আগের পর্ব
কোলকাতায় পৌঁছালাম যখন, তখন প্রায় বিকাল হয়ে গিয়েছে। দুপুরের খাবার কোথায় কিভাবে করেছিলাম এখন একদম মনে পড়ছে না। যা হোক, আমরা উঠেছিলাম হোটেল অশোকায়। বেশ ভালোই ছিল হোটেলটা। কিন্তু আমরা আমাদের রুমে ঢুকেই আবিষ্কার করলাম কমোডের ফ্ল্যাশ নষ্ট।
ইন্টারকমে অভিযোগ জানাতে সাথে সাথে লোক পাঠিয়ে দিল। কিন্তু সে কাজের কাজ কিছুই করতে পারল না। আপাতত কাজ চালানোর জন্য একটা বদনা দিয়ে গেল শুধু। যাহ, ভ্রমণ কাহিনী শুরু করতে না করতেই বদনার নাম নিয়ে ফেললাম। কী আর করা, হোটেলে ঢুকেই বদনা পাওয়ায় মেজাজ খারাপ হলেও পরে একটা সময় বলতেই হয়েছিল, জয়তু বদনা।
সে কাহিনীতে পরে আসছি।
ঢাকায় যখন পরিকল্পনা হচ্ছিল কবে কোথায় ঘুরতে যাব, তখন আমাদেরকে একটা তালিকা ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেখানে তারিখ আর সময় উল্লেখসহ সব জায়গার নাম দেয়া ছিল। প্রথম দিনের তালিকায় ছিল কোলকাতায় পৌঁছে বিশ্রাম। কিন্তু আমরা কি আর বসে বসে ঝিমানোর পাবলিক? সন্ধাবেলা হোটেলের রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করেই আমরা বের হয়ে গেলাম।
ঐ যে, এতক্ষণে মনে পড়ল লাঞ্চ কখন কোথায় করেছি। যা হোক, কোন পরিকল্পনা নেই যেহেতু, কাজেই উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরিটাই এখন উদ্দেশ্য।
হোটেল থেকে বেরিয়েই হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে হাওড়া ব্রিজের কাছে চলে এলাম। ব্রিজের কাছাকাছি রাস্তার ফুটপাথে নানান রকম পসরা সাজিয়ে বসেছে বিক্রেতারা।
শাক-সবজি, আলু-পটল, চুড়ি-গয়না, খেলনা কী নেই সেখানে। আর যে ব্যাপারটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল তা হল, বিক্রেতাদের সবাই মহিলা। কোথাও কোন পুরুষ বিক্রেতা দেখলাম না। ভালোই লাগল।
হাওড়া ব্রিজে উঠে দারুণ লাগল।
বিকালে যখন কোলকাতায় প্রবেশ করেছিলাম, হাওড়া ব্রিজের উপর দিয়েই গিয়েছিলাম। এখন দেখছিলাম সন্ধ্যায় ব্রিজের আলো ঝলমলে রূপ। আর পায়ে হাঁটার জন্য আলাদা অংশ থাকলেও যানবাহন চলাচলের জন্য যে সামান্য ঝাঁকুনি হয় সেটাও খুব মজার। পুরো ব্রিজটাই হেঁটে পার হলাম। ঐপাড়ে গিয়ে একটা মোড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম।
উদ্দেশ্য ট্রামে উঠব। এই মোড়ে ট্রামের স্টপেজ।
মোড়ে দাঁড়িয়ে যখন অপেক্ষা করছি, ততক্ষণে আমাদের মধ্যে একজন ছবি তোলার কথা মনে করিয়ে দিল। মোড়ে একটা ছোট মন্দির ছিল। মন্দিরটা একেবারেই ছোট, একটা ছোট মুদির দোকানের সমান বলা যায়।
সেটার সামনে দাঁড়িয়েই ছবি তোলার ধুম পড়ে গেল। স্যার বলতে থাকলেন, এটা কী করছ তোমরা, এই অখ্যাত একটা মন্দিরকে তো তোমরা বিখ্যাত বানিয়েই ছাড়বে দেখি।
এর মধ্যে একটা ট্রাম এল। কিন্তু সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত থাকায় দৌড়ে যেতে যেতে একটু দেরী হয়ে গেল, ট্রামটা আর ধরা গেল না। তবে আমাদের গাইড আস্বস্ত করল যে দশ মিনিট পরেই আরেকটা ট্রাম আসবে।
