শেষ প্রহরে ক্ষমতার বণ্টন কতোটা ফলদায়ক হয়
ফকির ইলিয়াস
==================================
নতুন মন্ত্রীরা যুক্ত হয়েছেন পরিষদে। এটা একটা নিয়মিত প্রসেস। কিন্তু এই শেষ সময়ে কেন? যে মন্ত্রণালয়গুলো বিন্যস্ত হলো তা আগেই হতে পারতো। এতে চাপ কম থাকতো কাজের। মানুষ বেশি সুবিধা পেতো।
তা করা হয়নি। হয়েছে এসে শেষ সময়ে। মাত্র এক বছরের কিছু বেশি সময় আছে বর্তমান সরকারের হাতে। এই সময়ে কতোটা কাজ হবে, সে প্রশ্ন আসতেই পারে।
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এসেছেন মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
তিনি আগামী সময়টুকুতে কতোটা পারবেন, তা দেখার বিষয়। বিদায়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন অনেক কিছুই পারেননি। তার ওপর আবার নির্বাচনকে সামনে রেখে উত্তাল হয়ে উঠতে পারে পরিস্থিতি। তা কতোটা সামাল দেয়া যাবে, সে প্রশ্ন অনেকেই করছেন। নতুন মন্ত্রীরা এলে তারা সবসময়ই বড় বড় ভালো কথা বলেন।
এমনটি বলেছেন হাসানুল হক ইনু, মুজিবুল হকও। হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘সঠিক তথ্য জনগণের কাছে তুলে ধরা এবং খ-িত তথ্য, মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন, তথ্য আড়াল করা, অসৎ তথ্য প্রচার ও অসৎ সাংবাদিকতাকে নিরুৎসাহিত করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করবো। ’ নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্যমন্ত্রীর এমন আশাবাদ জাতির জন্য ভালো সংবাদ।
এদিকে দায়িত্ব বুঝে নিয়েই কর্মকর্তাদের ‘দুর্নীতিমুক্ত ও পরিশ্রমী’ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন নতুন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক।
মন্ত্রী বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, আজ থেকে রেল মন্ত্রণালয়ে কোনো দুর্নীতি হবে না।
দুর্নীতি করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। ’ কর্মচারী-কর্মকর্তাদের তিনি হুঁশিয়ার করেন, ‘আমি অলসতা অপছন্দ করি, যে পরিশ্রম করবে না সে এই মন্ত্রণালয়ে থাকতে পারবে না। ’
মন্ত্রীরা এলেই এমন কথাবার্তা বলেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশে সৃজনশীলতা যতোটা না এগোচ্ছে, চুরি-চামারি এগোচ্ছে তার বহুগুণ। এর প্রতিকারে সরকার কী করছে? কতোটা করছে? অপরাধের ধরন, অপরাধীর মানসিকতা বদলাচ্ছে।
তাই আগে ছিল না, এমন অপরাধ দমনে নিরাপত্তা আইনও করতে পারে যে কোনো রাষ্ট্রপক্ষ। সমাজ বাঁচাবার জন্য সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আইন প্রণীত হতেই থাকে জনপ্রিতিনিধিদের দ্বারা কালে কালে।
এর সঙ্গে সঙ্গে আমরা এ বিষয়টিও লক্ষ করি, প্রণীত আইন কখনই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য চাপিয়ে দেন না কিংবা বাকস্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতার নামে জাতি-গোষ্ঠী বর্ণ-ধর্ম বৈষম্যমূলক ঘটনাবলীকেও প্রশ্রয় দেন না বিশ্বের বরেণ্য রাজনীতিকরা। অথচ আমরা দেখি বাংলাদেশে আইনের খড়গ নেমে আসে বিরোধী পক্ষের ওপর।
একটা বিষয় আমরা খুব গভীরভাবে দেখছি, যখনই সরকারি বড় কোনো নেতা কোনো কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত, তখনই ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে খুব সূক্ষ্মভাবে।
ধরা যাক হলমার্কের কথা। হলমার্ক কেলেঙ্কারির হোতাদের ছাড় দেয়া হবে না জানিয়ে দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেছেন, ‘ইতিমধ্যে অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদকের অনুসন্ধান টিম। তারা কিছু নথিপত্র সংগ্রহও করেছে। তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দুদক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। ’
দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে হলমার্কসহ ৫টি প্রতিষ্ঠান ৩ হাজার ৬০৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এর মধ্যে হলমার্ক সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল (সাবেক শেরাটন) শাখা থেকে ২,৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা দেশী-বিদেশী ২৬টি ব্যাংকের ৫৮টি হিসাবে পাচার করে নগদে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছে। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে আসে, ওই পরিমাণ অর্থ পাচারের জন্য রূপসী বাংলা শাখায় ১৭টি কোম্পানির নামে খোলা হয় ১৭টি হিসাব। দুদকের অনুসন্ধান টিম ইতোমধ্যে হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। এই কেলেংকারির গডফাদার কে বা কারা? তাদের কি কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে?
