আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আশরাফুল...

অতি সংক্ষেপঃআমি পেশায় একজন চিকিৎসক...নেশায় একজন ভাবুক...আর মনে প্রানে একজন মানুষ... "আমি এ বিষয়ে আমার চিন্তা ও নিজে যতটুকু জানি,তা অনেক আগেই ক্রিকেট বোর্ড ও আইসিসি কে জানিয়ে দিয়েছি। এই খবর শুনে তাই আমি মোটেই বিস্মিত হইনি। খবরটা আমার জন্য যেমন হতাশার,তেমনই কষ্টের,কিন্তু বিস্ময়ের নয়। খুবই পাশবিক ও অমানবিক একটা ভয়াবহ অন্ধকার জগৎ থেকে এই জুয়ার চক্র নিয়ন্ত্রিত হয়। ও ছিল অসম্ভব প্রতিভাধর একটা কিশোর।

সম্ভবত ওর যখন ১৫ বছর বয়স,তখনই কিছু লোক ওকে এই জালে ঢুকিয়ে ফেলেছে। ওর জন্য আমার সবসময়ই কষ্ট লাগে। এসব ব্যাপার আমার চোখ এড়ায়নি। যে সময়ে আশরাফুল এই পথে পা বাড়িয়েছে,তখন তার কাছে খুব একটা বিকল্পও ছিলনা। বিশাল পরিবারের চাহিদা মেটাতে ক্রিকেট থেকে শুরুর দিকের আয় তার জন্য মোটেও যথেষ্ট ছিলনা।

সে তখন একটা গ্রেট হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ছোট্ট বালক ছিল। কিন্তু তখনই তার বাসায় ১০ সদস্যের বিশাল এক পরিবার। এর বাইরেও সম্ভবত গোটা পাঁচেক পরিবারের দৈনিক চাহিদা তাকে মেটাতে হত। শুধু একজন উঠতি ক্রিকেটারের বেতন দিয়ে এটা অসম্ভব একটা ব্যাপার ছিল। আমরা এই মহাদেশে বসে বাংলাদেশের ওই বাস্তবতা কল্পনাই করতে পারবনা।

আমরা আসলেই এক ভিন্ন দুনিয়ায় বসবাস করি। আশরাফুলকে এই অন্ধকার জগতের হুমকি ও ভীতি মাথায় নিয়েই সারাজীবন খেলে যেতে হয়েছে। তাই তাকে দায় দেয়ার আগে আরও অনেক কিছু নিয়েই ভাবতে হবে। আশরাফুলের মত জীবন-যাপন করে তবেই আশরাফুলকে দোষী বলতে আসা উচিৎ মানুষের!!!" ---জেমি সিডন্স(প্রাক্তন জাতীয় ক্রিকেট কোচ,বাংলাদেশ) ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রথম থেকেই আশরাফুলের বিশাল একজন ফ্যান। আশেপাশের অনেকেই ওর বিশেষ গুণগ্রাহী না।

অবশ্য তাতে দোষ দেয়ার উপায় নাই। ওর আউট হওয়ার ধরন দেখতে দেখতে মাঝেমধ্যে আমিই হতাশ হয়ে যেতাম। আশেপাশের লোকজন আশরাফুলকে কাছে পেত না। তাই আশরাফুল বাজে খেললে প্রথম থেকেই সকল পচানি এবং খোচানির স্বীকার আমি। অতিষ্ঠ হয়ে একদিন আশরাফুলের মোবাইলে কল দিলাম, -"ব্যাটা,ইয়ে ফালাইতে খেলতে নামো?" ওপাশ থেকে একটু নীরবতা।

তারপর চিকনভাবে একজন বলে উঠল, -"দুঃখিত ভাই। এরপর থেকে আরও ভালো খেলার চেষ্টা করব। " এই কথা শোনার পর আসলে আর কিছু বলার থাকেনা। সেইসকল পচানি আর খোচানি মাথা পেতে নিলাম। কখনই আর নিজের রাগ টিভির রিমোট বাদে আর কারও উপর ঝাড়ার চেষ্টা করিনাই।

আশরাফুলের ফিক্সিং এর কাহিনী যেদিন শুনলাম ঘুনাক্ষরেও বিশ্বাস করিনাই। যেই ছেলে আইসিএল এর ১০ কোটি টাকা,কিছুদিন আগে ২৫ লাখ টাকার গাড়ির লোভ পায়ে ঠেলে জাতীয় দলের হয়ে খেলে যায় সে সামান্য কয়েক লাখ টাকার জন্য যে এটা করবেনা সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম। আশেপাশের সেই তারা কিছু ম্যাসেজ পাঠাল। সবার বক্তব্য মোটামুটি এক, "কিরে?তোর আশরাফুল এইটা কি করল? ......" আমি কারও ম্যাসেজের কোন জবাব দেইনাই। আমি নিশ্চিত ছিলাম,যা বলা হচ্ছে তা ভুল।