এবার সবাই জায়গামত প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পরের ট্রামটা আসতেই সবাই এক লাফে চড়ে বসলাম। দুইটা অংশ ছিল, দুই অংশেই আমরা সমস্ত জায়গা দখল করে ফেললাম। প্রথমবার ট্রামে চড়ে কারুর মুখে আর হাসি ধরে না।
এর মধ্যে ছবি তোলাও চলতে থাকল।
হঠাৎ দেখি আমাদের স্যার আমাদের মতই শিশু হয়ে গিয়েছেন। যদিও এটা তার প্রথম কোলকাতায় আসাও না, প্রথম ট্রামে চড়াও না। তারপরও তিনি ট্রামের দরজায় দাঁড়িয়ে বত্রিশ দন্ত বিকশিত করে মুখ বাড়িয়ে বাতাস খাচ্ছেন। তার ঐ আনন্দের দৃশ্য দেখে আমাদের আনন্দ আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ট্রাম থেকে নামলাম যেখানে, সে জায়গার নাম গিয়েছি ভুলে।
আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। ওহ এতক্ষণে মনে পড়ল আমরা বেনাপোলের উদ্দেশ্য যখন যশোর দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন একবার বাসের টায়ার পাংচার হয়েছিল। যাক গে, এটা এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না।
যা হোক, আমরা ট্রাম থেকে নেমে হাঁটা ধরলাম আবারও। এর মধ্যে কেউ একজন প্রস্তাব দিল কফি হাউসে যাওয়ার।
গাইডের নির্দেশনায় আমরা এবার লোকাল বাসে উঠলাম। কফি হাউসে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। খুঁজে খুঁজে দেয়ালের দিকে কয়েকটা টেবিল খালি পাওয়া গেল। আশে পাশে তাকিয়ে যা বুঝলাম সাধারণ লোকজনের মাঝে কিছু হোমড়া চোমড়া টাইপের সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বোদ্ধারাও আছেন। কফি হাউসে এসেছি, কফি তো খাওয়াই লাগবে।
আর খাবই যখন সাধারণ কফি কেন খাব। আমরা পছন্দ করলাম আইস কফি। কফিটা আসলেই ভালো হয়েছিল কি না জানি না, কিন্তু কফি হাউসে বসে কফি খাচ্ছি এই উত্তেজনাতেই মনে হয় ভালো লেগেছিল।
কফি হাউস থেকে বের হয়ে আমরা আবারও হাঁটা শুরু করলাম। হেঁটে হেঁটে কলেজ স্কয়ারে গেলাম।
গাইডের কাছে শুনলাম এই কলেজ স্কয়ার হল ঢাকার নীলক্ষেতের মত, যাবতীয় বই এখানে পাওয়া যায়। আমাকে মেজপা আইটির একটা বইয়ের নাম দিয়ে দিয়েছিল আনার জন্য। আমি ভাবলাম এই সুযোগ বইটা কিনে ফেলার। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ততক্ষণে বেশির ভাগ দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফুটপাথের অল্প কয়েকটা দোকান খোলা ছিল, সেখানে পাব না জেনেও খুঁজে দেখলাম।
হতাশ হতেই হল।
এরপর আমরা হাঁটতে হাঁটতে গেলাম কোলকাতা মেডিকেল কলেজ। রাতের বেলা যেটুকু পারা যায় ক্যাম্পাসটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ছবিও তুলেছিলাম কিছু, কিন্তু অন্ধকারে শুধু আমাদের ভেটকির ছবিই এসেছে। এরপর আমরা চলে গেলাম পাতাল রেলের স্টেশনে, যেটাকে ওরা বলে মেট্রো।