বাংলাদেশে আসলে চলছে এটা সাপলুডু খেলা। সরকারেরই অংশীদার এক নেতা সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রকাশ্যে।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, বিদ্যুৎ বিল অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দেশের তেল ও গ্যাস বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। শেয়ারবাজারে কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী সর্বস্ব হারিয়েছে। ডেসটিনি ইউনিপেটুসহ এমএলএম কোম্পানি মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা লুট করে নিচ্ছে। হলমার্ক এতো টাকা লুট করলো, অথচ দেড় মাসেও সরকার কোনো মামলা দেয়নি।
এই যে দুই চিত্র আমরা দেখছি, তা আসছে সরকারের ভেতর থেকেই। কোনটা জানবে, মানবে দেশের সাধারণ মানুষ! আরেকটি উদাহরণ দেয়া যায়। সরকার ড. ইউনূস ইস্যুতে বারবারই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ করছে। আবার বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষা ও মসৃণ করতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের পরামর্শ চেয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু। চট্টগ্রামের ইছানগরে কোস্টগার্ড আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেয়ার সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু এ পরামর্শ চান।
এ সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মঞ্চে বসা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষা ও মসৃণ করতে আপনি সবসময় পরামর্শ দেবেন। ’
যদি তাই হয় তবে ইউনূস ইস্যুতে বর্তমান মহাজোট সরকার কিছুটা নমনীয় হচ্ছে না কেন? কেন বারবার গ্রামীণ ব্যাংককেই টার্গেট করা হচ্ছে? দেশে একের পর এক ইস্যু আসছে। সাগর-রুনি হত্যাকা-, কূটনীতিক খালাফ হত্যাকা-, ইলিয়াস আলী গুম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অর্থ কেলেংকারির ঘটনা, ডেসটিনি, হলমার্ক, শেয়ারবাজার, তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু ইত্যাদি অন্যতম বিষয়। খবর বেরিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দেয়া বিচারপতিদের প্রকাশিত রায় প্রত্যাখ্যান করবে বিএনপি।
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তথা ত্রয়োদশ সংশোধনী নিয়ে প্রকাশিত রায় পর্যালোচনার দাবি নয়, সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা হবে। অতএব বুঝাই যাচ্ছে, একটা সংঘাতের দিকেই যাচ্ছে দেশ। এর শেষ কোথায়? আর কতো জিম্মি থাকবে সাধারণ মানুষ এমন হীন রাজনীতির কাছে?
কথা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ আপন গতিতেই এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্যের রাজনীতির কথা এলেই সামনে চলে আসে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
আমরা দেখেছি, দেশের ডানপন্থী একটি পক্ষ তরুণ প্রজন্মকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তারা প্রয়োজনে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে কিছু নেই’- এমন তত্ত্বও শোনাচ্ছে যত্রতত্র। যারা একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক ছিল, যারা একাত্তরে এ দেশের মা-বোনদের সম্ভ্রম লুণ্ঠন করেছিল, তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্যই এই সরকারকে মানুষ ভোট দিয়েছিল। সেই বিচার প্রক্রিয়া আজ কতোটুকু এগিয়েছে? এই সরকার যদি আর ক্ষমতায় আসতে না পারে তবে এই বিচার প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ কী? এমন অনেক কথাই আগাম ভাবা দরকার।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সহনশীলতার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশে খুব কঠিন কাজ ছিল না।
যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রধান দলগুলোকে সমানভাবে সম্মান করতো। এটা হয়নি। বরং কেউ কেউ এই চেতনাকে নিজ স্বার্থ হাসিলের কাজে লাগিয়েছে। অথচ জাতীয় উন্নয়নে সেটাই প্রধান রক্ষাকবচ। যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের এখনো মনে আছে কী চেতনা বুকে নিয়ে তারা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
সেই শাণিত শক্তির আজ খুব বেশি প্রয়োজন। মহাজোট সরকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সেটাই প্রমাণ করেছিল, এ প্রজন্ম ৩০ লাখ শহীদকে ভুলে যায়নি।
এ প্রজন্ম বাঙালি জাতিসত্তাকে বলীয়ান করেই বিশ্বে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে, সরকার এর সঠিক মূল্যায়ন করতে পারলো না। যে কথাটি না বললেই নয়, তা হচ্ছে আগামী নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে নাও থাকতে পারে।
তারা এককভাবে নির্বাচন করতে পারে। যদি মহাজোটে ভাঙন আসে, তবে এর পরিণতি কী হতে পারে- তা ভাবার বিষয়। মনে রাখা দরকার দেশের মানুষ জঙ্গিবাদের হোতাদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না। কিন্তু চরম লুটপাটকারীদের হাত থেকেও রেহাই পেতে চায় সাধারণ মানুষ।
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১২
-----------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা/ ২২ সেপ্টেম্বর ২০১২ শনিবার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।