আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘুরতে গিয়েছিলাম ভারত - ১৩ - শেষ পর্ব (ছবিসহ)

আগের পর্বগুলো - ১ , ২ , ৩ , ৪ , ৫ , ৬ , ৭ , ৮ , ৯ , ১০ , ১১ , ১২ (১ম ছবি গুগল থেকে পাওয়া) দিল্লীর পথে রওনা দিয়ে সারা রাত বাসজার্নির পর ভোরবেলা ঘুম ভেঙে টের পেলাম যে গরম লাগছে। সবাই গরম কাপড় পরে ছিলাম তখনও। এবার সোয়েটার-শাল সব খুলে রাখতে হল। এজন্যই এ ধরণের ট্যুরে সবাই সিমলা-মানালির আগেই দিল্লী ঘুরে যায়। একমাত্র আমরাই একটু অন্যভাবে ট্যুরটা সাজিয়েছিলাম।

যা হোক, দিল্লীতে নেমে আমাদের গন্তব্য হল হোটেল সায়াল। যদিও এটাকে আমরা শিয়াল হোটেলই বলতাম। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। হঠাৎ একটা কোলাহলের শব্দ এল বাইরে, সেই সাথে ঢাক-ঢোলের গুড়ুম গুড়ুম। বারান্দায় গিয়ে দেখি কোন একটা পুজার র‌্যালি, অনেকটা রথযাত্রার মত, তবে রথযাত্রা না।

মেয়েরা বেশির ভাগ গেরুয়া শাড়ি পরে শাঁখ বাজাচ্ছে, আর ছেলেরা ঢাক। ট্রাকে করে প্রসাদ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেই প্রসাদ ট্রাক থেকে বিতরণ করা হচ্ছিল। একটু পর সবাই তৈরি হয়ে বের হলাম। আজ আমি লাল জামা পরলাম। একটু অস্বস্তি বোধ করছিলাম বেশি লাল হয়ে গেল কি না জামাটা।

কিন্তু বের হয়ে দেখি আমাদের সখীদের বেশির ভাগই আজ লাল জামা কিংবা লাল শাড়ি পরেছে, যদিও কেউ অন্য কারুরটা জানত না। কিভাবে যেন মিলে গেছে। আর যারা লাল পরেনি, তারাও মোটামুটি ঝলমলে জামা পরেছে। আমাদের দেখে স্যার আর গাইড দুজনই বললেন, সব ট্যুরে দেখেছি তাজমহলে সবাই গর্জিয়াস জামা পরে, এবারই প্রথম দেখলাম দিল্লীতে সব দল বেঁধে এমনটা করল, আজব। আমরা বললাম, আমরা এমনই, সবার থেকে আলাদা।

ঝলমলে জামা পরে আমরা বের হলাম সাইট-সিইং এ। প্রথমে গেলাম ইন্ডিয়া গেট দেখতে। ফ্রান্সের গেট অব ভিকট্রি-র আদলে গড়া এই ইন্ডিয়া গেট ভারতের সেইসব সেনাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত যারা বিভিন্ন যুদ্ধে নিজেদের প্রাণ দিয়েছেন। গেটের ঠিক মধ্যিখানে একটা রাইফেল দাঁড় করানো আছে যার উপর একটা হেলমেট বসানো। এটা ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহত ভারতীয় সেনাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে বসানো হয়।

ইন্ডিয়া গেটের দুই পাশে দুইটা ছোট ছোট ঝরনা আছে। আমরা দল বেঁধে যেখানেই যাই, সেখানেই সবার নজরে পড়ে যাই। এখানেও তার ব্যতিক্রম হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেরিওয়ালারা এসে আমাদের মধ্যে ঘুর ঘুর করতে থাকল। কেউ ছোট ছোট ব্যাগ বিক্রি করছে, কেউ হালকা গয়না।

আবার একজন তো একরকম সাদা মিষ্টি বিক্রি শুরু করল দিল্লি কা লাড্ডু বলে। আমি দেখেই বললাম, এটা তো লাড্ডু না। সে জোর গলায় এটাকেই লাড্ডু হিসেবে চালিয়ে দিতে চাইল। স্যারের মানা সত্ত্বেও আমাদের কয়েক বন্ধু কিনে খেল। তারপর বলল, বিশ্রী জিনিস, এটা মানুষ খায় কেন? এরপর আমরা গেলাম ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়ালে।

