্ডার) হিজড়া রোগে আক্রান্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করছে।

অনেক পিতামাতা লোকলজ্জা ও সামাজিকতার ভয়ে এসব শিশুকে ঘরে বন্দি করে রাখছে। এমনকি নির্মম হত্যাকাণ্ডেরও শিকার হতে হয়েছে এসব নিষ্পাপ শিশুকে। বাংলাদেশে হিজড়াদের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ বলে জানা যায়। তবে এই েেত্র হিজড়াদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে কিছুটা ধোয়াশা থেকেই যায়। কারণ নিজেদেরকে আড়ালে রাখা অর্থাৎ বহিরঙ্গে অপ্রকাশিত হিজড়াদের পরিসংখ্যান এখানে থাকার সম্ভাবনা কম।

রাজধানী ঢাকাতে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় পনের হাজার। বর্তমানে রমনা পার্ক, কুড়িল বাড্ডা, পুরান ঢাকা, খিলগাঁও মার্কেটের পেছনে ভূঁইয়াপাড়াসহ অনেক এলাকাতেই হিজড়া সম্প্রদায়ের দলবদ্ধভাবে বসবাস। এদের অনেকেই মানবেতর জীবন-যাপন করে। ওদের বেশিরভাগই মনে করে, হিজড়া হয়ে জন্ম নেয়াই একটা লজ্জা, অপরাধের ব্যাপার। হিজড়াদের মধ্যে প্রায় সবাই নিজেদের শরীরকে নিজেরাই ঘৃণা করে।

অনেকেই নিজেদের অসহায় এবং ভিকটিম বলে মনে করে। এদের মধ্যে অনেকেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে এবং অনেকেই নির্যাতনের শিকার হয়। অনেকে আবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এমনকি মারা গেলে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে সৎকার করতে চায় না সমাজপতিরা। কষ্টের কথা যৌন প্রতিবন্ধী প্রান্তিক এই হিজড়া জনগোষ্ঠীর রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি।

হিজড়ারা সাধারণ মানুষের কটূক্তি থেকে রেহাই পেতে সবাই দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। প্রতি নিয়তই তারা বৈষম্যের শিকার। প্রতিকুল পরিবেশ ও অনুকূল সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গির অভাবে সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শিার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠী। সমাজের অসুস্থ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা বাসস্থানের মতো অতি প্রয়োজনীয় একটি মৌলিক অধিকার হতেও বঞ্চিত। চরম অস্বাস্থ্যকর ঘিঞ্জি এলাকায় গাদাগাদি করে তারা বসবাস করে।

বিভিন্ন যৌনবাহিত রোগ এবং ভয়াবহ এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি এই জনগোষ্ঠীর। চিকিৎসা, শিা, নিরাপত্তা, বিনোদন ও ভোটপ্রদানের অধিকার আদায়ে সহায়ক জনপ্রতিনিধিরাও তাদেরকে এড়িয়ে চলেন দায়িত্বহীনভাবে( আমি নিজেও, এ বিষয়ে অপরাধী)। ভোটার তালিকায় তারা কেউ ছেলে বা মেয়ে হিসেবে ভোটার হয়েছেন। আরো অমিমাংশিত ব্যাপার হলোÑচলমান জন্মনিবন্ধন কার্যক্রমেও তাদের হিজড়া হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার সুযোগ নেই। হিজড়াদের অধিকার রায় এখনও প্রতিষ্ঠা পায়নি উল্লেখযোগ্য কোন আইনি সহায়তা কেন্দ্র।

উত্তরাধিকার প্রাপ্তিতে রয়েছে প্রতিবন্ধকতা ও বঞ্চনার অসংখ্য ইতিহাস। দেশে সবার জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিা আইন হিজড়া জনগোষ্ঠীকে স্পর্শ করতে পারেনি। প্রয়োজন অনুসারে অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের মতো তাদের জন্য এখনো পর্যন্ত গড়ে উঠেনি আলাদা প্রতিষ্ঠান। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোতে হিজড়াদের চাকরি অলিখিত এক নিয়মে প্রায় বন্ধ বললেই চলে। সরকারের বয়স্কভাতা কার্যক্রমে ও বয়স্ক হিজড়ারা বঞ্চিত হচ্ছে বিভিন্ন কারণে।

