দক্ষিণ এশিয়ায় কোন দেশ বেশি উন্নতি করছে এ প্রশ্ন উঠলেই আমি বলি বাংলাদেশ। ’ কথাগুলো নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের। কথা হচ্ছিল ব্যাঙ্কক এয়ারপোর্টে বসে। এয়ারপোর্টের অন্য একটি লাউঞ্জে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের সঙ্গে অপেক্ষা করছি, এমন সময় কে যেন এসে খবর দিলেন পাশের লাউঞ্জে অমর্ত্য সেন আছেন। আমাদের অর্থমন্ত্রী ও অমর্ত্য সেন দীর্ঘদিনের বন্ধু।
তাই তাঁর কথা শুনেই তিনি ছুটলেন। ভিতরে গিয়ে তাদের দু’জনের কুশল বিনিময় শেষ হতেই অমর্ত্যদা আমাকে দেখে বললেন, তোমাকে তো আমি ঢুকতে দেখলাম। বললাম সরি, দাদা আমি লক্ষ্য করিনি। যাহোক কথা শুরু হতেই জানা গেল, তিনি চীনে যাচ্ছেন। প্রথম কাজ, তার আইডিয়া অব জাস্টিস চীনা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, সেটার প্রকাশনা উৎসবে থাকতে হবে।
আরও একটি সেমিনার আছে।
আমি একটু আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম তাঁর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চীনে কোন কাজ আছে কিনা? তিনি কিছু কাগজ দেখিয়ে বললেন, এই তো নালন্দার কাজ। সেখানে নালন্দা নিয়েও কিছু কাজ আছে।
যাহোক, এরপর তিনি নিজে থেকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ফিরে এলেন। আমাদের অর্থমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে বললেন, ড. ইউনূসের কারণে এখন ওয়েস্টার্ন মিডিয়া বাংলাদেশের ওপর এক ধরনের বৈরী হয়ে আছে।
অথচ দক্ষিণ এশিয়ায় সব থেকে ভাল করছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের এই নিয়ে কোন প্রচার নেই। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, পৃথিবীতে মনে হয় বাংলাদেশের সরকারই একমাত্র সরকার যাদের কোন পাবলিসিটি উইং নেই।
আবুল মাল আব্দুল মুহিত তাঁর এ কথা টেনে নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক ও ইউনূস প্রসঙ্গে সরকারের অবস্থান ও ইউনূসের কাজের কিছুটা বাস্তবতা তুলে ধরলেন। অমর্ত্য সেন সেগুলো শোনার পর বললেন, দেখুন সবই ঠিক আছে।
তাছাড়া ইউনূস ও আবেদ দু’জনই অনেক কাজ করেছে। অমর্ত্য সেন বললেন, তিনি তাদের দু’জনকেই নোবেল দেয়ার জন্য প্রস্তাব করেছিলেন। যাহোক নোবেল কমিটি একজনকে ও গ্রামীণ ব্যাংককে দেয়। অথচ কাজের দিক থেকে মনে হয়, আবেদই বেশি কাজ করেছে। অমর্ত্য সেনের কথার স্বপক্ষে আমি বলি, হ্যাঁ, কাজ শুরুও ফজলে হাসান আবেদ করেছেন এবং অনেক বড় বড় কাজ তিনি করেছেন।
বিশেষ করে প্রাইমারী শিক্ষা ও ওর-স্যালাইন চালুতে তার ব্র্যাকের ভূমিকা অসাধারণ। অমর্ত্য সেন আবারও বলেন, তার নোবেল পাওয়া উচিত। এরপর আবার তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ সম্পর্কে এখন যে বৈরী মনোভাব সে প্রসঙ্গে ফিরে আসেন।
তিনি নিজের মুখে নিজের কথা না বললেও আমরা জানি, নিউইয়র্ক টাইমস, ফিন্যান্সিয়াল টাইমের মতো পত্রিকাগুলো অমর্ত্য সেনের একটি লেখা ছাপার জন্য কতটা উদগ্রীব হয়ে থাকে। তাছাড়া অর্থনীতি বা আর্থ-সামাজিক বিষয়ে তিনি যে কথা বলেন না কেন, সেগুলো এ সব পত্রিকা অনেক গুরুত্ব দিয়ে ছাপে।
অথচ বাংলাদেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার অবস্থান ড. ইউনূসের কারণে কোন পর্যায়ে গেছে সেটা বোঝানোর জন্য বলছিলেন, তিনি সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ যে ভাল করছে এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অন্যের থেকে কতটা ভিন্নÑএ বিষয়ে একটি লেখা নিউইয়র্ক টাইমসকে দিতে চাইলে তারা সেটা ছাপতে অপারগতা প্রকাশ করে। তার একমাত্র কারণ, বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন পজিটিভ বিষয় এখন তারা ছাপতে চায় না। শুধু তাই নয়, অর্থনীতির কোন কোন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ভিতর বাংলাদেশ সব থেকে ভাল করছে এবং সকলকে সেটা অনুসরণ করা উচিতÑএমন একটি তথ্যবহুল বক্তব্য রাখেন তিনি সম্প্রতি এক সেমিনারে। তার ওই বক্তব্যের ওপর বিশাল রিপোর্ট করেছে ফিন্যান্সিয়াল টাইম, কিন্তু সেখানে তারা বাংলাদেশ প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে দিয়েছে।
