আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উদ্ধারকর্মীদের যন্ত্রণার জীবন

কখনো নিজের বিছানার নিচে, কখনো পাশের বিছানায়, কখনো বালিশ উল্টেপাল্টে লাশ খুঁজে ফিরছেন রফিকুল ইসলাম। সাভারে ধসে পড়া রানা প্লাজার একজন উদ্ধারকর্মী রফিক। পেশায় রাজমিস্ত্রি। ভবনধসের দিন থেকে উদ্ধারকাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানে স্বেচ্ছায় কাজ করেছেন। উদ্ধার করেছেন জীবিত ও মৃত অনেককে।


সেই রফিকুল ইসলামকে শেরেবাংলা নগরের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। নয় দিন ধরে তিনি এই হাসপাতালের চতুর্থ তলায় চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এর আগে গত ৭ মে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওমর ফারুক নামের এক স্বেচ্ছাকর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। রানা প্লাজায় স্বেচ্ছায় উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া এই যুবকও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ঢাকা মেডিকেল থেকেই তিনি নিখোঁজ হন এবং নিখোঁজ হওয়ার দুই দিন পর গত ৭ মে হাসপাতালের একটি ট্রলির ওপর তাঁর লাশ পাওয়া যায়।

ফারুকের পরিবারের দাবি, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
তবে ফারুকের পরিবার জানায়, উদ্ধারকাজ শেষ করে বাসায় আসার পর ওমর ফারুক ঘুমের ঘোরে চিৎকার করতেন। একপর্যায়ে মানসিক ভারসাম্য হারান।
গতকাল মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে গিয়ে কথা হয় স্বেচ্ছাকর্মী রফিকুলের স্ত্রী আনোয়ারার সঙ্গে। তিনি জানান, রানা প্লাজা ধসের দিন সাভারের শিমুলতলা এলাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করছিলেন রফিক।

ভবনধসের খবর পেয়ে কাজ ফেলে রেখেই ছুটে যান সেখানে, যোগ দেন উদ্ধারকাজে। প্রথম কয়েক দিন বাড়িতেও যাননি। এরপর বাড়িতে গেলেও কিছু সময় থেকে আবার ছুটে গেছেন রানা প্লাজায়।
আনোয়ারা আরও জানান, ১৪ মে উদ্ধারকাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার পর বাড়িতে আসেন রফিক। কিন্তু রাতে ঘুমাতেন না।

হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লেও ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে উঠতেন, ‘এই জায়গায় লাশ আছে, ব্যাগ আনেন, কাপড় আনেন। ’ ফলে কাজে যাওয়া বন্ধ হলো। দিনে ঘুরেফিরে চলে যেতেন রানা প্লাজার সামনে। রাতের বেলায়ও রানা প্লাজার সামনে চলে যেতেন।
ধরাকণ্ঠে আনোয়ারা বলেন, ১৩ দিন আগ থেকে পুরোই বদলে যান রফিকুল।

কাউকে যেন চিনতেই পারেন না। খালি লাশ খোঁজেন। বিষয়টি বাড়ির পাশের আরেক স্বেচ্ছা উদ্ধারকর্মী জাকির হোসেনকে জানান তিনি। জাকিরই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করেন।
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে রফিকুলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন রানা প্লাজায় তাঁর সঙ্গে কাজ করা উদ্ধারকর্মীরা।

সেখানে গিয়ে দেখা মিলল আলী আশরাফ, জাকির হোসেন, মোবারক হোসেন, বাদল, মামুন ও শফিউল ইসলামের সঙ্গে।
উদ্ধারকর্মী জাকির বলেন, ‘রফিকের অসুস্থতার খবর শুনে গ্রামের বাড়ি থেকে ছুটে আসি। প্রথমে তাঁকে এনাম মেডিকেলে নিয়ে যাই। কিন্তু এনাম হাসপাতাল ভর্তি নেয়নি। পরে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করাই।


জাকির জানান, সাভারের সিআরপি-সংলগ্ন এলাকায় তিনি ও রফিক পাশাপাশি বাড়িতে থাকেন। তিনি ইপিজেডে একটি কারখানায় চাকরি করতেন। তাঁর বোন মাকসুদা রানা প্লাজার চারতলায় ফ্যান্টম অ্যাপারেলসে চাকরি করতেন। ভবনধসের খবর শুনে তাই তিনি ছুটে আসেন বোনকে উদ্ধার করতে। এসেই উদ্ধারকাজে লেগে পড়েন।