এখানে কালো মার্বেলের টাইলস বসানো একটা বড় বেদীর সামনে একটা কাঁচের বাক্সে আগুন জ্বলছে, আমাদের দেশের শিখা অনির্বাণের মত। অনেক বড় এলাকা নিয়ে এই মেমোরিয়ালটা তৈরি। পেছন দিকে বড় একটা খোলা জায়গায় বেশ কিছু বড় বড় পাথর বসানো। কাছে গিয়ে দেখলাম প্রতিটার সামনেই তার ইতিহাস লেখা। যেমন আমাদের চেয়ে দ্বিগুণ উচ্চতার একটা পাথরের সামনে দেখলাম লেখা আছে যে এই পাথরটা চাঁদ থেকে আনা হয়েছে।

চাঁদ থেকে এত বড় পাথর আনা হয়েছিল আর সেটা এখানে রাখা আছে, এমন খবর আগে তো শুনিনি। এখান থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম মহাত্মা গান্ধীর বাসভবনে, যেটা এখন মহাত্মা গান্ধী মেমোরিয়াল করা হয়েছে। মহাত্মা গান্ধী মৃত্যুর আগ মুহূর্তে বাসা থেকে বেরিয়ে যে পথে হেঁটে এসেছিলেন সে পথে তার পায়ের ছাপের আদলে সিমেন্ট বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। আর যে স্থানে তাকে গুলি করা হয় আর তিনি "হে রাম" বলে লুটিয়ে পড়েন, সে স্থানটুকু চিহ্নিত করে একটা স্তম্ভ তৈরি করা হয়েছে, স্তম্ভের গায়ে চারদিকে তার মৃত্যুর তারিখ সময় লিখে তার উপর "হে রাম" লিখে রাখা হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর মূল বাসভবনটিকে মিউজিয়াম করা হয়েছে যেখানে মহাত্মা গান্ধীর ব্যবহৃত দৈনন্দিন জিনিসপত্র ছাড়াও তার ছবি আর নানান দলিল রাখা আছে।

আমরা মিউজিয়ামটা ঘুরে দেখলাম। বের হবার সময় কিভাবে যেন আমি অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে পড়লাম। আমার অন্য সখীদের খুঁজে না পেয়ে আমি একাই বের হয়ে গেলাম। দেখি ওরা আসলে কেউই তখনও বের হয়নি। বাইরে একাই হাঁটাহাঁটি করছি, তখন দেখি আমার মত আরও এক সখী একলা একলা হাঁটছে।

ওকে নিয়ে মিউজিয়ামের পেছন দিকটায় চলে গেলাম। এখানে খুব সুন্দর একটা বাগান আছে, উজ্জ্বল রঙীন সব ফুলে আর গাছে ভরা। একটা ছোট নালাও আছে যার উপর একটা ছোট্ট সুন্দর সেতু। ঐ সেতুর সিঁড়িতে বসেই কিছুক্ষণ গল্প করলাম। কিছুক্ষণ পর অন্য সখীরা বের হয়ে আমাদের দেখেই বলে উঠল, কই চলে গিয়েছিলি তুই, আমরা খুঁজে খুঁজে হয়রান।

যা হোক, পরে ফুলগাছগুলোর সামনে বসে আমরা সবাই মিলে আরও ছবি তুললাম। এরপর আমরা রওনা দিলাম লোটাস টেম্পলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ওখানে গিয়েই দুঃসংবাদটা শুনতে হল। আজ সোমবার, লোটাস টেম্পল বন্ধ। এই দুঃখ আর কোথায় রাখব, বাইরে থেকেই একটু দেখলাম পদ্মফুলের আকৃতির মন্দিরটা।

মনের দুঃখ ভোলাতে আমরা হাঁটা শুরু করলাম রাস্তা দিয়ে। এই এলাকাটা বেশ ছিমছাম, নির্জন। গাইড জানাল মন্ত্রীপাড়ার কাছাকাছি আছি, তাই এমন কোলাহলহীন আর জ্যামও নেই কোথাও। এক তেরাস্তার মাঝখানে একটা সুন্দর ভাস্কর্য চোখে পড়ল। মহাত্মা গান্ধী সামনে পথ দেখিয়ে চলছেন, আর পেছনে সাধারণ লোকজন তাকে অনুসরণ করছে।