পারিবারিক ও সামাজিক বৈষম্যের স্বীকার হয়ে আলাদা হয়ে পড়া অনেক হিজড়া বাঁচার তাগিদে যৌন পেশা, চোরাচালানও মাদক ব্যবসার মতো নিষিদ্ধ পেশা ও অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। প্রকৃতির প্রহেলিকায় কেবল অস্বাভাবিক লিঙ্গ বৈকল্যের কারণেই একটা অভিশপ্ত জীবনের অপরাধ সম্পূর্ণ বিনাদোষে তাদের ঘাড়ে চেপে যায়। খুব অমানবিকভাবে যৌনতার অধিকার, পরিবারে সম্মানের সঙ্গে বসবাসের অধিকার, চাকরির অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে যায় এরা। কিন্তু এসব অধিকার রা ও বলবৎ করার দায়িত্ব ছিলো রাষ্ট্রের। প্রকৃতির নির্দয় রসিকতার কারণে হিজড়াদের গতানুগতিকতার বাইরে ভিন্ন পদ্ধতির অনিবার্য যৌনতাকেও ইসলাম প্রধান দেশ হিসেবে সহজে মেনে নেওয়া হয় না।

এমনকি ব্রিটিশ আমলেও এদেশে হিজড়াদের বিতাড়িত করা হয়েছে বলে জানা যায়। যৌনতার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ভারতীয় আইনে হিজড়াদের যৌনতাকে ‘সডোমি’ অর্থাৎ অস্বাভাবিক ও অনৈতিক হিসেবে চিহ্নিত করে পেনাল কোড (১৮৬০) এর ৩৭৭ ধারায় এটাকে শাস্তি যোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই যদি আইন হয় তাহলে তারা যাবে কোথায়। কাজের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় বলে অনেকেই দোকানে দোকানে টাকা চাঁদা নিয়ে জীবন-যাপন করে আবার অনেকেই বাঁচার জন্য যৌন কাজের সঙ্গে লিপ্ত হয়। সরকারি খাসজমি বরাদ্দ করে হিজড়া ভিলেজ প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের আবাসনের ব্যবস্থা সম্ভব, ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত হিজড়াদের নির্দিষ্ট হারে ভাতা দেওয়ার প্রচলন ছিল।

এবং পরিবহন ভাড়া চিকিৎসা ও বিনোদনের জন্য সিনেমা হল ফ্রি ছিল। এখন এসব কেবলই গল্প। অপরদিকে দু:খজনক হলেও সত্যি এমন কিছু যুবকের সন্ধান পাওয়া যায় যারা শারীরিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে শতভাগ স্বাভাবিক পুরুষ মানুষ। কিন্তু এরা কণ্ঠস্বর, কথা বলার ধরন এবং চলার ভঙ্গি রপ্ত করেছে হিজড়াদের মতো। এদের কেউ কেউ মেয়েদের মতো লম্বা চুল রাখে, লিপস্টিকসহ মেয়েদের প্রসাধনী ব্যবহার করে।

এরা অপর পুরুষের সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হয়। কিশোরগঞ্জে পরিচালিত এক জরিপে এ ধরনের ১ হাজার ৪শ' 'সৌখিন' হিজড়া সন্ধান পাওয়া গেছে। হিজড়ারূপী এ যুবকদেরকে 'ক্বতী' বলে নামকরণ করা হয়েছে। তবে ক্বতী সম্প্রদায়ের যুবকরা টাকা রোজগারের জন্য যৌনকর্মে লিপ্ত হয় না, স্রেফ বিকৃত যৌন চেতনা থেকেই এটা করে থাকে বলে কয়েকজন ক্বতী যুবকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে। হিজড়ারূপী ক্বতীদের যৌনকর্মের ফলে এইডসের মারাত্মক ঝুঁকি রয়েছে।

এসব অরুচিকর সৌখিন হিজড়াদের জন্য প্রকৃত হিজড়াদের প্রতি মানুষের নেতিবাচক ধারনা তৈরী হচ্ছে যা তাদের সামাজিক পুর্নবাসনে বাধাগ্রস্ত করছে। এদিকে হরমোনজনিত সমস্যা ও পারিবারিক উপো-অবহেলা বা তাচ্ছিল্যের কারণে অনেকেই হিজড়া না হয়েও হিজড়ার মতো চলাফেরা করছে। আবার অবৈধ আর্থিক সুবিধা, অপরাধ করেও আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকাসহ বিভিন্ন সুবিধা আদায়ের জন্য একশ্রেণীর সুবিধাবাদী মানুষ হিজড়ার রূপ ধারণ করছে। হিজড়াদের প্রকৃতির সন্তান বলা হলেও সমাজের কিছু বর্বর প্রতারকের খপ্পরে পড়ে অনেকেই হিজড়ায় পরিণত হচ্ছে। সবার অজান্তে পরিবারবিচ্ছিন্ন এসব হিজড়া অমানবিক জীবন যাপন করছে।