তিনি বললেন, যেখানে বাংলাদেশে মেয়েদের স্কুলে যাবার হার দক্ষিণ এশিয়ায় সব থেকে বেশিÑযা অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয়।
এছাড়া মাতৃমৃত্যুর হার ভারত বা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যদেশ থেকে কম বাংলাদেশে। শিশুমৃত্যুর হার কম। বিনয়ের সঙ্গে একটু যোগ করি, দাদা স্যানিটেশনেও কিন্তু আমরা সব থেকে ভাল করছি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করলেন। এগুলো সবই দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষণ।
তাছাড়া তার কথার প্রসঙ্গ টেনে অর্থমন্ত্রী বললেন, ৬০ হাজার কোটি টাকা ক্ষুদ্রঋণের বেশি অংশই বাংলাদেশ সরকার দিয়েছে। অমর্ত্য সেন হেসে বললেন, সবই ঠিকই আছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তো সেটা প্রচার করতে পারছে না।
বাংলাদেশ সরকার যে প্রচার করতে পারছে না এটা আমরা সকলেই জানি। এই কলামেই লিখেছি, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত শেখ হাসিনা নারীদের জন্য যা করেছেন তা আর কোন ব্যক্তি বা সরকার করতে পারেনি।
ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত নারী প্রতিনিধি যে গ্রাম-বাংলার সামাজিক কাঠামোতে নারীকে কতটা ক্ষমতায়ন করেছে সেটা যদি সঠিকভাবে পশ্চিমা মিডিয়ার কাছে তুলে ধরতে পারত সরকার তাহলে পশ্চিমা বিশ্ব যে মৌলবাদী নয় আধুনিক মুসলিম খুঁজছে তার প্রকৃত সন্ধান বাংলাদেশে পেত। এমনই এই সরকারের হাজারো দিক আছে। কিন্তু সরকার শেষ বছরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে অথচ এখন শুনতে হচ্ছে, বাংলাদেশ সম্পর্কে অমর্ত্য সেনের লেখাও এখন পশ্চিমা মিডিয়া প্রকাশ করতে চায় না। এখানে সরকারের ব্যর্থতা ৯৫ ভাগ ধরলেও ৫ ভাগ দায় গিয়ে পড়বে ড. ইউনূসের ওপর। তিনি তাঁর গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্টে অনেক কাজ করছেন।
তিনি হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে করেননি, কিন্তু এটা তো ঠিক যার পরিচয় দিতেই বাংলাদেশের পরিচয় উঠে আসে। যাকে সারা পৃথিবী চেনে। এই তো সেদিন জাপানের উপ-অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সময়ে তিনি নাম মনে করতে না পারলেও বাংলাদেশ সম্পর্কে একজনের কথাই বার বার বলছিলেন, তিনি ড. ইউনূস। তাই দেশ যাকে এতটা দেয়, দেশের প্রতি তার দায় অনেক বেশি হতে হয়। এবং মানুষের উচ্চতা যখন ওই পর্যায়ে চলে যায় তখন সে উচ্চতাকে নিজের উচ্চতা হিসেবে না ধরে সেটা দেশের সঙ্গে বিলীন করে দিতে হয়।
কিন্তু তার বদলে কোথায় যেন একটা ক্ষোভ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন সেদিন ড. ইউনূস যাদের নিয়ে রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন, তাদের একজনের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বলছিলাম, ড. ইউনূস কি এখনও বিষয়টির সমাপ্তি রেখা টানতে পারেন না? তিনি দেখলাম অনেক বেশি যুদ্ধংদেহী। বললেন, এখন তিনি অনেক শক্ত। পাল্লা তাঁর দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম, এই আরেকটি সমস্যা আমাদের দেশে।
যারা সিভিল সোসাইটি তারা পাল্লায় নিজেকে তোলেন আর তার গর্বকে তোলেন। দেশের মানুষকে তুলে তার সঙ্গে পরিমাপ করেন না। মিলিয়ে দেখেন না দেশের সামষ্টিক সাধারণ মানুষের তুলনায় আমি কতটুকু! তারপরও বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, পাল্লা কিভাবে ওনার দিকে যাবে? কারণ বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতুর ঋণ পুনর্বিবেচনা করেন ওই সময়ে তিনিও ওয়াশিংটনে ছিলেন ফজলে হাসান আবেদও ওয়াশিংটনে ছিলেন। ফজলে হাসান আবেদ বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ যাতে ঋণটা পায় সে বিষয়েই কথা বলেন। ড. ইউনূসেরও কি কিছু দায় ছিল না?