সবাই এর সামনেই ছবি তুলতে থাকল। আমিও দাঁড়ালাম, কিন্তু যাকে ক্যামেরা দিয়েছিলাম সে দিল তালগোল পাকিয়ে, গান্ধীর মূর্তিটাই সে ছবিতে আনেনি, তার উপর আবার আরেকজনের মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে। যা হোক, মনের দুঃখ কিছুটা প্রশমিত হবার পর আমরা রওনা দিলাম কুতুব মিনারের উদ্দেশ্যে। এইবার আমাদের কিছু কিছু অতি উৎসাহী বন্ধু গাইডের কান ঝালাপালা করে ফেলল, কুতুব মিনার কতদূরে, যেতে কতক্ষণ লাগবে, আমরা কি পৌঁছে গেছি? গাইড এবার অস্থির হয়ে জানালা দিয়ে দেখিয়ে দিল, ঐ যে কুতুব মিনার দেখা যায়। আমরা তাকিয়ে দেখি একটা উঁচু সাদা রঙের খাম্বার মত টাওয়ার, যার উপর দিয়ে আবার ধোঁয়া বের হচ্ছে, অনেকটা আমাদের দেশের ইঁটের ভাটার মত।

অস্থির বন্ধুরা ওতেই খুশি হয়ে বাকবাকুম করতে থাকল, ওয়াও কুতুব মিনার দেখা যাচ্ছে। আমি আমার সখীদের বললাম, এটা কুতুব মিনার না রে, আমি ছবি দেখেছি, কুতুব মিনার লাল ইঁটের তৈরি, আর উপরে ধোঁয়াও বের হয় না। অবশেষে আসল কুতুব মিনারের কাছে পৌঁছে বন্ধুদের বাকবাকুম থামল আর কটমট করে গাইডের দিকে তাকিয়ে রইল। গাইড তখন মিটিমিটি হাসছে। কুতুব মিনারের সৌন্দর্য্য বর্ণনা করা খুব মুশকিল।

দূর থেকে দেখলে সাধারণ একটা মিনারের মত মনে হলেও কাছে গেলে দেখা যায় কত সূক্ষ্ম কারুকাজ আছে এতে। তবে আফসোস যে বেশি কাছে যাওয়া নিষেধ, আর ভিতরের পেঁচানো সিঁড়িটায় ওঠা তো একেবারেই নিষেধ, পুরনো হয়ে যাওয়ায় পর্যটকদের ভার সইতে পারবে না বলে। অথচ এখানে ওঠার একটা ইচ্ছা ছিল অনেক দিন ধরেই। অনেক পুরনো একটা হিন্দি সিনেমায় দেখেছিলাম এই সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে নায়ক গান শোনায় নায়িকাকে। আফসোস! যাক, একদিনে অনেক ঘোরাঘুরিই হল।

এবার হোটেলে ফিরে লাঞ্চ সেরে আমরা আবার বের হব। এবার যার যার মত শপিং করতে। গাইড আমাদেরকে আবারও ব্রিফিং দিয়ে দিল, রিকশাওয়ালা বা অটোরিক্সাকে কী বলতে হবে, দোকানে কিভাবে মুলামুলি করতে হবে। আর এটাও বলে দিল যেন আমরা মেয়েরা অবশ্যই সাথে কোন ছেলেকে নিয়ে নিই। আমরা একটু মুশকিলে পড়লাম, আমরা তিন কন্যা কাকে সাথে নিব বুঝতে পারছিলাম না, সবাই আগে থেকেই কাউকে না কাউকে বলে রেখেছিল।

যা হোক, আমরা বের হয়ে গেলাম, দেখা যাক না কাকে পাওয়া যায়। দেখলাম আমাদের সেই বন্ধু, যে জয়পুর আমাদের সাথে সিনেমা দেখতে যাবার সময় কষ্ট করে রিকশার পেছনের সিটে বসেছিল, সে একলা একলা ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোন গ্রুপের সাথে যাবে বুঝতে পারছে না। আমরা ডাকতেই সে চলে এল আমাদের গ্রুপে। আমরা রিকশা ঠিক করলাম দুইটা, বেশ চওড়া রিকশাগুলো, অনায়াসেই তিনজন পাশাপাশি বসা যায়। আমরা চলে গেলাম দিল্লীর বিখ্যাত চাঁদনী চকে।

বিকাল থেকে শপিং করতে করতে রাত হয়ে গেল। আসলে কেনাকাটা কম আর ঘুরাঘুরিই বেশি হচ্ছিল। বোনদের আর আমার জন্য জামা, কিছু কসমেটিক্স, জানের জান ভাগ্নের জন্য কাপড় আর আম্মার জন্য একটা শাড়ি কেনা হল, শাড়ির নাম কুচ কুচ হোতা হ্যায় । শপিংএর ফাঁকে সেই সকালের মত আরও একটা পুজার র‌্যালি দেখা হল। ফেরার সময় একটা অটোরিক্সা নিলাম।