বিভিন্ন এলাকা থেকে শিশুদের অপহরণ করা হয় এবং অপারেশনের মাধ্যমে তাদের হিজড়ায় পরিণত করে। হিজড়া নেতা নিজেদের স্বার্থ হাসিল এবং দল ভারী করার ল্েয এ ধরনের নির্মম কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, লিঙ্গ কর্তনকারী হিজড়াদের মধ্যে খোদ রাজধানীতেই রয়েছে প্রায় ২০ হাজার। রাজধানীসহ সারাদেশে অশিতি, অভাবী ছেলেদের পাশাপাশি যেসব ছেলের একটু মেয়েলি ঢং রয়েছে এবং যেসব ছেলে বা পুরুষ সমকামিতায় আসক্ত তারা নানা ফাঁদে পড়ে বা প্রলুব্ধ হয়ে হিজড়ার খাতায় নাম লেখায়। তাদের সংগ্রহের জন্য রয়েছে দালাল চক্র।

আরো অস্বাভাবিক খবর হলো হিজড়া দিয়ে চাদাবাজি থেকে বিভিন্ন অপকর্মের জন্য ভাড়া করা হয়। যেমন আশুলিয়ার ভাদাইল এলাকায় এক পাশন্ড স্বামী হিজড়া ভাড়া করে তার স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিব্রতকর খবর হলো ভদ্র সমাজও এদের ব্যবহার করছে অন্যায়ভাবে, খেলাপি ঋণের টাকা আদায়ের জন্য গড়ে তোলা প্রশ্নবিদ্ধ রেসকিউ টিমে 'হিজড়াদের' সংযুক্ত করার জন্য কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক নতুন নিয়ম চালু করেছে। পুর্নবাসন ও সম্ভাবনা প্রান্তিক হিজড়া জনগোষ্ঠী সংখ্যায় খুবই কম। তাই তাদেরকে সরকারি বেসরকারি উন্নয়ন কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করা সহজতর।

সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনা আরো সহজ হবে। এই হিজড়াত্ব ঘোচাবার উপায় এখন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের নাগালে। সম্প্রতি বাংলাদেশের শতাধিক হিজড়া ঢাকার ধামরাইয়ের রোম আমেরিকান হাসপাতালে অপারেশনের মাধ্যমে স্বাভাবিক মেয়েলি জীবন ফিরে পেয়েছেন। চিকিৎসকদের মতে শিশু অবস্থায় চিকিৎসার জন্য আনা হলে অপারেশনের মাধ্যমে সে স্বাভাবিক মানুষের মতো পরিবারের মধ্যে থেকেই জীবন-যাপন করতে পারে। মানুষ হিসেবে তাদেরও যে অধিকার রয়েছে, তা সুপ্রতিষ্ঠিত করার ল্য নিয়ে হিজড়াদের উন্নয়নে হাতে গোনা কয়েকটি সংগঠন খুব ছোট্ট পরিসরে হলেও মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।

এদের কার্যক্রম ততোটা জোড়ালো না হলেও এইডস প্রতিরোধসহ কিছু উন্নয়ন কার্যক্রমে এরা যুক্ত রয়েছে বলে জানা যায়। সেখানে রাষ্ট্রের কোন অনুদান নেই। এখন প্রয়োজন হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি। কেননা এই লিঙ্গ স্বীকৃতি না পেলে কোন মানবাধিকার অর্জনের সুযোগই তারা পাবে না বলে অনেকে মনে করেন। তবে আশার কথা যে, এবারের ভোটার তালিকায় এই প্রথম হিজড়াদেরকে অন্তর্ভূক্ত করার প্রশংসনীয় একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশন।

যদিও জাতীয় আদমশুমারি-২০১১ তে বরাবরের মতো এবারো বাংলাদেশের হিজড়া সম্প্রদায়কে গণনায় উপো করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভালো সংবাদ হলো অনেক হিজড়া স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হচ্ছেন। যেমন বাংলাদেশে প্রথমবারের মত নাটোরের জমির প্রামানিক নামে একজন হিজড়া নিজের পরিশ্রমের টাকা দিয়ে হজ্ব ব্রত করেছেন। আসুন আমরা সবাই মিলে এসব সুবিধা বঞ্চিত মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে দাড়াই তাদের উপহার দেই সুস্থ স্বাভাবিক জীবন। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.