গাইড আমাদের সব নিয়ম কানুন শিখিয়ে দিল। কোথায় দাঁড়াতে হবে, কতক্ষণ দাঁড়াবে রেল, কিভাবে ঐ সময়ের মধ্যেই ওঠানামা করতে হবে। এমন কঠিন কিছু না, কিন্তু না জানলে শুধু শুধুই ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। মেট্রোতে চড়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে এতদূর চলে এলাম, দারুণ লাগল। তবে আফসোস একটাই, মেট্রোতে ছবি তোলা নিষেধ।
এই নিয়ম যে কেন করল কে জানে। যদিও কয়েকজন এর মধ্যেই লুকিয়ে ছবি তুলে ফেলেছিল।
মেট্রো থেকে নেমে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে আবারও ট্রামে চড়লাম। ট্রামে করে নামলাম গিয়ে বিখ্যাত গড়ের মাঠে। এখানে সবাই একটু বসে জিরিয়ে নিলাম।
অনেক হাঁটা হল এত বড় একটা জার্নি করেই। এর মধ্যে আমাদের গাইড তার জ্ঞান বিতরণ শুরু করল। গড়ের মাঠ থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের চুড়া দেখা যায়। সেটা দেখিয়ে ইতিহাস বর্ণনা শুরু করে দিল। বিরক্ত লাগলেও কেউ কিছু বলছিল না।
তারপরও তাকে থামতেই হল। আমরা না, থামাল এক পুলিশ। পুলিশ এসে আমাদের গাইডকে ধরে বলল, এত রাতে এখানে হচ্ছেটা কী? তখন গাইডের যা চেহারা হয়েছিল, অন্ধকারে ভালোমত দেখতে পাইনি বলে আফসোসই হচ্ছিল। যা হোক, কোন ঝামেলা হয়নি। পুলিশকে সব বলতেই সে বলল, বেড়াতে এসেছেন ভালো কথা, কিন্তু এত রাতে এখানে বসে মিটিং করার তো দরকার নেই।
যান, হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম নিন।
আমরা সুবোধ বালক-বালিকার মত উঠে পড়লাম। আসলেই অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। লোকাল বাসে করে ফিরে এলাম হোটেলে। হোটেলে ফিরে রুমে না গিয়ে আগে রিসিপশন থেকে ফোন করলাম বাসায়।
আব্বা-আম্মার সাথে কথা বলে জানালাম ঠিকঠাকমতই পৌঁছেছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি। রাতের খাবারের কী ব্যবস্থা হয়েছিল আবারও সব ভুলে গিয়েছি। ব্যাপার না।
কোলকাতার রাস্তায় যা মনে হল, অনেকটা ঢাকার মতই। অনেক ব্যস্ত, রাস্তায় জ্যাম।
দোকানপাট, অফিস সবই অনেকটা ঢাকার মতই লাগে। শুধু কিছু পার্থক্য আছে, তার মধ্যে একটা তো ট্রাম, একটা মেট্রো (সেটা অবশ্য রাস্তায় দেখা যাবে না), আরেকটা বড় ব্যাপার ছিল ফ্লাই ওভার। আমাদের দেশে তখনও ফ্লাই ওভারগুলো তৈরি হয়নি। তাই এখানে দেখে একটু মন খারাপই লাগছিল। আরেকটা ব্যাপার হল, কোলকাতার রাস্তায় বাঙালী পাওয়া যায় কম।
রাস্তায় কাউকে বাংলায় কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়ে বেশির ভাগ সময়ই ধরা খেতে হয়েছে, তারা হিন্দিতে কথা বলে। আর কোলকাতায় রাস্তা পার হওয়া একটু মুশকিল। ঢাকার মতই ব্যস্ত রাস্তা, কিন্তু ঢাকায় যেমন রাস্তা পার হওয়ার সময় হাত তুললে গাড়িগুলো একটু গতি কমায়, কোলকাতায় মোটেই এমনটা করে না।
এই তো গেল কোলকাতায় প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা। পরের দিনের গল্প আরেকদিন।
চলবে............
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।