অটোরিক্সাও বেশ বড় আর আরামদায়ক। রাস্তায় আসতে আসতে লালকিল্লা নজরে এল। এটাও আজকে বন্ধ, আমাদের কপালটাই খারাপ। এবার অটোরিক্সায় আমার এক দুষ্টু সখী আমাদের নিরীহ বন্ধুটাকে ধরল, গান শোনাও। সে বেচারা লজ্জায় লাল-নীল-বেগুনি হয়ে বলল, আমি ভালো গাইতে পারি না তো।

ভালো গাওয়ার দরকার নাই তো, যেমন পারো তেমনই গাও। সে অবশেষে রাজী হল এই শর্তে যে পরে আমাদেরও গান গেয়ে শোনাতে হবে। এরপর সে দুইটা গান শোনাল। এরপর বলল, এখন তোমাদের পালা। সখী বলে উঠল, আরে আমরা তো হোটেলে পৌঁছে গেছি, নাহ, আজকে আর হল না, আরেকদিন শোনাব।

বন্ধু এবার লাল হয়ে গজ গজ শুরু করল, কী! এইসব ঠিক না। এইটা পুরা ধোঁকাবাজী। আমাকে ধোঁকা দিয়ে তোমরা দুই-দুইটা বেসুরা গান গাইয়েছ। সে গজগজ করতেই থাকল, আমরাও হি হি করতেই থাকলাম। আমাদের ঘোরাঘুরি অবশেষে শেষ হল।

এবার ফেরার পালা। পরদিন আমরা রওনা দিলাম কোলকাতার উদ্দেশ্যে। রেল স্টেশনে গিয়ে সেই আগের মত নিজেদের ট্রেন খুঁজে বের করে যার যার সিটে উঠে গেলাম। শিকল দিয়ে ব্যাগ বেঁধে রাখতেও ভুললাম না। এবারও আমি একেবারে উপরের বেড বেছে নিলাম।

সেই সবাই মিলে আড্ডা, কোন স্টেশনে থামলে বন্ধুদের দৌড়ে গিয়ে সবার পানির বোতল ভরে আনা, সবই চলতে থাকল। তবে এবার খুব লম্বা একটা সময় পার করতে হচ্ছিল। দিল্লী থেকে কোলকাতা প্রায় ছত্রিশ ঘন্টার জার্নি। দুপুরে সবাই শুয়ে পড়লাম। ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, তখন টের পেলাম যে কোন একটা স্টেশনে ট্রেনে থেমেছে।

ঘুম ঘুম চোখেই শুনতে পেলাম কেউ একজন এসে নিচের বেডে শুয়ে থাকা আমার এক সখীকে বলছে, উঠো উঠো, ইয়ে হামারা সিট হ্যায়। সখী আমার ঘুম জড়ানো গলায় বলছে, কেয়া? নেহি নেহি ইয়ে হামারা সিট হ্যায়। বেশ একটা ক্যাচাল লেগে যাচ্ছিল, তখন আমাদের বন্ধুরা এসে বোঝাল, এটা আসলে তাদের বগীই নয়, তারা ভুল বগীতে উঠে পড়েছে। মীমাংসা হয়েছে বুঝতে পেরে আবারও ঘুম দিলাম। বিকালে সবাই আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলাম, এখনও ট্রেন চলছে তো চলছেই।

আমরা তিন কন্যা জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখতে থাকলাম। বন্ধুরা আমাদের পাশেই কলব্রিজ খেলতে বসে গেল বিভিন্ন গ্রুপ হয়ে। একসময় দেখলাম একটা গ্রুপে তিনজন হচ্ছে বলে খেলতে পারছে না, এদিক ওদিকে ডাকাডাকি করেও তারা একজনকে আর পাচ্ছে না। সবাই হয় কোন গ্রুপে ঢুকে পড়েছে, নয়তো কেউ কেউ খেলতেই পারে না। ওদের হতাশ চেহারা দেখে আমি বললাম, তোমাদের আপত্তি না থাকলে আমি যোগ দিতে পারি।