যাহোক, তবে এখন দেশের সরকার বিষয়টি নিয়ে ভাবলে মনে হয় ভালো করবে।
কারণ বর্তমানের এই একক বিশ্বে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মিডিয়াকে বৈরী রেখে একটি ছোট দেশের পক্ষে পথচলা কতটা কষ্টের সেটা ব্যাখ্যা করার দরকার পড়ে না। তবে গত সাড়ে তিন বছরে সরকারের পাবলিসিটি উইংগুলোর যে যোগ্যতা আমরা দেখেছি তাতে এখানে আশা শুধু মিছে ছলনা। এখানে আশা না করাই ভাল। অথচ একটু যোগ্যতার সঙ্গে বিষয়গুলো কাজে লাগালে বাংলাদেশে, বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদে যে পরিবর্তন এসেছে তাকে কোন গ্লোরি ফাই করার দরকার ছিল না, যেমনটি হয়েছে তেমনটি প্রচার করতে পারলেও আজ গণতান্ত্রিক বিশ্বের ধারণা বদলে যেত। কিন্তু সরকারের পাবলিসিটি উইং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেউ এটা পারেনি গত প্রায় চার বছরে।
এটাই শেখ হাসিনার জন্য সব থেকে দুর্ভাগ্যের। যেমন সম্প্রতি অত্যন্ত সৎ এক ব্যক্তি দেখা করেছেন শেখ হাসিনার সঙ্গে। তার বক্তব্য হলো, এই ভদ্রমহিলার আন্তরিকতা ও দেশপ্রেম তার বাবার থেকে কোন অংশে কম নয়। দেশের জন্য যে কোন ভাল কিছু করতে তাকে বড় দরাজ মনে হলো। কিন্তু পাশাপাশি মনে হলো, কোথায় যেন রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর রাজার চারপাশের একটা ছায়া তার চারপাশে দেখলাম।
স্রষ্টা তার মতো নেত্রীর ভাল করুন। তিনি যেন ওই ছায়াকে আলো দিয়ে ধূলিসাৎ করে দিতে পারেন।
বাস্তবে বাংলাদেশবিরোধী প্রচার এখন নানাভাবে হচ্ছে। যেমন অতি সম্প্রতি দেশের অনেকেই লক্ষ্য করছেন এশিয়ান হিউম্যান রাইট ওয়াচ নামে হংকংভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে মাঝে মাঝেই রিপোর্ট বের করছে। রিপোর্টগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়লে সকলেই দেখতে পাবেন তাদের বক্তব্যের সঙ্গে জামায়াত ও উগ্র বিএনপির বক্তব্যের কোন পার্থক্য নেই।
এবং তারা অধিকাংশ সময়ে এখানে জামায়াতে ইসলামী ও ছদ্ম জামায়াতে ইসলামী এনজিও বা তথাকথিত আইন বিষয়ক সংগঠনের তথ্যগুলো ব্যবহার করে। ব্যাঙ্ককে এই সংগঠনটির একটি শাখা অফিস আছে। সেখানে কাজ করে এমন একটি ছেলে সেদিন দেখা করে জানাল, সে আর ওই সংগঠনটির সঙ্গে কাজ করতে পারছে না। তার মনে হয় খুব শীঘ্রই কাজ ছেড়ে দিতে হবে। কারণ সংগঠনটির এই শাখা প্রধান হিসেবে যিনি দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন তিনি একজন সক্রিয় হিযবুত তাহরীর নেতা।
এবং বাংলাদেশের হিযবুত তাহরীর সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ রয়েছে। এখান থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, আন্তর্জাতিক এই মৌলবাদ একত্রিত হয়ে ও তার সঙ্গে ড. ইউনূস প্রসঙ্গ যোগ হওয়াতে সব দিক থেকেই বাংলাদেশের পজিটিভ প্রচার বন্ধ করার একটি চেষ্টা চলছে। এখন সরকার কিভাবে এই প্রাচীর ভাঙ্গবে সে রণনীতি তাদেরকেই নিতে হবে। তবে এই মনের জোরটুকু যেন থাকে, পৃথিবীতে অচলায়তন বলে কিছু নেই। তথ্যসূত্র: জনকণ্ঠ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।