কিছুদিনের মাঝেই আসল রহস্য প্রকাশ পাবে। তখন ম্যাসেজের উত্তর কল করে দেয়া যাবে। কিন্তু যা ভাবি আসলেই সব সময় তা হয়না। আশরাফুল নিজের মুখেই আমাকে এবং আমার সাথে আরও অনেকের দৃঢ় বিশ্বাসকে ভাংচুর করল। যে আশরাফুলকে আশার ফুল হিসেবে দেখতাম সে আমাকে কমপ্লিট ফুল বানিয়ে দিল।

এখন একটু ভিন্ন কথায় আসি। আমাদের দেশে এমন অগুণতি মানুষ আছে যারা দেশের জন্য কখনই ভালো কিছু করেনাই। সারাজীবন দেশের অনিষ্ট করে নিজের পকেট ভারী করেছে। দেশকে পুঁজি রেখে নির্লজ্জ সব ব্যবসায় নিজের ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়িয়ে গেছে। আপনি আমি সকলেই জানি এদের কখনও ধরা যায়না অথবা ধরা হয়না।

জাতীয়ভাবে তাদের কালো টাকা সাদা করবার হাজারো উপায় বের করা হয়। তারা সাদাকে কালো করে,কালোকে সাদা। দিনকে রাত আর রাতকে দিন করতে তাদের সময় লাগেনা। অথচ সরকারিভাবে নিয়ম জারি করে তাদের অনেককে আবার নতুন করে ঋণ দেয়া হয়। হাজার কোটি টাকা যে দেশে কিছুই না,ক্ষেত্র বিশেষে লাখ টাকাই সে দেশে আজীবন নিষেধাজ্ঞার দাবীদার।

আমি বলছিনা আশরাফুল বেকসুর খালাস হোক। আর্থিক অনটন,পারিবারিক সংকট কোনকিছুই ফিক্সিং এর মত একটা ঘৃণ্য অপরাধকে জাস্টিফাই করেনা। তবে যারা আজীবন দেশ বেঁচে খেয়ে গেছে দয়া করে আশরাফুলকে সেই দলে ফেলবেন না। আপনাদের চোখের সামনে আপনাদের টাকায় কেনা মার্সিডিজে করে দুর্নীতি ঘুরে বেড়ায়,আর রিকশার ছিদ্র পর্দার মাঝে,বৃষ্টিবিঘ্নিত আপনি তাদের গাড়ির কালো কাঁচের ছায়ায় নিজের অসহায় ছবি দেখতে দেখতে মনের ভুলেই হয়ত অশ্রাব্য কিছু গালি হাওয়ায় ছুঁড়ে দেন। আপনার এবং আমার যোগ্যতা কিন্তু অতটুকুই।

আজ আমরা আশরাফুলকে একা পেয়ে আমাদের যোগ্যতার সীমা থেকে বের না হই। যে ছেলেটা অকপটে সমগ্র জাতি,দেশ,পৃথিবীর সামনে একজন অদ্ভুত বাংলাদেশির মতই নিজের দোষ,নিজের অযোগ্যতাকে স্বীকার করে নেয়,তাকে কথাকাজে পিষে ফেলতে আমরা আজ অনেক বেশি যোগ্য না হই। যদি একান্তই না পারেন,একসময় সে কি করেছিল দয়া করে একবার ইউ টিউবে সার্চ দিয়ে দেখে নিবেন। জানি আশেপাশের আপনাদের অনেক কষ্ট হবে,তবে গালির মাত্রার পারদের মাপ কতখানি হওয়া উচিৎ তা ঠিক করে নিতে আপনাদের ওই চোখজ্বালা নিয়েই যে একটু দেখতে হবে। আশরাফুলের বিচার হোক।

তবে তা কোনক্রমেই যেন আজীবন নিষেধাজ্ঞার মাপকাঠিতে না যায়। আমরা তাকে আবার লালসবুজের পতাকায় দেখতে চাই। ও শূন্য করুক,দরকার হলে মাইনাস করুক,কথা দিচ্ছি মুখ ফুটে কোন খোঁচানি পচানির জবাব দেবনা। আশরাফুল ছাড়া শুধুমাত্র আর একজনেরই নিজদোষ স্বীকার করার সৎ সাহস ছিল। তিনি হলেন আমার আরেক প্রিয় দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন ক্যাপ্টেন হ্যান্সি ক্রনিয়ে।

তার শেষ হয়েছিল এক অস্বাভাবিক,সন্দেহজনক প্লেন ক্র্যাশে। আল্লাহ না করুক,আশরাফুলের এমন পরিনতি না হোক। আশরাফুল নায়ক ছিল,নায়ক আছে,নায়ক থাকবেই। ওর প্রতিটি স্কুপ-ড্রাইভ-পুল বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন দিনের জয়গান ছিল,জয়গান আছে,জয়গান থাকবেই।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।