খুব আগ্রহ নিয়েই ওরা নিয়ে নিল ওদের দলে। এরপর এটাই একটা দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়াল যে আমি বন্ধুদের সাথে তাস পিটাচ্ছি। অনেকেই এসে এসে দেখে গেল আমার কান্ড। কেউ কেউ জানতে চাইল, আমি কোথায় শিখলাম খেলা। বললাম, বাসায় আব্বার সাথে আমরা বোনরা খেলি মাঝে মাঝেই।

সবচেয়ে মজা পেল সবাই আমার শাফলিং দেখে। খেলা ভালো না জানলেও শাফলিংটা করি আবার প্রফেশনালদের মতই। বন্ধুদের অনেকেও সেটা পারে না। এটাও আব্বার কাছ থেকেই শিখেছিলাম আমি। আস্তে আস্তে আমাদের গ্রুপের সদস্যরা অদল-বদল হতে থাকল।

একজনের ঘুম পেয়ে যাওয়ায় তার জায়গায় স্যার যোগ দিলেন। এবার আমার সখীরাও আগ্রহী হয়ে উঠল। এক সখী এক বন্ধুকে সরিয়ে নিজে যোগ দিয়ে খেলাটা শিখে নিতে থাকল। এমন কি বন্ধুদের যারা খেলাটা জানে না, তারাও এবার অতি আগ্রহে খেলা শিখতে চলে এল। ভালোই একটা সময় কেটে গেল।

সন্ধ্যার পর আমাদের ট্রেন একটা স্টেশনে থামল, কোন স্টেশন মনে করতে পারছি না। এখানে আমাদের ট্রেন বদল করতে হবে, তাও আবার প্ল্যাটফর্ম পাল্টে। সবাই লাগেজ নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে যেতে থাকল। আমার ব্যাগ দুটো এতদিন নিজেই বহন করেছি, এখন দেখলাম বেশ ভারী হয়ে গিয়েছে, এতদিনের শপিং-এর ফল। কষ্টে-মষ্টে বহন করতে পারলেও দৌড়াতে পারছিলাম না।

এদিকে ঐ প্ল্যাটফর্মে আমাদের ট্রেন চলে এসেছে, বেশি দেরী করলে মিস করতে হবে। এবার আমার এক বন্ধু এগিয়ে এল, তার নিজেরও বেশ কয়েকটা ব্যাগ ছিল, সে তার সবচেয়ে হালকা ব্যাগটা আমাকে দিয়ে আমার একটা ভারী ব্যাগ নিজে নিল। এবার আমি মোটামুটি দৌড়ে দৌড়ে ট্রেনে উঠতে পারলাম। ট্রেনে উঠে আমাদের বিশাল দল দেখে কয়েকজন বাঙালী লোক কথাবার্তা শুরু করল। আমরা কোত্থেকে এসেছি, কোথায় কোথায় ঘুরেছি সব শুনল।

বলল, কোলকাতায় অ্যাকুয়াটিকায় যান নি? ওটা তো অনেক সুন্দর। আমাদের যাওয়া হয়নি শুনে খুব আফসোস করল। আমাদের কোন সমস্যা হয়েছে কি না তাও জানতে চাইল। বললাম যে যাওয়ার সময় ট্রেনে খুব ভোগান্তি হয়েছে, প্রায় বারো ঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিল ট্রেন। তখন লোকটা বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি জানি তো, আমি দেখেছি ঐ ট্রেনটা দাঁড়িয়ে থাকতে।

আপনারা তো ভুল করেছেন, বসে না থেকে অন্য একটা ট্রেনে উঠে যেতে পারতেন, তাহলে এতটা সময় নষ্ট হত না। আমরা আর কী বলব, আমরা কি আর বুঝেছিলাম যে এত দেরী হয়ে যাবে? কোলকাতায় হাওড়া স্টেশনে পৌঁছালাম আমরা অনেক রাতে। ট্যাক্সি ঠিক করে সেই আগের হোটেল, হোটেল অশোকাতেই আবার উঠলাম। আমার হঠাৎ এত বেশি ক্লান্তি লাগছিল যে আমি কোনমতে হাতমুখ ধুয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লাম, এমন কি কাপড়ও পাল্টাইনি। ঘুম ভেঙেছিল একবারে পরদিন ভোরবেলা।