সেখানেই দেখা হয় রফিকসহ অন্যদের সঙ্গে। তাঁদের ২৫ জনের একটি দল ভবনের ভেতরে ঢুকে অনেক জীবন্ত মানুষকে বের করে আনে। উদ্ধারকাজের শেষ পর্যন্ত তাঁরা অনেক লাশ উদ্ধার করেন। দলের মধ্যে রফিকুলই সবচেয়ে বেশি লাশ উদ্ধার করেছেন বলে জানান জাকির। রাজমিস্ত্রি হওয়ায় ভবনের ভেতরে ঢুকতে তিনি অন্যদের চেয়ে পারদর্শী ছিলেন।

প্রকট গন্ধ উপেক্ষা করে গলিত লাশগুলো বের করেছেন রফিক।
জাকির বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমার বোনকে আর জীবিত পাইনি। ১০ মে রফিকই আমার বোনের গলিত লাশ উদ্ধার করেন। তাই এখন এই অবস্থায় রফিকের হতদরিদ্র পরিবারের পাশে দাঁড়াতে এসেছি। ’
রফিকের স্ত্রী আনোয়ারা বলেন, তাঁদের দুই মেয়ে, এক ছেলে।

তিনি এখন সন্তানসম্ভবা। একজনের আয়ে চলত পুরো পরিবার। তিনি বলেন, রফিক অসুস্থ হওয়ার পর থেকে সঙ্গের উদ্ধারকর্মীরা তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
ঘুম হয় না তাঁদের: ২৫ জনের এই উদ্ধারকারী দলটির সমন্বয়কারী সাভারের ব্যবসায়ী আলী আশরাফ বলেন, এই ২৫ জনের মধ্যে পূর্বপরিচয় ছিল না। কিন্তু ২৪ এপ্রিল থেকে ভবনের ভেতরে ঢুকে দিন-রাত সমান তালে কাজ করেছেন তাঁরা।

ভবনের ভেতরে কাজ করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েছেন, আবার জেগে উঠে কংক্রিট কেটেছেন। ভেতর থেকে জীবিত কেউ আওয়াজ দিলেই ছুটে গেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সেনাবাহিনীর লোকজন তাঁদের খাবার সরবরাহ করেছেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। এখন এই ২৫ জন পরিবারের মতো হয়ে গেছেন।


আলী আশরাফ বলেন, তাঁর দলের বেশির ভাগ উদ্ধারকর্মীই উদ্ধারকাজ শেষে বাড়িতে গিয়ে ঘুমের সমস্যাসহ নানা রকম মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন।
জাকির বলেন, রানা প্লাজায় উদ্ধারকাজে এসে চাকরিটা চলে গেছে তাঁর। আর সমস্যা হয়েছে রাতের ঘুমের।
আরেকজন উদ্ধারকর্মী শফিউল ইসলাম বলেন, ‘ঘুমের মধ্যে মানুষের চিৎকার শুনতে পাই। ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না।

আবার কখনো দেখি, ভবনের ভেতরের সুড়ঙ্গে ঢুকে বের হওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। ঘুম ভেঙে যায়। ’
রফিকসহ এই উদ্ধারকর্মীদের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ওয়াজিউল আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রফিক অনেক লাশ দেখেছেন, উদ্ধার করেছেন। ভবনের ভেতরে অনেক করুণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। উদ্ধারকাজের ব্যস্ততায় বিষয়গুলো নিয়ে তিনি চিন্তা করার সময় পাননি।

কিন্তু ঘটনাক্রমে যখন সেগুলো তাঁর মনে (ফ্ল্যাশব্যাক) হচ্ছে, তখনই তিনি আবেগতাড়িত হচ্ছেন। এটা এমন প্রচণ্ড যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছেন। সব সময় বিভ্রান্ত থাকেন, লাশ খোঁজেন এখানে-সেখানে। ’
ওয়াজিউল আলম চৌধুরী বলেন, বড় ধরনের দুর্যোগের পরে অনেকেই পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তবে রফিকের সমস্যাটা একটু বেশিই জটিল।

তিনি বলেন, ৩ জুন রফিক এখানে ভর্তি হয়েছেন। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে তাঁর অবস্থার কিছুটা উন্নতি আশা করছি আমরা। তবে এ ধরনের রোগীর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন হয় বলে জানান তিনি। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।