সখীদের কাছে শুনলাম আমি নাকি এমনই মরার মত ঘুমিয়েছি যে আমাকে রাতের খাওয়ার সময় ডেকেও ওঠানো যায়নি। পরে আমাকে রুমে তালাবন্ধ রেখেই ওরা খেতে চলে গিয়েছিল। ঐ রাতে স্পেশাল ডিনার ছিল, আমাদের গাইড নিজের পক্ষ থেকে খাইয়েছিল সবাইকে। আমার কোন আফসোস হল না, আমি শান্তিমত ঘুমাতে পেরেছি এটাই আমার জন্য তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরদিন দুপুরের পর আমাদের রওনা দেয়ার কথা।

কিন্তু দুপুর পর্যন্ত হোটেলে থাকলে আমাদের আরেকদিনের ভাড়া এক্সট্রা দেয়া লাগবে। তাই আমরা ঠিক করলাম সকালেই চেক-আউট করে বের হয়ে যাব। বাসগুলো থাকবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গেটের সামনে। এখান থেকে সবাই গিয়ে যার যার মত শপিং করবে, খাওয়া-দাওয়া করবে, এরপর আবার সময়মত বাসের কাছে চলে আসবে। সেরকম হিসাব করেই আমরা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে আবারও গেলাম।

কিন্তু আমার তখন আর শপিং করার মত ইচ্ছা নেই, আসল কথা হল টাকা-পয়সাও আর তেমন নেই। আমি খুঁজছিলাম আমার মত আরও কেউ আছে কি না, কারণ সখীরা সবাই শপিং করবে আরও। অবশেষে আমার চার বন্ধুকে পেলাম। ঠিক করলাম, আমরা পাঁচজন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাঠে বসে সময় কাটিয়ে দিব। এক বন্ধু আশেপাশের দোকান থেকে তাসের একটা প্যাকেট কিনে আনল, বসে বসে তাস খেলা যাবে।

তাই করলাম আমরা, চারজন ঘাসের উপর বসে গেলাম কলব্রিজ খেলতে। আরেক বন্ধু খেলবে না, সে ঘুমানোর পরিকল্পনা করছে। আমার ভ্যানিটি ব্যাগটাকে বালিশ বানিয়ে সে শুয়ে পড়ল গাছের ছায়ায় ঘাসের উপর। সময় কখন পার হয়ে গেল টেরও পেলাম না। সখীরা, বন্ধুরা যারা শপিংএ গিয়েছিল একে একে ফিরে এল।

তখনও আমাদের রওনা দেবার কিছু দেরী আছে। আমার সখীরা দুপুরের খাবার সেরে এসেছে। আমরা পাঁচজন এবার ঝামেলায় পড়লাম, আমরা তো সময়টা খেয়ালই করিনি, নইলে কোথাও থেকে খেয়ে আসা যেত। এখন কোথাও যাওয়ার মত সময় নেই। বন্ধুরা রাস্তার চায়ের দোকান থেকে কেক কিনে খেল।

আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে থাকলাম অন্য কিছু পাওয়া যায় কি না। দেখি একটা ঠেলায় করে একজন কিছু একটা বিক্রি করছে, চুলা আর তার আশে পাশে রুটির মত কিছু দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী এগুলো? বলল, দিদি এটা এগ রোল, খাবেন? খুব ভালো লাগবে। নিয়েই নিলাম একটা। খুব ক্ষুধার মধ্যে ছিলাম বলে কি না জানি না, কিন্তু খেতে অসাধারণ লাগল।

এই খাবারটা নিয়ে আমি আগে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। যাক, খাওয়া-দাওয়া অল্পের মধ্যে ভালোই হল। আমরা এবার রওনা দিয়ে দিলাম আমাদের দেশে ফেরার পথে। বেনাপোলের কাস্টমস পার হয়ে যখন যশোর শহরে ঢুকলাম, তখন রাতের খাবারের সময় হয়ে গিয়েছে। সাধারণ একটা হোটেলে ঢুকে আমরা সাদা-ভাত, ডাল আর গরুর মাংস ভুনা খেলাম।

একেবারে সত্যিকারের ভালো লাগা যে কী এবার বুঝলাম, নিজের দেশের রান্নার চেয়ে ভালো আর কিছু হতেই পারে না। ঐ পাতলা করে তৈরি করা ডাল আর খুব বেশি মশলা দিয়ে ভুনা গরুর মাংসই মনে হচ্ছিল যেন অমৃত, কতদিন পর যেন নিজের বাড়ির খাবারের স্বাদ পেলাম। পেট পুরে তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে আবার রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। যারা ধৈর্য্য ধরে এতদিন আমার সাথে ছিলেন তাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। শেষ।

 ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.